ঘটনাগুলোর সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। প্রত্যেক জেলায়, এমনকি প্রত্যেক শহরে নিয়মিত ঘটছে । আমাদের নজর কাড়ছে না কারণ সমস্যার সমুদ্র এখন অনেক গভীর, অনেক বেশি উত্তাল। ওখানে সাঁতার কাটা আগের মত অতটা সহজ নয়। অনেকটা পেটি অপরাধের মত গা সওয়া হয়ে গেছে এমন অনেক অপরাধ যা এক সময় সমাজকে আন্দোলিত করতো, ভাবিয়ে তুলত। । বানিজ্যিক কারণে মিডিয়াও এ নিয়ে খুব একটা হৈ চৈ করছে না আশাব্যঞ্জক রিটার্নের সমীকরণে । বলছিলাম অপরাধ ও শাস্তি পর্বের শাস্তিকে নগদ মূল্যে ক্রয় করার দেশীয় সাংস্কৃতির কথা।
বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটা অপরাধের পেছনে জড়িয়ে থাকে অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয়। হোক তা নিজের, পরিবারের অথবা আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের। খুঁটির জোর বলে খুব জনপ্রিয় একটা টার্ম আছে যা দেশের হাটে মাঠে ঘাটে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। হোক তা ব্যবসা বানিজ্য, চাকরী বাজার, প্রমোশন, চুরি ডাকাতি, খুন, রাহাজানি অথবা দুর্নীতি, খুঁটির জোর শক্ত থাকলে অপরাধের সমুদ্রে যমুনা ব্রীজ তৈরী করতেও অসুবিধা হয়না। এরশাদ আমলে পরিচিত এক পুলিশ অফিসারের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছিল। খুব খোলামেলাভাবেই বলেছিলেন কতগুলো নির্মম সত্যকথা। এক একটা খুন নাকি আনন্দের হিল্লোর বইয়ে দেয় পুলিশ ঘরণায়। উপর হতে আগ বাড়িয়ে সমন পাঠানো হয় প্রয়োজনীয় অংক উল্লেখ করে, যা নদীনালা খালবিল পার হয়ে চলে যায় ইনসপেক্টর জেলারেল নামক গভীর সমুদ্র পর্যন্ত। হাইপ্রোফাইল ক্রাইমের মূল্যও নাকি হাই। এ ধরণের অপরাধে জড়িত অপরাধীদের খুঁটির জোরের পাশাপাশি জোর থাকে পকেটে। এই দুইয়ের তৃপ্তিদায়ক সংগম সমাজকে উপহার দেয় কোহিনুর অফিসারের মত পুলিশ অফিসার, যারা ৫/১০ হাজার টাকা মাসিক বেতন পেয়েও ক্রয় করতে সক্ষম হন কোটি টাকার বাড়ি, সুপার মার্কেট, আর বহুবিধ ব্যবসা বানিজ্য। তবে সব অপরাধীদের খুটি ও পকেটে সমান জোর এমনটা বললে নিশ্চয় বাড়িয়ে বলা হবে। এখানেই হাজির হয় অপরাধ ও শাস্তির দ্বিতীয় পর্ব। গৃহকর্তা কর্তৃক অল্প বয়স্কা গৃহপরিচারিকা ধর্ষণ, বাড়ির গয়নাবিবি কর্তৃক নাবালক গৃহকর্মীদের বেধড়ক পেটানো, প্রতাপশালীর লাথিতে সহায় সম্বলহীন কারও অকাল মৃত্যু, এ ধরণের ক্রাইম অনেক সময় পুলিশ নামক জলহস্তীর গোচরে আনা হয়না বাদি বিবাদীর যৌথ সিদ্ধান্তে। সরাসরি নগদ লেনদেন অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে বঞ্চিত করে তাদের প্রাপ্য ’হক’ হতে। এক পক্ষ প্রতাপশালী, বিত্তশালী, নগদ অর্থের উপর গড়াগড়ি যান সকাল বিকাল। এমন পক্ষের কেউ অপরাধ করলে পরিবারের কর্তা নিজে অথবা তৃতীয় কারও মাধ্যমে নগদ অর্থের বিনিময়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন কৃত অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে তা সফল হয় অনেক ক্ষেত্রে হয়না। এমনটাই বাংলাদেশের অপরাধ এবং শাস্তির থ্রেড। এ থ্রেড ধরেই পল্লবিত দেশের অপরাধ যার আবর্তে ঘুরপাক খায় বিচার ব্যবস্থা।
