মোশারেফা মিশু নামটার সাথে আমরা বোধহয় কমবেশি সবাই পরিচিত। অস্থির গার্মেন্টস শিল্পে নতুন কোন হাঙ্গামা হলেই নামটা সামনে চলে আসে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় তাদের কথা বিশ্বাস করলে আমাদের ধরে নিতে হয় বিশাল সাম্রাজ্যের পোশাক শিল্পে যে নৈরাজ্য তার অন্যতম হোতা ও যোগানদাতা এই মোশারেফা। এরশাদ আমলে এই মহিলার বিরুদ্ধে প্রচারণা এতটাই প্রবল ছিল আমি নিজেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম মিশু আসলেই একজন ভারতীয় চর। দেশের প্রায় প্রতিটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি এখন অস্থির। সন্দেহজনক আগুন ও শ্রমিকদের ধ্বংসলীলার সমন্বয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম এই খাত এখন ’টু বি অর নট টু বি’ প্রশ্নের মুখোমুখি। গেল সপ্তাহের ভাঙচুরের কারণ দেখিয়ে প্রতিবারের মত এবারও গ্রেফতার করা হল মিশুকে। যথারীতি রিমান্ডে নেয়া হল। গণতন্ত্র, দেশপ্রেম আর মুক্তিয়ুদ্ধের চেতনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকারের আমলেও আসামীকে রিমান্ডে নিতে হয় এবং তার উপর প্রয়োগ করতে হয় হিংস্র, বর্বর ও পশুশুলভ নির্যাতন। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী সহ আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রায় সবাটাই নিয়ন্ত্রণ করে মহিলারা সে দেশে একজন মহিলাকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ পৈশাচিক উন্মত্ততায় মেতে উঠবে তা কোন মতেই মেনে নেয়া যায়না
১৯শে ডিসেম্বর মোশারেফা মিশুকে যখন আদালতে হাজির করা হয় পায়ের উপর ভর করে সে দাঁড়াতে পারছিল না। প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে কথা বলা দুরে থাক কারও দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছিল না। পুলিশ আর আইনজীবী ছাড়া আদালতে আর কারও ঢুকার অনুমতি ছিলনা। এজলাস হতে বের হয়ে মিশুর আইনজীবী তার মক্কেলের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যে বর্ণনা দিলেন তাতে ফুটে উঠে কতটা নির্মম ছিল পুলিশি নির্যাতন। ‘প্রচুর হাঁপাচ্ছেন তিনি। চোখ দিয়ে পানি পরছে। হাত ধরলাম, জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন? কোনরকমে মিশু বললেন, ‘আমি আর রিমান্ড সহ্য করতে পারব না‘। ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানালেন ঐ দিন নরসিংদীতে ছিলেন। ১২ তারিখ রাতে ঢাকায় এসেছিলেন, ১৩ তারিখ রাত সোয়া একটায় ১৫ জন পুলিশ শয়ণকক্ষে ঢুকে তাকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনে। রাতভর চলে নির্যাতন। পুলিশ জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চাইছে ধ্বংসলীলার পেছনে জামায়াত নেতাদের মদদ ছিল। আদালতের শুনানি ছিল সংক্ষিপ্ত। পুলিশ ১৫ দিনের রিমান্ড চাইছে। ’মহামান্য’ আদালত মিশুর আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শোনার প্রয়োজন বোধ না করে পুলিশকে আরও ২ দিন নির্যাতন করার অনুমতি দেয়। হাঁটার ক্ষমতা ছিলনা ফিরতি পথে। আবারও টেনেহিঁচড়ে উঠানো হল গাড়িতে। পুলিশ বলল সব ঠিক আছে, নির্যাতন দুরে থাক আচড় পর্যন্ত দেয়া হয়নি গায়ে। গাড়িতে উঠেই চেতনা হারিয়ে ফেললেন তিনি। এরপর শুরু হল আসল খেলা। এক হাসপাতাল হতে অন্য হাসপাতালে নেয়া হল জীবন বাঁচানোর তাগাদায়। মোশারেফা মিশু এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
তৈরী পোশাক বাজারজাত করার প্রতিযোগীতায় বাংলাদেশের সাথে মার খাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ। বাস্তবতাটা একটু অবাক করার মত। পোশাক শিল্পের জন্যে কাঁচামাল ও ক্যাপিটল মেশিনারিজ সহ সবকিছুই আমাদের আমদানি করতে হয়। অথচ পাশাপাশি এমন অনেক দেশ আছে যাদের আছে তুলা, সুতা ও হেভি ইন্ডাস্ট্রির শক্ত ভিত্তি। তারাও কুলিয়ে উঠছে না আমাদের সাথে। কারণটা কি? সবাটাই কি আমাদের সুব্যবস্থাপনার ফসল? ফুটবলার সালাম মুর্শেদী, গাফফার আর টিভি ব্যক্তিত্ব আনিস সাহেবেদের ব্যবস্থাপনায় কি ডিগ্রী আর কতটা অভিজ্ঞতা আছে তার কোন দলিল আমাদের হাতে নেই, কিন্তু পোশাক ব্যবসায় এদের আসল সাফল্য যে দেশের সস্তা শ্রম তা বুঝতে কোন ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। পেটে ভাতে খেটে খাওয়া বুয়াদের জন্যে মাসে ৫০০/৬০০ টাকা একসময় ছিল বিরাট অংকের টাকা। এদের হাত ধরেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উত্থান। এ ফাঁকে সময় গড়িয়ে গেছে অনেক, নদীর পানি সমুদ্রে ঠাঁই নিয়েছে। বাসাবাড়ির মালেকানদের অত্যাচার হতে বাঁচার প্রাথমিক চাহিদা মিটে গেছে ৫০০/৬০০ টাকার বুয়াদের। তারা এখন প্রফেশনাল। চাল, ডাল, তেল আর নুনের মত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে রাজনৈতিক ব্যর্থতার বেড়াজালে। মুর্শেদী সাহেবের ফুটবল ক্যারিয়ার যেমন দিলকুশা ক্লাবের পেটে ভাতে আর দূরপাল্লার ক্ষেপ খেলা দিয়ে শুরু হয়েছিল, উনার কারখানার শ্রমিকদের যাত্রাটাও শুরু হয়েছিল একই ভাবে। দিলকুশা হয়ে মোহামেডানের লাখ টাকা পর্যন্ত মুর্শেদী সাহেবদের দক্ষতা বাড়াতে হয়েছে, দর্শকদের মন জয় করতে হয়েছে। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদেরও দিলকুশা হতে মোহামেডানে যাওয়ার সময় হয়েছে। কারণ তারাও এখন তাদের কাজে দক্ষ। এই দক্ষতার স্বীকৃতি ও মূল্য পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সবটাই যদি গড়ে উঠে থাকে সস্তা শ্রম শোষণের উপর তাহলে এ শিল্পের পতন অনিবার্য। এ শিল্পের ধ্বংসাত্মক ঘটনায় বিদেশী হাত আর জামাতী কানেকশন সন্ধান করে আসল সমস্যা ধামাচাপা দেয়া হবে আত্মঘাতী।
পুলিশি রিমান্ড দিয়ে একজন মিশুকে বিদায় করা সম্ভব হলেও শত শত মিশু জন্ম নিতে খুব একটা সময় লাগে না এসব ক্ষেত্রে। শাসন আর শোষণের ইতিহাস না জেনে যারা শিল্প বাণিজ্যে আসেন তাদের উচিৎ হবে শ্রমের সাথে শ্রমজীবীর চিরন্তন দন্ধ নিয়ে বেসিক কিছু পড়াশোনা করা।