বিশেষ করে কুরবানি ঈদের হুজুর-কাম-কসাইদের কার্যক্রম কাছ হতে লক্ষ্য করলে একটা বাস্তবতা চোখে পরতে বাধ্য, আর তা হল তাদের ক্ষিপ্রতা। দক্ষতা যাই থাকুক খোলা তরবারি হাতে ওদের চলাফেরায় থাকে উল্কার গতি। দৃশ্যটা গ্রামেগঞ্জেই দেখা যায় বেশি, পরনে রক্তাক্ত পাঞ্জাবী, কোমরে গামছার নেংটি আর হাতে ধারলো ছুরি নিয়ে এক গরু হতে আরেক গরুতে দৌড়াচ্ছে ওরা। প্রতিদ্বন্ধি হুজুর আসার আগে যতটা সম্ভব বেশি গরু ধরাশায়ী করাই এহেন ক্ষিপ্রতার আসল উদ্দেশ্য। বেশি গরু মানে বেশি মাংস এবং সাথে উপরি কিছু টাকা। গোটা কুরবানী পর্বটাতে যতটা না থাকে ধর্মীয় ভাবাবেগ তার চেয়ে বেশি থাকে রক্তের দ্যুতি ছড়িয়ে দ্রুত কিছু কামানো। এক অর্থে মেনে নেয়া যায় হুজুরদের এই রক্তাক্ত অভিযান। গ্রাম-গঞ্জের মসজিদ মাদ্রাসায় কর্মরত হুজুর এবং মুয়াজ্জিনদের আর্থিক অবস্থা ব্যাপক অর্থেই খারাপ। নাম মাত্র মাসিক বেতনের সাথে বন্দোবস্ত থাকে দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে তিন বেলা তিন মুঠো আহারের সংস্থান। তার জন্যে অবশ্য তাকে ধর্ণা দিতে হয় বিভিন্ন দুয়ারে। ধর্মীয় ভাবাবেগে এমন একটা সামাজিক অবস্থার চিত্র বিনা কারণে মাথায় আসেনি। আসছি সে প্রসংগে।
আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারকগণ অনেকটা কসাই কায়দায় নাঙা তলোয়ার হাতে পিছু নিয়েছেন নন-আওয়ামী শাসনামলের বিরুদ্ধে। শুরুটা শাসনতন্ত্রের সংশোধনী দিয়ে। ৭৫এর পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া যারাই ক্ষমতায় ছিল সবাই এখন আইনের চোখে অপরাধী। শুধু জীবিত নয় মৃত শাসকদেরও কবর হতে উঠিয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করানোর প্রতিযোগীতায় নেমেছেন ’মহামান্য’ বিচারকগণ। রাজনীতির মারপ্যাঁচে যাদের অভিজ্ঞতা নেই তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য, দেশে কি এমন বিপ্লব ঘটে গেল যার কারণে ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি কায়দায় বিচারকরাও নেমে গেল বিচারবাজিতে? জাতিকে গোলানোর চেষ্টা চলছে সবকিছুই নাকি হচ্ছে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার দায়বদ্ধতা হতে। কথা গুলো শুনতে একদম খারাপ শোনায় না। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, দুই বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক জোর জবরদস্তির সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল এই একই আদালত হতে বর্তমান আওয়ামী নেতাদের ইস্যু করা হয়েছিল নাজিমউদ্দিন রোডের ভিসা। অনেকে বলবেন সেনাসমর্থিত সরকার বন্দুকের নলের মুখে রায় দিতে বাধ্য করেছিল। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তা সত্য। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে ’মহামান্য’ বিচারকগণও বন্দুকের নলের মুখে কুপোকাত হয়ে থাকেন। লজিক্যালি যে প্রশ্নটা আমাদের সামনে দাড়াবে তা হল, বর্তমান সরকারও কি তাহলে বিচারকদের কোন না কোন ভাবে বশ করে রায় আদায় করে নিচ্ছে?
