রাজনৈতিক ফ্রন্টে ২০১১ সালের আবহাওয়া কেমন যাবে তার একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্যে। বছরের প্রথম দিন ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি কোন রাখঢাকের আশ্রয় নেননি, যা বলার তা খোলামেলা ভাবে বলে দিয়েছেন। এ ঘোষণায় অবশ্য নতুন কোন রহস্য উন্মোচিত হয়নি। পারিবারিক ক্ষমতায়নের যে অসুস্থ রাজনীতি দেশকে গ্রাস করেছে খালেদা জিয়ার ভাষণ ছিল তার ধারাবাহিকতা মাত্র। আওয়ামী ঘরণার অনেকেই নেত্রীর বক্তব্যকে বাগাড়ম্বরতা বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন এবং দেশীয় রাজনীতিতে জিয়া পরিবারের ভূমিকা ইতিহাসের অধ্যায় হিসাবে আখ্যায়িত করতে চাইছেন।বসত বাড়ি হতে উচ্ছেদ, সন্তানদ্বয়কে দেশছাড়া, কেন্দ্রীয় নেত্রীত্বের সবার গলায় মামলা এবং পুলিশ দিয়ে দলের সভাসমিতি পন্ড করার মাধ্যমে সরকার এমন একটা পরিবেশ তৈরী করেছে দল হিসাবে বিএনপির অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ লাগাটা স্বাভাবিক মনে হবে।৪০ বছর বয়স্ক দেশীয় রাজনীতিকে যারা কাছ হতে অবলোকন করেছেন তাদের কাছে এ সন্দেহ স্থায়ী কোন প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়না। প্রতিপক্ষকে আইনী ও রাজপথে দমন আমাদের রাজনীতির স্বীকৃত সাংস্কৃতি। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের কলম এবং পেটোয়া বাহিনী গর্ভেই জন্ম নিয়েছিল এ অসুস্থ ধারা। সামরিক স্বৈরশাসকগণ এর অপব্যবহার করে গেছেন নির্মম ও ক্ষমাহীন ভাবে। কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোও পিছিয়ে নেই এ দৌড় হতে। নির্বাচনী ম্যান্ডেটকে প্রতিপক্ষ উচ্ছেদের ম্যান্ডেট হিসাবে নিয়ে পেটোয়া বাহিনীর পাশাপাশি আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছেন নি্জেদের গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে। ক্ষমতার পাঁচ বছর সবকিছু কার্পেটের মত মসৃন মনে হলেও সমস্যাটা দেখা দেয় নির্বাচন প্রাক্কালে। প্রাইভেট বাহিনী আর দলীয় বিচারক দিয়ে সবকিছুতে জিলাপি প্যাঁচানো গেলেও জনগণের রায় নিয়ে সুস্বাদু কিছু রান্না করার টেকসই টেকনোলজি এখন পর্যন্ত আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি বাংলাদেশের মালিকানা দাবিদার দুই পরিবারের দুই নেত্রী। এ বিবেচনায় খালেদা জিয়ার ১লা জানুয়ারির ভাষণকে দাঁড়িপাল্লায় দাড় করালে জাতি হিসাবে আমাদের দৈন্যতার করুন চিত্রই ফুটে উঠবে।
খালেদা জিয়ার মতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন আইনগত বৈধতা নেই। তাই ফখরুদ্দিন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেরও কোন বৈধতা নেই। সন্দেহ নেই ক্ষমতা ফিরে পেলে নেত্রীর নিজ ঘরের বিচারকগন বর্তমান বিচারকগনের মত রায় দিয়ে অবৈধ ঘোষণা করবেন ফখরুদ্দিন আহমদের সরকারকে। স্বাভাবিকভাবেই অবৈধ হবে বর্তমান আওয়ামী সরকার। উচ্চ আদালতের এক খোঁচায় অবৈধ হয়ে যাবে শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন সংশোধনী। সবকিছু রিওয়াইন্ড হবে অনেকটা ভিডিও টেপ রিওয়াইন্ডের মত। নাম বদলাবে শাহজালাল এয়ারপোর্ট হতে শুরু করে গণশৌচাগার পর্যন্ত। বেগম জিয়া এমন একটা বাস্তবতার কিছু আগাম চিত্রই তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। প্রশ্ন হচ্ছে, কি এমন নিশ্চয়তা আছে যার ভিত্তিতে আমরা ধরে নেব সামনের নির্বাচনে বিএনপি জোট জনগনের ম্যান্ডেট পেতে যাচ্ছে? দল হিসাবে বিএনপির ভিত্তি এখন নড়বড়ে। এর মূল শক্তি ছাত্রদল বয়সের ভারে নূয্য। কেন্দ্রীয় নেত্রী বৃন্দ ব্যস্ত নিজেদের আয়েশি জীবন ধরে রাখতে। তার উপর ঝুলছে সরকারী গিলোটিন। এমন একটা বাস্তবতায় দলটি কোন ভিত্তিতে নির্বাচনী মাঠ ডমিনেট করবে আর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না থাকলেও জনগণের মনমানসিকতা হতে পারে এর একমাত্র উত্তর। আমাদের দেশে নির্বাচন হয় সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতার উপর। খালেদা জিয়ার ভাল করেই জানা আছে এ ফ্যাক্টর। দুর্নীতির কালিমায় কলঙ্কিত দলটির ভীত যতই দুর্বল হোক ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতাই হতে পারে তাদের কার্যকর ও সফল নির্বাচনী এজেন্ডা। দলীয় ঘরণার প্রচারণা আর বিচার ব্যবস্থার ঘাড়ে বন্দুক রেখে সাফল্যের যত স্তূতিই আমাদের গেলানোর চেষ্টা করা হোক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ গেল দুই বছরে বিএনপির এক ইঞ্চি ঊর্ধ্বেও উঠতে পারেনি।
পিতার নামে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিমানবন্দর প্রকল্পই পরিষ্কার করে দেয় দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বর্তমান এজেন্ডা। হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্ট যতই রায় দিক, দেশের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষের কাছে জাতির পিতা হিসাবে শেখ মুজিবের গ্রহণযোগ্যতা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। আইন ও স্থাপনা তৈরী করে নেতার নাম অমর করে রাখার প্রকল্প কতটা বুমেরাং হতে পারে তার কিছুটা প্রমান পাওয়া গেছে প্রস্তাবিত এলাকার জনগনের মনোভাবে। ধারণ ক্ষমতার এক তৃতীয়াংশও ব্যবহার করতে পারছেনা দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত এক বছরে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে শতকরা ২০ ভাগ। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে যাত্রী পরিবহন বাণিজ্যে বাংলাদেশ সিংগাপুরের কাছাকাছি যেতে পারবে এমন কোন সম্ভাবনা নেই। এমন একটা বাস্তবতায় সরকার কেন আভ্যন্তরীণ সম্পদ হতে মুন্সিগঞ্জের বিলে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে তার কারণ পানির মত স্বচ্ছ, কন্যা কর্তৃক পিতার নাম অমর করে রাখার চিরন্তন ইচ্ছা। শেখ মুজিব নামটা কি এতই ক্ষয়িষ্ণু যা ফলক টাঙ্গিয়ে অমর করতে হবে?
