শীতের তীব্রতা, গ্রীষ্মের তাপ দাহ অথবা বর্ষার অঝোর ধারা কোন কিছুই আমাদের জন্য বাধা হয়না। চুম্বকের টানের মত টান, রক্তের সম্পর্কের মত আত্মীয়তা আর দূরারোগ্য নেশার মত নেশা, এভাবেই বর্ণনা করা যায় জাতি হিসাবে আমাদের ভোটাসক্তি। পাবলিক সেন্টিমেন্টের প্রতি সন্মান জানিয়েই বলছি, আমরা ভোট নেশায় নেশাগ্রস্ত জাতি। চাল, ডাল, তেল নুনের মত ভোটও আমাদের বেচে থাকার অন্যতম দাবি। মসজিদ কমিটি, স্কুল গভর্নিং বডি, গোরস্তান পরিচালনা পরিষদ হতে শুরু করে এমন কোন সামাজিক, আর্থিক অথবা পেশাজীবি প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে নির্বাচন ভূমিকা রাখে না। বিবর্তনের রঙিন চশমায় দেখলে বাংলাদেশকে মনে হবে গণতন্ত্রের রোল মডেল। চাইলে এ নিয়ে আমরা বোধহয় গর্বও করতে পারি।
দেশের অলিগলিতে এখন নিয়মিত লাশ পরছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত পরিসংখ্যান গুলো একত্র করলে দৈনিক খুনের একটা দুঃখজনক বাস্তবতা ফুটে উঠবে। দেশের অন্ধ ও বধির সমিতির প্রথম সারির একজন নেতার লাশ পাওয়া গেল কদিন আগে। প্রাথমিক ধারণা সমিতির কোটি কোটি টাকা লোপাটই ছিল ঘটনার মূল কারণ। অন্ধ ও বধির সমিতির নির্বাহী কমিটি গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত একটি প্রতিষ্ঠান। এ সমিতির নিজস্ব কিছু স্থাপনা আছে যা হতে বছর বছর কোটি কোটি টাকা আয় হয় যার নিয়ন্ত্রণ থাকে নির্বাচিত কমিটির হাতে। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত এ কমিটির একজন সাধারণ সম্পাদক রাস্তার ফকির হতে রাতারাতি কি করে কোটিপতি বনে যায় এর ভেতরই হয়ত লুকিয়ে থাকে দেশীয় গণতন্ত্রের আসল চেহারা। অবৈধ সম্পদের বৈধ লাইসেন্স দেয়ার অপর নামই বোধহয় বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন। এমন একটা লাইসেন্সের জন্যেই সংসদ নির্বাচন হতে শুরু করে অন্ধ ও বধির সমিতির নির্বাচন নিয়েও চলে সীমাহীন উৎসাহ, উত্তেজনা আর খুনাখুনি।
বরাবরের মত এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নজিরবিহীন উৎসাহ উদ্দীপনা। ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, বাবার বিরুদ্ধে সন্তান, স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পরিচয় ও সামাজিক অবস্থান মূল্যায়ন করলে কিছু অদ্ভুত ও ভীতিকর পরিসংখ্যান ভাবিয়ে তুলবে আমাদের। প্রায় শতাধিক খুনের আসামী লড়াই করছে পৌরসভা চেয়ারম্যান পদে। দুই একটা ব্যতিক্রম থাকলেও গড় হিসাবে একজন পৌরসভার চেয়ারম্যানের পরিচয় রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের রুট লেভেল লেফটেন্যান্ট হিসাবেই। কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও দুস্থ মাতাদের আটা ও গম লোপাট সহ হেন কোন অসামাজিক কাজ নেই যাতে জড়িত থাকে না নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ। এক কথায় ক্ষমতার রাজনীতিতে লুটপাটের যে রুগ্ন সাংস্কৃতি তা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় হতে গ্রাম পর্যায়ে রপ্তানিকে আইনী বৈধতা দেয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ বৈধতা পেতে স্থানীয় নেত্রীবৃন্দ কতটা মুখিয়ে থাকে তার কিছুটা নমুনা পাওয়া যাবে চাঁদপুরের একটা ঘটনা বিবেচনায় আনলে। মনোনয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী দুই মেরুতে অবস্থানের কারণে পৌরসভায় দেখা দেয় উত্তেজনা। কেন্দ্র হতে একজনকে মনোনয়ন দেয়া হলেও স্থানীয় নেত্রীবৃন্দের অনেকের পছন্দ অন্যজনকে। বৈরিতা রূপ নেয় সহিংসতায়। তবে এক পর্যায়ে দুজনই বুঝতে পারে ক্ষমতা অন্যদলের হাতে চলে গেলে এর আসল স্বাদ হতে বঞ্চিত হবে দুজনেই। বৈরিতা এ যাত্রায় রূপ নেয় দরকষাকষিতে। ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়ে যায় একজন প্রার্থী। দলীয়ভাবে মনোনীত প্রার্থীর ভাষ্যমতে বেশ কয়েক লাখা টাকা ব্যায় করে তাকে মনোনয়ন ক্রয় করতে হয়েছিল কেন্দ্র হতে। বুঝতে অসুবিধা হয়না নির্দলীয় নির্বাচনে কেন দলীয় সাইনবোর্ড লাগাতে বাধ্য হয়েছিলেন রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ । গণতান্ত্রিক নির্বাচনের এ কালো সাংস্কৃতি শুধু রাজনীতির মাঠে নয়, রাজত্ব করছে সমাজের সর্বস্তরে। ঢাকার নামকরা স্কুলের গভর্নিং বডির নির্বাচন নিয়ে কেন শিক্ষিকা খুন হন তার মূলেও থাকে অবৈধ অর্থ বৈধ করার লিগ্যাল ম্যান্ডেট পাওয়ার আকুলি বিকুলি। আর এর নাম গণতান্ত্রিক নির্বাচন।
জনগণের রোষানলে দগ্ধ হয়ে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট পালাতে বাধ্য হয়েছেন। দেশটার লম্বা সময়ের প্রেসিডেন্ট বেন আলী শেষ পর্যন্ত ঠাঁই নিয়েছেন রাজতন্ত্রের লীলাভূমি সৌদি আরবে। বেকারত্ব ও নিত্যপ্রয়োজীনয় দ্রব্যাদির লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে যায় জনগণের। কথা দিয়ে চিড়া ভেজানো পর্ব অকেজো প্রমান হওয়ার পর জনগণ বুঝতে পারে বেন আলী আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের লুটের কারণেই তাদের এ দশা। এরও অনেক আগে প্রতিবেশি দেশ আলজেরিয়ায়ও ঘটেছিল একই ঘটনা। জনগণ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল আটার মূল্য কয়েক পয়সা বেড়ে যাওয়ায়। বাংলাদেশি জনগণের সাথে এখানেই পার্থক্য বাকি দুনিয়ার। এখানে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার মিল না হলেও ক্ষমতার থাকা যায় সগৌরবে। প্রতিশ্রুত ১০ টাকা কেজি চালের মূল্য ৪০ টাকায় চলে গেলেও এখানে কেউ রাস্তায় নামে না। কারণ রাস্তার ব্যস্ততা এখানে অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে, নির্বাচন। ইয়াবা নেশার মত জাতিকে নেশাগ্রস্ত বানিয়ে রাখে কথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন। মূল সমস্যা হতে জনগণকে দূরে রাখার এ এক মোক্ষম অস্ত্র , যার যথাযত ব্যবহার নিশ্চিত করছে পারিবারিক, দলীয় ও ব্যাক্তিগত ক্ষমতার মোহনীয় স্বাদ।