দেশজুড়ে ইউনুসোফোবিয়ার যে সুনামী বয়ে গেল তাতে জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। বিশেষ করে ব্লগ দুনিয়ার অংশগ্রহন। এ যাত্রায় ব্লগারদের মত প্রকাশের ভাষা ও তাদের চিন্তাশক্তির গভীরতা অতীতের সবকিছু ছাড়িয়ে এমন এক উচ্চতায় ঠাঁই নিয়েছে যা কেবল থাই অথবা ইন্দোনেশিয়ার সুনামির সাথেই তুলনা করা চলে। আক্ষরিক অর্থেই সুনামি বয়ে গেছে দেশজুড়ে। নরওয়ের অসলোতে সৃষ্ট বানিজ্যিক ঢেউ বাংলাদেশে আছড়ে পরল ব্যক্তি চরিত্রের জলোচ্ছ্বাস হয়ে। আর এই জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিল ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস নামের একজন বাংলাদেশির প্রাণ। তবে রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে এটা ডক্টর মোঃ ইউনুসের প্রথম এবং একমাত্র মৃত্যু ছিলনা। এর আগেও একাধিকবার মরতে হয়েছে বেচারাকে।
শুরুটা ভালই ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপকের জন্যে। জোবরার গ্রামের অখ্যাত সুফিয়া না আমিনা নামের কাউকে কিছু টাকা ধার দিয়ে তা ফিরিয়ে নেন লাভ পকেটস্থ করে। বলা হয় এভাবেই নাকি জন্ম নিয়েছিল গ্রামীন দুনিয়ার। জোবরার সাফল্য একসময় বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে স্থান করে নেয় পশ্চিমা দুনিয়ার দেশে দেশে। রবীন্দ্র নাথ আর অমর্ত্য সেনের বাইরে বাংলাদেশি গরুখোর মুসলমানদের কেউ নোবেল পুরস্কার পেতে পারে মংগল প্রদীপ জ্বলানো বুদ্ধিজীবীরা বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। ডক্টর ইউনুস ছিলেন সে হতভাগা যার কপালে জুটল নোবেল পুরস্কারের বিতর্কিত সন্মান। একজন অর্থনীতিবিদ কেন শান্তিতে নোবেল পায় এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পণ্ডিতদের অনেকে বোঝালেন সফল অর্থনীতিই জনশান্তির পূর্বশর্ত। যেহেতু শান্তি ও অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক তাই কোনটার উপর নোবেল পেল তার মৌলিক কোন তফাৎ নেই। ডক্টর ইউনুসের নোবেল প্রাপ্তিতে মানুষ ভাসল খুশিতে আর স্তূতির সমুদ্রে সাতার কাটল দেশের মিডিয়া। সবকিছু চলল সেভাবে যেমনটা আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যাটার শুরু অন্য জায়গায়। দেশের রাজনীতির ভাগ্যাকাশে ততদিনে দেখা দিয়েছে কালো মেঘের ঘনঘটা। ১/১১ এল ঝড়ের মত। আর এই ঝড় উড়িয়ে নিল রাষ্ট্র ও সরকার যন্ত্রের সাথে জড়িত আমলা ও রাজনীতিবিদের পরিধেয় বস্ত্র। জাতি অবাক হয়ে দেখল লালু ভুলু আর টুলুদের নগ্ন শরীর। ওসমান গনি আর বাকের ভাইদের আলৌকিক উত্থানের সাথে যোগ হল সাজেদা চৌধুরীর মত জাত রাজনীতিবিদ আর শাজাহান সিরাজের মত বাংলাদেশের আর্কিটেক্টদের নাম। এই দুইয়ের কম্বিনেশন বাংলাদেশকে ইতিমধ্যে এনে দিয়েছিল দুর্নীতিতে হ্যাটট্রিক শিরোপা। সেনাছাউনির সহায়তায় নতুন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের বানী শোনাল আমাদের। জাতি ভাবল পরিবর্তন এলো বলে! দেশের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতিতে যে পচন তা বদলাতে প্রয়োজন ছিল নতুন