প্রকৃতির সাথে মানুষের চিরন্তন লড়াইয়ে অপর নাম যদি বিবর্তন হয়, সে বিবর্তনে জাতি হিসাবে আমাদের প্রাপ্তি কতটুকু তা দাঁড়িপাল্লায় দাঁড় করানোর মত সময় হয়েছে নিশ্চয়। দেখতে দেখতে ৩৯টা বছর পার করে দিয়েছি আমরা। বয়স বাড়ছে আমাদের, এবং সামনে আছে আরও ’৩৯ হাজার’ বছর। কি আছে আমাদের জমা খাতায়, কোন পুঁজির উপর আবর্তিত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ, কি রেখে যাচ্ছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে, প্রশ্নগুলো কেন জানি বিচলিত করে না আমাদের। কারণ, শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানও ঠাঁই পাচ্ছে না আমাদের চিন্তা-ভাবনার তালিকায়। আমরা বাস করছি আমাদের অতীতে। কে পিতা, কে ঘোষক, কে লড়াই করল, কে বিরোধিতা করল, কোন গলিতে কে কয়টা গুলি ছুড়ল, কে শহীদ আর গাজী হল, আমাদের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা এবং এর প্রাপ্তি এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। পৃথিবীতে আমরাই কি একমাত্র জাতি যাদের স্বশস্ত্র লড়াই করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল? মার্কিনি গোলায় বিধ্বস্ত ভিয়েতনামিদের মাঠ এখনো তেমন ঠান্ডা হয়নি। অথচ সেই তপ্ত মাটিতেই ওরা বুনে চলছে স্বাধীনতার আসল বীজ, অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ। আমাদের স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য কি এমনটাই ছিল না? সমসাময়িক বাস্তবতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে আমরা কি জোড় গলায় বলতে পারবো আমরা স্বাধীন? পাকিস্তানী ২২ পরিবার ও তাদের সেবাদাস সামরিক জান্তার শোষণ হতে মুক্তি পেয়ে আমরা কি নব্য দুই পরিবারের খপ্পরে আটকে যাইনি? এমন কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর চাওয়ার স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হয়েছে আমাদের গণতন্ত্রে?
প্রতিদিন ঘটছে ঘটনাগুলো। একটা সময় ছিল যখন এ সবের ব্যাপ্তি ছিল কেবল নষ্ট জনপদে। কিন্তু সে দিন এখন অতীত। শুধু রাজধানী অথবা বড় বড় শহরগুলোতে নয়, এসব এখন ঘটছে বাংলাদেশের সর্বত্র। দেখেও দেখি না, পড়েও মনে রাখছি না, অথচ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো প্রতিদিন উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে। আসলেই যদি দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ না থাকি তাহলে কিভাবে হজম করে যাচ্ছি নীচের ঘটনা গুলোঃ
- এক ইভটিজারকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় আহত হন পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টর। তার অবস্থা গুরুতর।
- সহায়ক পাঠ্যবইয়ের আড়ালে জনগণের কাছ থেকে এবারও প্রায় সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রকাশক চক্র। আর এ অর্থ লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে স্বয়ং সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
- যশোরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ সমন্বয়ে গঠিত 'ভাইয়া গ্রুপ' একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে। জেলা থেকে উপজেলা পর্যন্ত সকল প্রশাসনে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, টিআর, কাবিখা ও কাবিটা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীরা এবং এক উপজেলার চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ভাইয়া গ্রুপ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
- স্থানঃ বরিশালের গৌরনদী। ৫০ বছর বয়স্কা রওশান আরা বেগম পেটের পীড়ার আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের দ্বারস্থ হন চিকিৎসার জন্যে। ডাক্তার সমীর কুমার চাকলাদার রোগীকে নিজস্ব ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে পাঠান বিভিন্ন পরীক্ষার জন্যে। পরীক্ষার ফলাফলে বলা হয় রোগীর অবস্থা ভয়াবহ এবং তাৎক্ষনিক সার্জারির ব্যবস্থা না করলে ক্যান্সার অবধারিত। শেষ পর্যন্ত ১৪ হাজার টাকায় রফা হয় সার্জারির। ডাক্তারের পূর্বাভাস নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রুগীর পরিবার নতুন এক ল্যাবে টেস্ট করায়, এবং তাতেই বেরিয়ে আসে ডাক্তার চাকলাদারের আসল উদ্দেশ্য, ভয় দেখিয়েই রোগীদের পকেট খালি করা।
খন্ড খন্ড ছবি গুলো এক করলেই বেরিয়ে আসবে আমাদের আসল চেহারা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যদি প্রকাশ্য পেটানোর ঘোষনা দিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াতে পারেন, আমাদের ধরে নিতে হবে গলদ অন্য কোথাও। কোটি টাকার নির্বাচন পাহারা দেয়ার কাজে দৈনিক ২৫ টাকা খোরাকির পুলিশ (চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন), এমন একটা করুণ ও ভয়াবহ বাস্তবতা কেবল আমাদের মত ডিসফাংশনাল সমাজেই সম্ভব। ডাক্তার চাকলাদার আমাদের শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধি। রুগি নিতে উনি যা করেছেন তাতে গোটা সমাজের চেহারাটাই ফুটে উঠেছে কেবল। এক অর্থে দেশটার মূল চালিকা শক্তিই বোধহয় এই ফিয়ার ফ্যাক্টরে আক্রান্ত। প্রধানমন্ত্রী ভয় দেখান বিরোধী নেত্রীকে, বিরোধী নেত্রী ভয় দেখান সরকার প্রধান সহ গোটা প্রশাসনকে, ছাত্রদের ভয়ে ভীত দেশের ব্যবসা-বানিজ্য, মন্ত্রীদের ভয়ে তটস্থ সাংবাদিক, ডাক্তারের ভয়ে বিপন্ন রোগীর জীবন, ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজনীতির নষ্ট জরায়ুতে জন্ম নেয়া এসব পাপাচারের পুজা করার অপর নাম বাংলাদেশের রাজনীতি। এভাবে চলতে থাকলে ৩৯ বছর কেন, ৩৯ হাজার বছরেও আমাদের প্রাপ্তির খাতায় নতুন কিছু যোগ করা সম্ভব হবেনা।