বাস্তবে, কল্পনায় এমনকি এনিমেশনে ছবি বানিয়ে কেউ কেউ জুতা মারছে গোলাম আযমের দিকে। এক মন্ত্রী ঘোষনা দিয়েছেন স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গ্রেফতার করা হবে জামায়েত-এ-ইসলামের প্রাক্তন আমিরকে। সরকারের মনোভাবে এটা পরিষ্কার লম্বা সময়ের জন্যে জেলই হতে যাচ্ছে আমিরের ঠিকানা। বাংলায় একটা কথা আছে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। ৭১’এর পাপ গোলাম আযমের জন্যে মনে হয় বাপ হয়ে কড়া নাড়ছে বাড়ির আঙিনায়। এ নিয়ে উচ্ছ্বাসের মাত্রাটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় একটু বেশি। আর হবেই না বা কেন? নতুন প্রজন্মের কাছে ৭১’এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এ মুহূর্তে বেঁচে থাকার অক্সিজেনের মত। বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় এসেছে বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এ হতে পিছিয়ে আসার উপায় নেই সরকারের, এক কথায় পালানোর সব দরজা এখন বন্ধ। দাবি পূরণের গন্ধ পল্লবিত হওয়ায় ব্লগীয় পরিবেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে অনেকটা কুরবানী ঈদের মত। সরকার গোলাম আযমের মত বেশ কিছু গৃহপালিত গরুকে তৈরী করছে কোরবানীর জন্যে। এক ধরণের বর্বরতা থাকলেও ধর্মীয় প্রয়োজনে কুরবানী একটি সর্বস্বীকৃত সার্বজনীন সামাজিক উৎসব। এই অর্থে গোলাম আযমের কুরবানীও হবে আমাদের স্বাধীনতার প্রয়োজনে গৌরবোজ্জ্বল একটি কুরবানী।
শেখ মুজিবকে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিন আমি ছিলাম বিদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের নিজ হাতে স্বাক্ষরিত একটা চিঠি নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলাম দেশের প্রতিনিধিত্ব করবো বলে। এই লোকটাকে যেদিন মেরে ফেলা হল আশা ছিল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শোকের মাতম হবে, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হবে গোটা দেশ। তথ্যপ্রযুক্তির রাজত্ব শুরু হতে তখনও অনেক দেরি। যোগাযোগ বলতে চিঠিপত্র আদান প্রদানই একমাত্র ভরসা । সে চিঠিই যখন পেলাম আশা ছিল তাতে থাকবে আপনজন হারানোর শোক, থাকবে খুনিদের শাস্তির দাবি। কিন্তু এসবের বদলে তাতে ছিল স্বস্তির কথা, দেশ হতে কথিত আজরাইল বিদায় নেয়ার কথা। ঐ সময়ের তরুণ নেতাদের দু’একজন, আজকে যারা যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে উপরের আসমান মাটিতে নামিয়ে আনছে, তাদের চিঠিতেই ছিল কথিত নতুন স্বাধীনতার কথা। শুনেছি এই নেতারাই নাকি খুনিদের ফাঁসি কার্যকর করার দিন আনন্দ করেছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকর আদায় করেছে। গোলাম আযমের দরবারেও শুনেছি আওয়ামী লীগ তার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে পাঠিয়েছিল ভোটের দোয়া চাইতে। রাজনৈতিক সমীকরণে বাংলাদেশে অনেক কিছুই বদলে যায়। শত্রু হয় মিত্র আর মিত্রকে ঝুলানো হয় ফাঁসি কাষ্ঠে। একটা বাস্তবতা হজম করতে আমার একটু কষ্ট হয়, ৭১’এর খুনিরা বছরের পর