মানুষের, এমনটাই বুঝালেন সেনা সমর্থিত ইন্টেরিম সরকার। মাইনাস টু ফর্মুলা প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে উঠে এল ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের নাম। ডক্টর সাহেবও ভাবলেন নোবেল জোয়ারে জাতি যেভাবে তাকে অবগাহন করিয়েছে রাজনীতির মাঠেও বইবে একই জোয়ার। বিশাল আয়োজনে রাজনীতিতে পদার্পণের ঘোষনা দিলেন জোবরা গ্রামের ইউনুস মাষ্টার। আর এখানেই জন্ম নিল নতুন এক ইউনুসের, সুদখোর ইউনুস।
সুদ শব্দটার একটা আত্মঘাতী গন্ধ আছে। এর সাথে ধর্মীয় লোবান মেশাতে পারলে পটাশিয়াম সায়ানাইডের চাইতেও শক্তিশালী মৃত্যুবাণ তৈরী সম্ভব। হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়নশীপের খেলোয়াড়রা তাই করলেন এবং তা ব্যবহার করলেন ডক্টর ইউনুসের বিরুদ্ধে। মৃত্যু হল এই ডক্টরের। নোবেল লাউরিয়ট হতে রাতারাতি মানুষটাকে নিক্ষেপ করা হল সাফল্যের আস্তাকুঁড়ে। আখ্যায়িত করা হল রক্ত চোষা ভ্যাম্পায়ার হিসাবে। সুদের একটা ইংরেজী শব্দ আছে যাকে বলা হয় ইন্টারেস্ট। বিশ্বায়নের পৃথিবীতে টিকে থাকতে চাইলে এই ইন্টারেস্টের প্রয়োজনীয়তা এখন অক্সিজেনের মত। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের ধমনীতে প্রবাহিত হয় ইন্টারেষ্টের লাল নীল রক্ত। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, ইউ এস এইড, সৌদি তহবিল, কুয়েতি ফান্ড, এ ধরণের গোটা বিশেক ইন্টারেস্টখোর প্রতিষ্ঠানের আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে আছে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের সবগুলো দেশের শরীর। এরা ইন্টারেস্টে অর্থ খাটায়, আর আমরা তা খাটতে দেই, যাকে সুদ আখ্যায়িত করতে আমরা কোথায় যেন লজ্জা। কারণ এই টাকায়ই যে জন্ম নেয় একজন তারেক জিয়া, খাম্বা মামুন আর মোচ ওয়ালা শেখ সেলিম। এই টাকার উপরই রচিত হয় মইনুল হোসেন রোড উপাখ্যান, আর এই টাকাই সুদূর ভার্জিনিয়া ও আয়েসের লীলাভূমি ফ্লোরিডায় জন্ম হয় সম্পদের মালিক বড় বড় বিজ্ঞানীদের।
সনাতনী ব্যাংকিং ব্যবস্থার পতন মাইটি আমেরিকার জন্যে বয়ে এনেছে শতাব্দীর ভয়াবহ মন্দা। ব্যাংক অব আমেরিকা আর সিটি ব্যাংকের মত বিলিয়ন ডলারের জায়ান্ট ব্যাংক গুলো জীবন্মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সন্ধান করছে নতুন পদ্ধতির। রুগ্ন লোন আর অনাদায়ী সুদের দফারফা করতে গিয়ে ক্রোক দিচ্ছে আমেরিকানদের বাড়িঘর। বাস্তুহারা আর চাকরিহারা আমেরিকানদের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এমন একটা প্রেক্ষাপটে জোবরা গ্রামের ধারণা পশ্চিমা দুনিয়ার নজড় কাড়বে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ ওরা নতুনের পূজারী। সভ্যতার বিবর্তনে এদের অবদানের জন্যেই আজকের পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে নেট দুনিয়ার মত হাজারও আবিষ্কার। দেশের ঘরে ঘরে যখন ইউনুসকে সমাহিত করার অলআউট উৎসব, পৃথিবীর অন্য কোথাও তখন বইছে ভিন্ন স্রোত। মাত্র গতকাল নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিও এম