দ্বিমত করতে পারেন আমার সাথে কিন্তু আমার বিবেচনায় আমি স্থির। দেশের তাবৎ অপরাধের দায় দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। তুরাগ নদীতে ডুবে মরল ১৫ জন, নাটোরে পিটিয়ে হত্যা করা হল উপজেলা চেয়ারম্যানকে, মিজানুর রহমান শিক্ষক আর ফরিদপুরের চাঁপা রানীর হত্যা, চোর সন্দেহে গণধোলাই দিয়ে হত্যা, কর্তা কর্তৃক গৃহপরিচারিকা ধর্ষণ, গয়নাবিবি কর্তৃক নাবালিকা অত্যাচার, এসবের দায় দায়িত্ব পুরোটাই নিতে হবে ক্ষমতাসীন সরকারকে। একটা সমাজে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার জন্যেই জনগণ ভোট দেয়, রাজনৈতিক দলকে গদিতে বসায়। সরকারী ব্যর্থতার জরায়ুতে জন্ম নেয়া অপরাধের চিকিৎসা এক লাখ টাকা আর মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের মিথ্যা আস্ফালন হতে পারে না, তার জন্যে চাই পদক্ষেপ। পুরানো ঢাকায় আগুনে পুড়ে একাকার হয়ে গেল বিশাল লোকালয়। সাথে পুড়ে কয়লা হল এক গন্ডা আদম। হতে পারে এ জন্যে দায়ী ঐ এলাকার অসচেতন ব্যবসায়ীরা, অন্তত আপনাদের দৃষ্টিতে। কিন্তু আমার চোখে এ অপরাধের মূল আসামী ক্ষমতাসীন সরকার। আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে গ্রাম্য অপরাধ ও শাস্তি আদলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নগদ অর্থ নিয়ে ছুটে গেলেন ভিকটিমদের দুয়ারে। টাকার বিনিময়ে ফয়সালা করলেন সরকারী অপরাধ ও ব্যর্থতা। মা বাবার লাশ কবরে মাটি হওয়ার আগেই সন্তানদের বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে ঘটা করে বিয়ে দিলেন। নিজে মা সাজলেন, এবং সার্বজনীন বাহবা কুড়ালেন। দূর হয়েছে কি ঢাকার সমস্যা? ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে প্রাণ হারালেন চাঁপা রানী। এতিম তিন কন্যা সন্তানের মা হয়ে এদেরও দেখভাল করার প্রতিশ্রুতি দিলেন সরকার প্রধান। লাখ টাকা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ছুটে গেলেন ভিকটিমদের কাছে। আবারও আস্ফালন করলেন অপরাধী কাউকে ছাড়া হবেনা বলে। এবং এ পর্যন্তই। সরকারী অপরাধ ও ব্যর্থতা হালাল করার চিরাচরিত মূল্য এক লাখ টাকা পরিশোধ করে প্রধানমন্ত্রী ফয়সালা করলেন কৃত অপরাধ। বাংলাদেশের সরকার কি স্যালভেশন আর্মি না এনজিও যে টাকা দিয়ে জনসমস্যার সমাধান করতে হবে? সরকারের কাজ দেশ শাসন করা, দেশকে রিলিফ ময়দান বানানো নয়। ঢাকা ও ফরিদপুরে তিনজন করে কন্যা সন্তান দত্তক নিয়ে সমস্যার সমাধান করেছেন সত্য। কিন্তু এ ৬ জনই কি শেষ ভিকটিম? দেশের অলিগলিতে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন শিকার । কজনকে সন্তান বানাবেন? কজনের মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করবেন? একজন সন্তানের কাছে তার গর্ভধারিণী মা-ই আসল মা। নকল মা কখনোই আপন মার জায়গা নিতে পারে না, হোক তা দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই আসল মার বেচে থাকা নিশ্চিত করার অপর নামই দেশ শাসন। বাকি সব স্রেফ ধাপ্পাবাজি।