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক সমস্যার এমন সব সমাধান দিচ্ছে যার সবটাতেই প্রতিফলিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী। অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের ক্রুসেড ঘোষনার আসল এবং একমাত্র টার্গেট মনে হচ্ছে বিগত সামরিক শাসকগন। জেনারেল এরশাদ হচ্ছেন এর সর্বশেষ শিকার। সিলেটি হাওরের অবৈধ দখলদার সুরঞ্জিত বাবু দাবি তুলেছেন জেনারেল জিয়ার মরণোত্তর বিচার করার। শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকের মত জিয়া বিচারের ডাকটাও বোধহয় শুরু হল সুরঞ্জিত বাবুর মুখ হতে। পরবর্তী পদক্ষেপ আসবে কিশোরগঞ্জ অথবা কুমিল্লার চান্দিনার কোন গ্রাম হতে। এলাকার আওয়ামী ঘরণার কোন উকিল জেনারেল জিয়াকে আসামী করে স্থানীয় আদালতে ঠুকে দেবে মানহানির মামলা। মানহানি হতে দেশহানী এবং দেশহানী হতে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী, এ অভিযোগে হয়ত জেনারেল জিয়ার ইকবালকেও হাজির করা হবে ’মহামান্যদের’ এজলাশে। অন্যায় ও অবৈধ পথে ক্ষমতা দখলদারী ও ভোগকারীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা একটা সুস্থ বিচার ব্যবস্থার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের উচ্চ আদালত পারবে কি শেখ মুজিব অথবা ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করাতে? জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়ে শেখ মুজিব কর্তৃক একদলীয় বাকশাল গঠনকে আমাদের উচ্চ আদালত কোন দৃষ্টিতে বিচার করবে জানা থাকলে ভাল হত। ৯০ দিনের ফখরুদ্দিন সরকার স্থায়ী হল ১৮ মাস এবং এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক দাবিদার আওয়ামী লীগের অনেক রুই কাতলার গলায় ঝুলানো হল চোরের সাইনবোর্ড। গণতন্ত্রের নব্য রক্ষক উচ্চ আদালত পারবে কি তাদের বিচার করতে? নাকি এদের বিচারের আওতায় আনলে অবৈধ হয়ে যাবে বর্তমান সরকারের ক্ষমতায়ন?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিবেচনায় মেঘা দুর্নীতির দেশ বাংলাদেশে দুর্নীতিতে এ বছরের চ্যাম্পিয়ান আমাদের বিচার বিভাগ। শুনতে এটাও খুব চমৎকার শুনায়। বাংলায় একটা কথা আছে ‘চোরের মার বড় গলা‘। চোর এবং চুরিতে টইটম্বুর আমাদের বিচার ব্যবস্থা বিচার করছে দেশের বাকি চোরদের, কোথায় কি যেন একটা ফাক থেকে যাচ্ছে। এই ফাক সম্পর্কে কিছু ধারণা পেতে যোগাযোগ করেছিলাম ক্ষমতা বঞ্চিত একজন আওয়ামী নেতার সাথে। উনার দৃষ্টিতে রহস্যের সমাধান পানির মত পরিষ্কার, নেত্রীর মনোরঞ্জন পূর্বক ক্ষমতার রুটি হালুয়ায় ভাগ বসানো। একেবারে মন্দ বলেন নি। খুনের আসামী আর উচ্চ আদালতের দরজায় লাথি মারার যোগ্যতা নিয়ে যারা বিচারকের আসনে বসেন তাদের প্রধান ও একমাত্র কাজ হবে নেত্রীকে প্রতিদান দেয়া, এতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু দেখছি না।
কসাই হুজুরদেরও জবাই করার একটা সিজন আসে। আমাদের বিচারকদেরও মনে হয় তেমনি একটা সিজন এসেছে। ক্ষমতার ভরা যৌবনে শাসন এবং বিচার ব্যবস্থার মধুচন্দ্রিমা জাতি হিসাবে আমাদের কতদূর নিয়ে যাবে সময়ই তা প্রমান করবের। তবে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার আওয়ামী বিচারকদেরও যদি আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করানো হয় খুব একটা অবাক হবনা। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে এটাও বোধহয় অসম্ভব নয়।