অর্থাৎ, ‘ অবৈধ পন্থায় দখলকৃত বাড়ি বাঁচাইবার নিমিত্তে হরতাল দিয়া জনগণের কষ্ট বাড়াইবার কোন অধিকার নাই খালেদা জিয়ার‘।
লেখার শুরুতে পাঠক ও ব্লগারদের কাছে একটা ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। দেশের রাজনীতিবিদ ও বিচারকদের নাম উচ্চারণের আগে-পিছে যারা ’মাননীয়া/মাননীয়’ শব্দের জপমালা পড়তে অভ্যস্ত তাদের কাছে আমার এ লেখা বেয়াদবি মনে হতে পারে। নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির এ অংশকে সন্মান শ্রদ্ধার আসনে বসাতে আমার গোড় আপত্তি। মহামারির মত জাতির স্বাস্থ্যে চেপে বসা লুটেরা ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে যারা নেত্রীত্ব দেন, লালন পালন করেন, যাদের বগলের উষ্ণতায় এর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, আর যাই হোক তারা সম্মানের পাত্র হতে পারেন না। অন্তত আমার কাছে। ব্যাক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে সন্মান জানিয়ে ফিরে যাচ্ছি লেখার আসল পর্বে।
ক্যাবল টিভির দৌরাত্ম্য শুরু হয়নি তখনও। বিটিভির একক ও নিরবচ্ছিন্ন রাজত্বে বাস করছে বাংলাদেশের জনগণ। সে সময়ের একটা জনপ্রিয় টিভি সিরিজের নাম ছিল ’কোথাও কেউ নেই’ (যদি ভুল না হয়ে থাকে)। কোথাও কেউ না থাকলে জনজীবনের সুবিধাগুলোর কিছুটা চিত্র দেখা গেছে এবারের কুরবানী ঈদে। খাঁ খাঁ করছে মনুষ্য ভারে নুয়ে পড়া ঢাকা শহর, ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেছে দুর্ঘটনা, রাতারাতি বিদায় নিয়েছে হত্যা, ঘুম, ছিনতাই, রাহাজানি সহ হাজার রকমের অপরাধ। নাড়ির টানে যাদের ঘরে ফিরতে হয়নি তারা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন ক্ষণিকের এ স্বস্তি। কোথাও কেউ নেই’এর সুবিধা শুধু নগর জীবনের জন্যে প্রযোজ্য এমনটা বললে নিশ্চয় কম বলা হবে, এর আওতায় আনা যায় আরও অনেক কিছু। এই যেমন খেলার মাঠ, রাজনীতির মাঠ, প্রেমের ময়দান, ইত্যাদি। কলেজ জীবনে ফুটবল ম্যাচ দেখতে প্রায়ই ঢাকা স্টেডিয়ামে যেতাম। আবাহনী ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যে খেলা ছিল সেদিন। কোন এক জটিল সমীকরণের কারণে আবাহনী দল মাঠে এলো না। আর তাতেই জ্বলে উঠল লীগ তালিকার নিম্ন সারীর দল দিলকুশা। ফাঁকা মাঠকে গোলের বন্যায় ভাসিয়ে ফিরে গেল বীরের বেশে।
কোথাও কেউ নেই’এর মোষ্ট প্রডাক্টিভ ক্ষেত্র হচ্ছে রাজনীতির মাঠ। কল্পনা করুন এমন একটা বাস্তবতা, কোথাও কেউ নেই এবং ক্ষমতার মসনদে বসে আছেন সিপাহসালার জেনারেল এরশাদ! রাজনীতির এই মজনু কি আরামেই না কাটিয়ে দিতে পারতেন আরও ৯টা বছর। কিন্তু হায়, এমনটা কখনো হয়না! দুদিন পর আবাহনীকে যেমন মাঠে ফিরতে হয় তেমনি ফিরতে হয় রাজনীতির বাকি খেলোয়াড়দেরও। কারণ এটাই তাদের রুটি-রুজি, বেচে থাকার একমাত্র মাধ্যম। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দূরের দেশ রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে গেলেন বাঘ সন্মেলনে যোগ দিতে। শিকারিদের হাত হতে কি করে বাঘ রক্ষা করা যায় তার সন্ধান পেতে সদলবলে হাজির হলেন পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এ শহরে। