মুনি ঋষিরা বলেন ক্ষমা চাওয়া না-কি মহত্ত্বের লক্ষণ। মহত্ত্বের জন্যে কেউ ক্ষমা চায় কিনা জানিনা তবে পশ্চিমা দুনিয়ায় বাস করতে গিয়ে কথায় কথায় ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাসটা হাড্ডির সাথে মিশিয়ে নিয়েছি অনেকটা বাধ্য হয়ে। ’এক্সকিউজ মি, ’আই এম সরী‘ ‘আই বেগ ইউর পারডন’ এ জাতীয় বাক্যগুলো তোতা পাখির মত ঠোঁটের আগায় লেগে থাকে সার্বক্ষনিক ব্যবহারের জন্য। ছোটখাট ভুল ও অন্যায়ের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে রেহাই পাওয়ার সর্বোত্তম পন্থা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে এই ক্ষমা সাংস্কৃতি। এর ব্যবহার সার্বজনীন এবং ব্যাপ্তি সর্বস্তরে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট অথবা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীও এই সাংস্কৃতির নিবেদিত সেবাদাস। সাফল্যের কৃতিত্ব দাবি নেয়া যেমন ন্যায্য অধিকার ও মহান কাজ, তেমনি ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব স্বীকার করাও ভেতরও থাকে অলিখিত মহত্ব। সমাজের সুস্থ সবলতা বিচারে এগুলোই মানদণ্ড হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু কোন এক অলৌকিক কারণে আমাদের সমাজে ক্ষমা চাওয়া বিবেচিত হয় পরাজয় হিসাবে, আত্মসমর্পণ হিসাবে। মানুষ মাত্রই ভুল করে এবং ভুলের জন্যে ক্ষমা চাওয়াও বোধহয় মানুষের জন্মগত অধিকার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে জাতি হিসাবে আমরা বোধহয় কোন ভুল করি না, ভুলের উপলব্ধি হতে তাই ক্ষমা চাওয়ারও প্রয়োজন দেখা দেয় না। বাস্তবতাটা কি আসলেই তাই? চলুন ব্যাপারটায় একটু চোখ বুলিয়ে আসি।
তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় নেত্রী জনাবা খালেদা জিয়া গতকাল জাতির উদ্দেশ্যে বেসরকারী ভাষণ দিলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারী ভাষণের মাধ্যমে দাবি করে গেলেন নিজ সরকারের সাফল্য। বেগম জিয়ার ভাষণের মূল থিম ছিল প্রধানমন্ত্রীর দাবির বিপক্ষে নিজ দলের বক্তব্য তুলে ধরা। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের দাবি ও পালটা দাবির ভেতর কোন বৈরিতা নেই। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম হাতিয়ার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে এর বিরোধিতা করাও গণতন্ত্রের অংশ। কদিন পর মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ সভায় ভাষণ দেবেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। মার্কিন রাজনীতিতে এ ভাষণ ’স্টেট অব দ্যা ইউনিয়ন’ ভাষণ হিসাবে পরিচিত। প্রেসিডেন্সির এক বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা এবং সামনের দিনগুলির পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। দেশের প্রাইম টাইম মিডিয়ার প্রায় সবাই সরাসরি প্রচার করবে প্রেসিডেন্টের ভাষণ। ভাষণ শেষে মিডিয়া সূযোগ দেবে বিরোধী দলকে। ওরা বলবে প্রেসিডেন্ট ওবামার ব্যর্থতা নিয়ে এবং এর আলোকে তুলে ধরবে নিজেদের পলিসি। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদের বক্তব্য ও পালটা বক্তব্যে যেমন থাকবে নিজ নিজ সাফল্যের দাবি তেমনি থাকবে ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি। স্বাভাবিক ভাবেই আসবে ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গ। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যের দাবি খণ্ডাতে গিয়ে যা বললেন তার সাথে দ্বিমত করার মত তেমন কিছু ছিলনা। আক্ষরিক অর্থেই দেশে আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করেছে বর্তমান সরকার। দুদিন আগে শেখ হাসিনার ডেপুটি সাজেদা চৌধুরী সরকারী রাজনীতির রূপরেখা পরিষ্কার করতে ঘোষণা দিয়েছেন, ’শেখ মুজিবকে যারা জাতির পিতা মানবে না তাদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই’। সাফল্যের যত ফিরিস্তিই তুলে ধরুক না কেন সরকার এখন ব্যকসীটে এবং শেখ মুজিবের দোহাই দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকার রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সমাজের উঁচু শ্রেনীর প্রতিনিধি খালেদা জিয়া ঘটা করে না বললেও আমজনতার বুঝতে অসুবিধা হয়না রাজনীতির নামে দেশটায় কোন তন্ত্র চালু করতে চাইছে ক্ষমতাসীন দল।
