৭ই নভেম্বর। আজ নাকি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। নামে সংহতি হলেও কেন জানি মনে হয় অনেক তারিখের মত এ তারিখটাও জাতিকে বিভক্ত করার একটা উপলক্ষ মাত্র। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের কাছে দিনটা যদি হয় কালো, বাকি অর্ধেকের কাছে তা সাদা। এমনটাই কথিত নভেম্বর বিপ্লবের গড় মূল্যায়ন । এভাবেই ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ৭ তারিখ। বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল বদলে দেয় ইতিহাসের প্রেক্ষাপট, বদলে দেয় এর ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা ও ধারাবাহিকতা, এবং সাথে বদলে দেয় এর মূল্যায়ন। কথিত নভেম্বর বিপ্লবও এর বাইরে নয়। সেনাছাউনিতে অভ্যুথানের ভরা যৌবন তখন। এক জেনারেল আরেক জেনারেলকে মারছে, ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলাচ্ছে এবং নিজেরাও মরছে মশা মাছির মত। খুনাখুনির এ ম্যারাথন হতে বিজয়ীর ডিপ্লোমা নিয়ে রাজনীতির দিগন্তে যে জেনারেলের আবির্ভাব হল তিনি আর কেউ নন সর্ব জনাব জিয়াউর রহমান। ৭৫’এর দিনগুলোকে যদি বিপ্লব আখ্যায়িত করা যায় তা হলে ৭ই নভেম্বর তার সফল সমাপ্তি হয়েছিল এমনটা বললে নিশ্চয় বাড়িয়ে বলা হবে। পরবর্তীতে ৭৫’এর বিজয়ীদের প্রায় সবাইকেই প্রাণ হারাতে হয়েছিল কথিত বিপ্লবের ধারাবাহিকতা হিসাবে। ব্যর্থ বিপ্লবের সংজ্ঞায় একে বলে প্রতিবিপ্লব। বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়ে ইতিহাসবিদ, সমাজবিদ অথবা মনোবিজ্ঞানীদের কেউ যদি সিরিয়াস গবেষণা করতে যান একটা জায়গায় সবাইকে এক হতে হবে, এ দেশ প্রতিবিপ্লবের দেশ। বিপ্লব ছাড়াও এখানে প্রতিবিপ্লব ঘটানো সম্ভব। মার্কসীয় দর্শনে এর বিশ্লেষণ নেই। হতে পারে কার্ল, ফ্রেডেরিক এবং ভ্লাদিমিরদের কেউ এমন অবিশ্বাস্য ফেনোমেনার কথা কল্পনা করতে পারেননি।
সব বিপ্লবেরই একটা উদ্দেশ্য থাকে, সাথে থাকে বিধেয়। মানবসভ্যতার যাত্রার সাথে বিপ্লবের যাত্রা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নিজেদের আমরা মানুষ হিসাবে দাবি করতে পারছি তাও বোধহয় বিভিন্ন বিপ্লবের ফসল। হোক তা রক্তাক্ত অথবা রক্তপাতহীন, যুগে যুগে বিপ্লবই উপহার দিয়েছে চে গুয়েভারা, ফিদেল কাষ্ট্রো, নেলসেন ম্যান্ডেলা অথবা লেনিনের মত ত্যাগী বিপ্লবীদের। বিচারের দাঁড়িপাল্লায় ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবকে দাড় করালে জাতি হিসাবে আমাদের প্রাপ্তি কি ছিল তার কোন নির্দলীয় বিশ্লেষণ আছে কিনা জানা নেই। তবে খোলা চোখে এ বিপ্লবের ফসল দেখতে গেলে আমাদের চোখে ভেসে উঠবে তারেক, ককো, ডিউক আর ইসকান্দারদের মত বিপ্লবীদের চেহারা। বুদ্ধি বিক্রেতাদের একাংশ বলে থাকেন ৭ই নভেম্বর খুনের ধারাবাহিকতায় পেরেক ঠুকে তাতে গোলাপের চাষাবাদ শুরু করেছিল। হতে পারে সত্য যদি তা জিয়া পরিবারের উত্থানকে গোলাপের উত্থানের সাথে তুলনা করার সুযোগ তৈরী করে থাকে। বাংলাদেশের বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না, যার প্রমান নভেম্বর বিপ্লবের আসল বেনিফিশিয়ারিদের অসম্মানজনক পলায়ন। ক্ষমতার অবৈধ দখল নিয়ে সেনাছাউনির খুনোখুনিকে যারা বিপ্লব বলেন তাদের বোধহয় বিপ্লবের বেসিক সংজ্ঞার উপর পড়াশুনা করার প্রয়োজন আছে।
৭ই নভেম্বরের বিপ্লবকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম। আমরা মনে হয় ভুলে গেছি এ দিনটা কেবল বাংলাদেশের সেনাছাউনির বিপ্লব দিবসই নয়। পৃথিবীর আরেক প্রান্তে এ দিনটাতে উদযাপিত হচ্ছে এমন এক বার্ষিকী যার হাত ধরে শুরু হয়েছিল মানব সভ্যতার নতুন যাত্রা। শ্রমের সাথে শ্রমজীবির দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রথম সমাধান দিয়েছিল এ দিনের ঘটনাবলী। ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে হলেও নতুন ক্যালেন্ডারের বিবেচনায় দিবসটা পালিত হয় ৭ই নভেম্বর। হ্যা, আমি অক্টোবরের বলশেভিক রেভ্যুলেশনের কথাই বলছি। আজ সেই দিন যেদিন মানব সভ্যতা নতুন করে সন্মান জানাতে বাধ্য হবে তাদের, যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং শোষিত মানুষের পক্ষে গর্জে উঠছিলেন। সময় ও প্রয়োজনীয়তার কাছে পরাজিত মনে হলেও নভেম্বর বিপ্লবের ফসল মানব জাতি আজীবন ভোগ করে যাবে। বিপ্লব এ জন্যেই বিপ্লব কারণ তা দেশ, জাতি এবং সভ্যতার হয়ে কাজ করে, কোন ব্যক্তি অথবা পরিবারের জন্যে নয়।