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার মন্ত্রণা নেবেন রাজনীতির হিংস্র বাঘ পুটিনের কাছ থেকে, চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই। তবে কলা বেচা ও রথ দেখার কায়দায় প্রধানমন্ত্রী আরও একটা কাজ সেরে নিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গে, পিএইচডি ডিগ্রী। আগের ডিগ্রী গুলোর সাথে নতুন এ ডিগ্রিটা যোগ করলে এর সংখ্যা দাড়াবে সাত। এ যাত্রায় ডিগ্রিটা ছিল মানবাধিকার উন্নয়নে ভুমিকা রাখার জন্যে। নভেম্বরের শেষ দিকে সেন্ট পিটার্সবার্গের আবহাওয়া খুব রুক্ষ্ম হয়ে যায়। প্রকৃতি হয়ে বিদায় নেয় এর ভালমানুষি রূপ। কনকনে শীত, হুল ফোটানো হাওয়া আর বিবর্ণ প্রকৃতির সাথে যোগ হয় সময় অসময়ের তুষারপাত। বৈরী প্রকৃতির লীলভূমিতে মানবাধিকার উন্নয়নের ডিগ্রী হাতে নিয়ে দেশীয় রাজনীতির উপর তিনি কিছু নসিহত করলেন যা আমার কাছে সুন্দর বনের বাঘ শিকার বন্ধে রাশিয়া যাত্রার মতই চমকপ্রদ মনে হয়েছে। দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের কায়দায় ফাঁকা মাঠে বেশ কটা উত্তর বিহীন গোল করলেন তিনি। বিরোধিতা করার মত কোথাও কেউ ছিল না, আর সংগী হিসাবে যাদের নিয়ে গেছেন তাদের কেউ কথা বললে এ হত মংগল গ্রহে তামাক চাষের মত।
এতদিন জানতাম একটা দেশের সরকার অথবা রাষ্ট্রপ্রধান বিদেশে গেলে গোটা দেশের প্রতিনিধি হিসাবেই যান, একটা বিশেষ দলের নয়। আমাদের এ প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে অস্বাভাবিক রকমের বিপরীত। এমনকি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের দাড়িয়ে সগৌরবে বলে যান নিজ দলের সাফল্য আর বিরোধী দলের ’কদর্য্যের’ কথা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হরতাল করার অধিকার নিয়ে কথা বললেন। উনার কথার সাথে নিকট অতীতের বাস্তবতা তুলনা করলে আমাদের ধরে নিয়ে হবে এ দেশে হরতাল করার অধিকারও সংরক্ষিত আছে প্রধানমন্ত্রীর নিজ দলের জন্যে। জনগণের অসুবিধার জন্যে তিনি উৎকণ্ঠিত, আর তাই বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন হরতাল না দেয়ার জন্যে। রাশিয়ার রাজনীতি এবং এর জনগণও অনেকটা আমাদের মত। মিথ্যাচার আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আমাদের মত সেখানেও ডালভাত। এমন একটা দেশে বসে এমন নির্জলা মিথ্যাচার একেবারেই বেমানান মনে হয়নি। কোথাও কেউ না থাকলে এসব মিথ্যাচার সহজেই পার পেয়ে যায়। কিন্তু আমরা যারা রাশিয়া হতে হাজার মাইল দুরে আছি তাদের সবাই এখনো অলসাইমার রোগে আক্রান্ত হয়েছি এমনটা মনে করে থাকলে প্রধানমন্ত্রী ভুল করে থাকবেন। আমরা অনেক কিছুই ভুলিনি। ভুলিনি প্রধানমন্ত্রীর হরতাল ম্যারাথন, এর নৈরাজ্য এবং আমজনতার সীমাহীন দুর্ভোগ।