একটা কথা চালু আছে গ্রাম-গঞ্জে, মল ত্যাগের সময় বেড়ালের না-কি চোখ বন্ধ থাকে যাতে কেউ দেখতে না পায়। ভাষণের সময় খালেদা জিয়াকেও কেন জানি বেড়ালের মত দেখাচ্ছিল। উনি অবলীলাক্রমে হাসিনা সরকারের লুটপাটের কথা বলে গেলেন। কিন্তু টু শব্দটা করলেন না নিজের লুটপাট সাম্রাজ্য নিয়ে। আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন হিসাবে গণ্য করার যথেষ্ট কারণ আছে। এ ধরণের একটা বিচার ব্যবস্থা খালেদা জিয়ার সন্তানদের বিচার করলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কিন্তু তিন বারের প্রধানমন্ত্রীর এক সন্তানকে যখন সিংগাপুরের মত দেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ থাকে না। সিংগাপুর বাংলাদেশ নয় যেখানে গায়ের জোর আর চাপাবাজি দিয়ে সত্যকে মিথ্যা বানানো যাবে। খালেদা জিয়ার সন্তানদ্বয় মার ক্ষমতার ছত্রছায়ায় দেশকে কতটা লুটপাট করছে তার কিছুটা হলেও নমুনা পাওয়া গেছে সিংগাপুরের ঘটনা হতে। আমানুল্লাহ আমানের উত্থান নিয়ে আজকের একটা দৈনিক প্রতিবেদন ছাপিয়েছে (http://www.mzamin.com/index.php?option=com_content&view=article&id=48:2010-08-26-17-49-46&catid=51:2010-09-02-11-25-57&Itemid=86)। কোন অসুস্থ দেশের সংজ্ঞায়ও বেগম জিয়ার এই লেফটেন্যান্টকে রাজনীতি করার ছাড়পত্র দেয়া যায়না। ডানে বায়ে যাদের নিয়ে বেগম জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যর্থতা আর চুরিচামারির কথা বললেন দুর্ভাগ্য হচ্ছে তাদের সবার গায়ে একই অভিযোগের কালিমা। নেত্রী অনেকটা বেড়াল কায়দায় রাজনীতির মাঠে মলমূত্র ত্যাগ করে গেলেন। হয়ত ভেবেছিলেন জাতি ভুলে গেছে পুত্রদ্বয়ের কলঙ্কিত ইতিহাস। চাইলেও এ ইতিহাস ভুলবার নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ আর আওয়ামী লীগের অপশাসনের চাদরে ঢাকার মত অপরাধ করেন নি জিয়া পরিবারের লূটেরা দল।
এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। এদের সহজ সরল হূদয় জয় করতে এক চোখের পানিই যথেষ্ট। ক্ষমা চাইলে এরা ক্ষমা করতেও সাতপাঁচ ভাবে না। খালেদা জিয়ার চোখের পানি অনেকের মনেই দাগ কেটেছিল সত্য কিন্তু এ মুহূর্তে পানি শুকানোর মত যথেষ্ট মাটি নেই নেত্রীর পায়ের তলায়। ক্ষমা প্রার্থনাই হতে পারে উনার নতুন শুরু। সন্তানদ্বয়, আপন মা, ভাই আর বোনদের কৃত অপরাধের জন্যে হাঁটু গেড়ে জাতির সামনে খালেদা জিয়াকে ক্ষমা চাইতে হবে। এ ক্ষমা নিয়ে দেউলিয়া মিডিয়া সোরগোল তুলতে পারে, প্রতিপক্ষ বাকা হাসি হাসতে পারে, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এ ক্ষমায় কিছুটা হলেও আশান্বিত হবে। এ মুহূর্তে গিবতের চাইতে আত্মোপলব্ধিটা বেশি প্রয়োজন, আর জাতির প্রয়োজন ছোটখাট কিছু আশা। দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেছে আমজনতার। মিথ্যাচার আর গিবতের রাজনীতি দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল করা গেলেও ১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন যে সম্ভব নয় ৪০ বছরে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। নতুন পথে না গিয়ে পুরানো ভাংগা রেকর্ড বাজালে খালেদা জিয়া নিজেকে শুধুমাত্র শেখ হাসিনার অপর পীঠ হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন, এর বাইরে অন্যকিছু নয়।