বছর খোলা আকাশের নীচে বিচরণ করেছে, রাজপথের রাজনীতি করেছে, পতাকা উড়িয়ে মন্ত্রিত্ব করেছে, নিত্যপ্রয়োজীনয় দ্রব্যাদি কিনতে কাঁচা বাজারে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পাহাড় সমান ঘৃণা নিয়ে যাদের বেচে থাকতে কষ্ট হচ্ছে (অন্তত কথা ও লেখালেখিতে তাই মনে হয়েছে) তাদের একজনও কেন খুনিদের বিরুদ্ধে শারীরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। বাংলাদেশের অলিগলিতে খুন হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে দুনিয়া হতে বিদায় করা হচ্ছে সহিছেলামতে। আমাদের বিচার ব্যবস্থা এখন কথিত মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির দখলে। গোলাম আযমদের মত কুখ্যাত রাজাকারদের শারীরিকভাবে নির্মূল করলে বিচার ব্যবস্থার অবস্থান কি হবে তা নির্ণয় করতে আশাকরি উকিল ব্যারিস্টার হওয়ার দরকার পরবে না। কথা দিয়ে চিড়া ভেজানো সব সময় সম্ভব হয়না, তার জন্যে পানিরও দরকার হয় মাঝে মধ্যে।
১০ টাকা কেজির চাউল ৪০ টাকা আর পেঁয়াজের কেজি ৯০ টাকা হওয়ার আসল কারণ যদি এই যুদ্ধাপরাধীরা হয়ে থাকে নির্মূল করা হোক এদের। এদের গায়ে এমনিতেই ৭১’এর রক্ত, তার উপর দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত থেমে আছে এদের জন্যে। শেয়ালের দশ বাচ্চা দেখানোর মত গোটা শতেক অপরাধী দেখিয়ে একটা দল রাজনীতি করছে। নিজেদের অন্যায়, অপরাধ আর পাহাড় সমান ব্যর্থতাকে আড়াল করছে যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে। যে যুব সমাজের জন্যে জাতি এক সময় গর্ব করতো তাদের নেশাগ্রস্ত বানানো হয়েছে বিচারের নেশায়। সমাজের পরতে পরতে অবক্ষয়ের যে বিষাক্ত পূজ তা লতায় পাতায় বেড়ে উঠছে রাজনীতির জরায়ুতে। আর এই রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি এখন বিচার। বিচারে বিচারে সয়লাব হয়ে গেছে গোটা দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে দুর্নীতির প্রথম স্থানে আছে আমাদের বিচার ব্যবস্থা। এমন একটা বিচার ব্যবস্থাকে দিয়ে সংশোধন করা হচ্ছে দেশের শাসনতন্ত্র পর্যন্ত। চরিত্রহীন বিচার ব্যবস্থার ঘাড়ে বন্দুক রেখে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে বিভক্তির।
মামলা রজ্জু ও আসামীদের আইনের আওতায় আনতেই চলে গেল দুই বছর। বিচার কাজ সমাপ্তি পূর্বক শাস্তি পর্ব বাস্তবায়ন করতে কতটা সময়ের প্রয়োজন তার হিসাব মেলানো খুব একটা সহজ মনে হচ্ছে না। কিন্তু এ ফাঁকে আবারও আসবেন নির্বাচন এবং ১০ টাকা কেজি চালের প্রতিশ্রুতি দেয়া সরকার আবারও রায় চাইবে যুদ্ধাপরাধী বিচারের। চাইলে আজীবন টানা যাবে যুদ্ধাপরাধী বিচার পর্ব। কিন্তু ততদিন বাচবে কি ৭১’এর নরখাদকের দল? জাতির দায়বদ্ধতা মেটানোর জন্যে প্রয়োজনে এদের সামরিক ট্রাইবুনালে বিচার করা হউক, ফাঁসিতে ঝুলানো হউক। বিচারের মূলা ঝুলিয়ে ভোট বাণিজ্যের এখানেই ইতি হোক। জাতির ভাগ্য নিয়ে ইঁদুর বেড়াল খেলার সমাপ্তি প্রয়োজন। তার তাতে যদি গোলাম আযমদের অবৈধ বিচারে ফাঁসি দিতে হয় তাতে কেউ দু'ফোটা চোখের পানি ফেলবে বলে মনে হয়না।