হরতালে হরতালে অবশ হয়ে গেছে দেশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। জনজীবন বিপর্যস্ত। সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের কাছে জিম্মি হয়ে আছে গোটা জাতি। চাল, ডাল, তেল আর নুনের বাজারে জ্বলছে পুরান ঢাকার আগুন। জ্বলছে চারদিক। জ্বলছে আর ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে আমজনতার অক্ষমতার অন্তর। মাকে ঢাকায় নিতে হবে জরুরী প্রয়োজনে। কিডনী রোগ মুঠোর বাইরে চলে গেছে। ডাক্তার দেখাতে রাজধানী যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এমনটাই রায় দিল স্থানীয় ডাক্তার। কিন্তু যাব কোন পথে? চারদিকে হায়েনাদের হিংস্র থাবা। লাঠি সোঠা আর বন্দুকের নল ওৎ পেতে আছে ঘাটে ঘাটে। মার ভালোমন্দের কাছে হার মানার মানুষ নই আমরা, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঝড় ঝাপটা উপেক্ষা করে রওয়ানা দিতে হবে। বেশিদূর যেতে হয়নি। শহর হতে বের হওয়ার মুখেই দেখা মিলল ওদের। হাসিনার সেনাপতিত্বে বঙ্গবন্ধু সৈনিকের দল ওরা। সেনাপতির নির্দেশ, কোথাও কোন গাড়ি ঘোড়া চলতে পারবে না। পিপিলিকার দল শকুনের মত ঝাপিয়ে পরল আমাদের ভিনটেজ (লক্কর ঝক্কর) গাড়িটার উপর। পরিচিত অনেক মুখের দেখা পেলাম গাড়ির ভেতর হতে। একসাথে পড়েছি অনেকের সাথে, অনেকে ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের সহযোগী, আবার শিক্ষক হিসাবে সন্মান করেছি অনেককে। কিন্তু এ মুহূর্তে সবাইকে মনে হল দানবীয় শক্তিধর এক একটা অসুর। ভাংচুর আর খুনের নেশায় জ্বলজ্বল করছিল সবার চোখ। এ শক্তির কাছে সব ধরণের মানবতা পরাজিত হল। মাকে জীবন মৃত্যুর অনিশ্চয়তায় ফেলে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। রাত নামতে এদের অনেকেই দেখতে এল মাকে। সমবেদনা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল কৃতকর্মের জন্যে। জানাল তাদের হাত পা বাধা। দলীয় পদ ধরে রাখতে গাড়ি ঘোড়া ভেংগে হরতাল সফল করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নাকি খোলা নেই তাদের সামনে। এমনটাই নাকি হাই কমান্ডের নির্দেশ আর নেত্রীর আদেশ। গভীর রাতে আবারও রওয়ানা দিলাম। দেড় ঘন্টার পথ ছয় ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌছাতে ভোর হয়ে গেল। হিংস্র হায়েনাদের থাবা এড়িয়ে ছয় ঘন্টার এ অনিশ্চিত যাত্রা নিয়ে লেখা যাবে বিশাল এক কাহিনী, যাকে উপন্যাস বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। হায়েনাদের নেত্রী যখন বিদেশে বসে জনগণের দুর্ভোগ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে, অক্ষমতার সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীর কোন কিছুই আপন মার চাইতে বড় নয়, হোক তা জন্মভূমি আর তার রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তির পেশাদারী গণতন্ত্র। মা বেচে নেই কিন্তু হরতালের কাছে জিম্মি ভীত সন্ত্রস্ত মার চেহারা যতদিন চোখের সামনে ভাসবে ততদিন হরতালের পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে নেত্রীদের আহাজারী বেশ্যাদের খদ্দের শিকারের মন্ত্র হিসাবেই গণ্য করে যাব। শেখ হাসিনাও এর ব্যতিক্রম নন।