হেলথ তাদের বোর্ডের সদস্য বানিয়েছে ডক্টর ইউনুসকে। রহস্যটা কোথায়? তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তথ্যের ভারসাম্য ধরে রাখতে কি ব্যর্থ হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়া? আমরা যাদের চোর বলছি সন্মান দিয়ে ওরা লুফে নিচ্ছে তাদের, আর ওদের দৃষ্টিতে যারা চোর তাদের আমরা বসাচ্ছি সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে। আয়রনী হচ্ছে, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র হিসাবে ওরা সফল, আর আমরা দাড়িয়ে আছি ব্যর্থতার ক্রসরোডে।
ক্ষুদ্র ঋণের জন্যে দেয়া নরওয়ে সরকারের অর্থ গ্রামীন ব্যাংক তার সিস্টার সংগঠনে ট্রান্সফার করেছে ব্যবসায়িক স্বার্থে। ঋণদাতা বলছে এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অভিযোগ মানেই ডক্টর ইউনুস ও তার গ্রামীন সাম্রাজ্যকে দুর্নীতির তকমা লাগানো নয়, এমন একটা নিশ্চয়তাও দিয়েছে অভিযোগকারী। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। বাধ ভাংগা জোয়ারের মত ভেসে গেল অভিযোগের আসল উদ্দেশ্য। পৈশাচিক উন্মত্ততায় বাংলাদেশিরা নেচে উঠল তাদের সন্তান ইউনুসকে কবর দিতে। ব্লগীয় দুনিয়া কেঁপে উঠল ইউনুস নিন্দায়। ব্লগীয় ভাষার সহজ বাংলা করলে এমনটাই প্রতীয়মান হবে যেন ডক্টর ইউনুস শত শত কোটি টাকার লোন লোপাট করে দিয়ে ভূমধ্যসাগরের কোন বিলাসবহুল দ্বীপে সুরম্য প্রাসাদ বানিয়েছেন। আসলেই কি তাই?
নতুন কিছুর সন্ধান না করে জীবন কাটিয়ে দেয়া খুব সহজ। চাইলে ডক্টর ইউনুসও তা পারতেন। গ্রামীন সাম্রাজ্য তৈরী না হলে হয়ত কোন এক নেত্রীর নিবেদিত পূজারী হয়ে নাম লেখাতেন লাল, নীল অথবা সাদা ক্যাম্পে। আর দশটা অধ্যাপকের মতই হয়ত বগলে ফাইল নিয়ে প্রমোশনের আশায় ঘুরে বেড়াতেন রাজনীতির পেছনে। তিনি তা করেন নি। আর তা করেন নি বলেই বিশ্ব মুখ দেখেছে মাইক্রো ক্রেডিট এবং সামাজিক ব্যবসার মত নতুন ধ্যান ধারণার। অনেকের অভিযোগ, বাংলাদেশে এসব তো কাজ করছেই না, বরং সর্ব শান্ত করছে দেশের দরিদ্র জনসমষ্টিকে। হতে পারে তা সত্য। গ্রামীন ব্যাংক দাতব্য চিকিৎসালয় নয় যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস এমন কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলেও জানা নেই। দশ টাকা কেজি চাল আর বিনামূল্যে সার বিতরনের মত ভাওতাবাজীর প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি এ রাস্তায় আসেন নি। উনার ব্যবসা সুদের ব্যবসা, এবং এ ব্যবসায় জড়িত হওয়ার জন্যে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষকে নীল চাষের মত বাধ্য করা হয় বলেও জানা নেই। যারা চড়া সুদ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাদের উচিৎ গ্রামগঞ্জের গরীব মহিলারা কেন গ্রামীন ব্যাংকের মত সুদখোরদের হাতে ধরা দেয় তার কারণ খুঁজে বের করা। দেশের আবিষ্কার মাইক্রো ক্রেডিট বিদেশে কাজ করলেও দেশে কাজ করবে না, কারণ জোবরা গ্রামে শুধু সুফিয়া আর আমিনাদেরই বাস নয়, এখানে বাস করে পশুলীগ, পশুদল আর পশুশিবিরের মত শত শত হিংস্র পশুর দল।