প্রচারযন্ত্রে ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপক সাফল্যের কথা গেলানোর চেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশের খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিকের ভাষায় অনুবাদ করলে কথিত সাফল্যের কোন সারমর্মই নির্বাচনী বৈতরনি পার হওয়ার জন্যে যথেষ্ট মনে মনে হবেনা। দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের স্থান পাকাপোক্ত অবস্থানে। যে বিচার ব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাঁধে বন্দুক রেখে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক ও পারিবারিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে তাদেরকে রাখা হয়েছে দুর্নীতির প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। ১০ টাকা কেজি চাল আর সুলভে সার সরবরাহের যে প্রতিশ্রুতি তা হতে সরকারী দল এখন যোজন যোজন মাইল দূরে। শহর-বন্দর আর গ্রাম-গঞ্জে ছাত্রলীগ-যুবলীগের তান্ডবে বিপর্যস্ত ব্যবসা বানিজ্য সহ সামাজিক জীবন। ইভটিজার রোগ মহামারী আকার ধারণ করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে সরকারী শাসন ব্যবস্থায়।
অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানোর নাম যদি রাজনৈতিক সফলতা হয় এ লাইনে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই আশিংক সফল বলা যাবে। খুনি আর ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা একটা সুস্থ সমাজের সুস্থতার মানদণ্ড। ৭১’এর অপরাধীদের বিচারকে রাজনৈতিক এজেন্ডা বানিয়ে সাফল্য দাবি করার নৈতিক কোন ভিত্তি নেই ক্ষমতাসীন দলের। তাত্ত্বিক অর্থে আমাদের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন। যুদ্ধাপরাধী গ্রেফতারের কৃতিত্ব রাজনৈতিক কৃতিত্ব দাবি করলে এ হবে বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক প্রভাবকে উলঙ্গ করা। আসামীকে রিমান্ডে নিয়ে পশুর মত নির্যাতন করার ভেতর এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ আছে। এ আনন্দ শুধু সরকার নিজে নয় ব্লগ দুনিয়াকেও ভোগ করতে দিচ্ছে সাকা চৌধুরীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। আইনের শাসনে কেন রিমান্ডের প্রয়োজন হয় উত্তরটা রাজনীতিবিদদেরই দিতে হবে। নিজামী-সাকাচৌদের দল ৭১’এর স্বীকৃত অপরাধী। অপরাধের বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করার অপর নামই সুশাসন। এ পথে না গিয়ে ডিজিএফআই আর র্যাব দিয়ে শারীরিক নির্যাতন ও গুপ্তহত্যা কোনভাবেই একটা সুস্থ সমাজের স্বাভাবিক স্ট্যান্ডার্ড হতে পারে না। এ সাংস্কৃতি আমাদের শাসন ব্যবস্থায় পাকা আসন করে নিয়েছে, যার নির্বিচার ব্যবহারের শিকার হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ৭১’এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দ্রুত ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হলে এ নিয়ে কথা বলার কোন অবকাশ থাকবে না। কিন্তু একে রাজনৈতিক এজেন্ডা বানিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি লাভের বীজ বপন করলে তা ব্যাকফায়ার করতে বাধ্য। এ কথা কারও অজানা নয় নিজামী-সাকাদের আমৃত্যু জেলে রাখতে চাইলে আওয়ামী লীগকে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে হবে। বিচারের রায় যদি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উপর নির্ভর করে তাহলে গোটা বিচার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিতে বাধ্য।
দেশকে জংলী শাসনের গ্যাঁড়াকলে আটকে রাখতে পারলে ক্ষমতার মসনদে পালাক্রমে আসতেই থাকবে হাসিনা-খালেদা চক্র। সহস্রাব্দের যুগসন্ধিক্ষণে বিশ্বায়নের পৃথিবীতে চলছে নানারকম মেরুকরণ। এ মেরুকরণই হয়ত একসময় সরলরেখা টেনে দেবে সফল ও ব্যর্থ জাতির ভেতর। অগ্রগতির মিডল অব নো হয়্যারে দাঁড়িয়ে আমাদের বোধহয় বিবেচনা করার সময় এসেছে রেখার কোন অংশে আমরা বাস করতে চাই।