১৪তম সন্তান গওহারা বেগমের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন সাম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল। তৃতীয় স্ত্রীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে সাম্রাজ্যের অধিপতি শাহজাহান খুবই মুষড়ে পরেছিলেন। হতে পারে ধারণাটা জন্ম নিয়েছিল সুরা আর সাকির নেশায় মত্ত বিশেষ কোন মুহূর্তে। কিন্তু এই বিশেষ মুহূর্তের ঔরস হতে যা প্রসবিত হয়েছিল পরবর্তীতে তা শুধু স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালবাসার নিদর্শনই নয় বরং বিশ্বের অন্যতম আর্কিটেকচারাল স্থাপনা হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ২২ হাজার শ্রমিকের ২১ বছর নিরলস পরিশ্রমের ফসল তাজমহল আজ শুধু রাজা বাদশাহদের রূপকথার গল্প নয়, পৃথিবীর আশ্চর্যতম স্থাপনাসমূহের একটা যা দেখতে কোটি কোটি ভ্রমণকারী ভিড় জমায় যমুনা তীরে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বড় বড় সৃষ্টির শুরুটা মূলত এভাবেই। ক্ষমতাধর কেউ একজন নিজেকে অথবা নিকটতম কাউকে অমর করে রাখার ইচ্ছা হতে জন্ম নেয় বিশাল কিছু। মুন্সীগঞ্জের অড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্য নির্মানের ইচ্ছার পেছনে কোন প্রেরণা কাজ করেছে তার রূপরেখা এখন পর্যন্ত তুলে ধরা হয়নি। তবে পিতার প্রতি কন্যার আজন্ম ভালবাসাই যে এর আসল ভিত্তি তা বুঝতে আশাকরি দিল্লির বাদশাহ হওয়ার প্রয়োজন পরবে না।
১৭ কোটি মানুষের কত অংশ বিমানবন্দর হয়ে দেশ বিদেশ যাতায়াত করে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান আছে বলে মনে হয়না। থাকলেও তা হবে অনুমান নির্ভর অথবা কল্পনাপ্রসূত। দুর্নীতি রোগে রোগাক্রান্ত বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরোও এর ব্যতিক্রম নয়। ক্ষমতাসীন দলের চাহিদা মেটাতে এরা দিনকে রাত আর ১ লাখকে ১ কোটি বানাতে মুহূর্তের জন্যেও চিন্তা করবে না। তবে বলা হচ্ছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাৎসরিক ধারণ ক্ষমতা ৮০ লাখ, এবং বর্তমানে ব্যবহৃত ট্রাফিক সংখ্যা বছরে ৩০ লাখের কিছু বেশি। ঘন্টায় ৬০টির মত বিমান ওঠানামা করলে একটা বিমানবন্দরকে বলা হয় ব্যস্ত বিমানবন্দর। ঢাকা বিমানবন্দরে এ সংখ্যা ৮ হতে ১০, তাও আবার পিক আওয়ারে। অর্থনৈতিক মন্দায় তলিয়ে আছে আধুনিক বিশ্ব। এ হতে উত্তরণের কোন ম্যাজিক তত্ত্ব বাজারে বিক্রি হচ্ছে না এ মুহূর্তে। স্বভাবতই আমরা ধরে নেব দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি মানবসম্পদ রপ্তানির জন্যে অপেক্ষা করছে ঘোর অমানিশা। তার বেশকিছু নমুনা ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। নতুন রপ্তানী দুরে থাক বাংলাদেশের মূল শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া হতে একে একে ফিরে আসছে বৈধ অবৈধ অনেকে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক দশকে ঢাকা সহ বাংলাদেশের বাকি বিমানবন্দর গুলোর যাত্রী পরিবহন সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যেতে বাধ্য। অবশ্য এ ফাঁকে বঙ্গোপসাগরের পানি সোনা-রুপায় রূপান্তরিত হলে নতুন নতুন বিমানবন্দরের প্রয়োজনীতা দেখে দেবে ততধিক নাটকীয় চাহিদায়। শেখ হাসিনা কি তেমনি একটা সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন দিগন্তরেখায়?
অনেকে বলছেন নতুন এবং আধুনিক একটা বিমানবন্দর সিঙ্গাপুর কায়দায় বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চেহারা। কথাটা বোধহয় একেবারে মিথ্যে নয়। পরিবহন বাণিজ্যে সিঙ্গাপুর নামক দেশটার বিস্মৃতি বিশ্বজুড়ে। আকাশ চলাচলে ব্যবসায়িক আধিপত্য একদিনে অর্জন করেনি আজকের সিঙ্গাপুর। এর জন্যে তাদের অতিক্রম করতে হয়েছে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ম্যারাথন পথ। নেতা লী কুয়ান যে পথে এ জাতিকে নিয়ে গেছেন সে পথের সাথে বাংলাদেশী পথের অনেক পার্থক্য। সিঙ্গাপুর বিমান বহরের কজন পাইলট আর বিমানবালা চোরাইকারবারীতে জড়িত তার কোন উপাত্ত নেই আধুনিক তথ্যভান্ডারে। এর প্রয়োজনও হয় না। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমান বহরের ক্লিনার হতে শুরু করে পাইলট আর বিমানবালাদের কে এ কাজে জড়িত নয় তা খুঁজতে আমাদের বোধহয় দুদকের মত নতুন কোন সংস্থার জন্ম দিতে হবে। সিংগাপুরের সাথে আমাদের পার্থক্যটা এখানেই। বানিজ্যিক সাফল্যের একক ও ফরমোস্ট ফ্যাক্টর তার সাথে জড়িত মানুষ। হাসিনা-খালেদার মানুষ দিয়ে ৫০ হাজার কোটি কেন ৫০০ হাজার কোটি টাকার বিমানবন্দরও বাংলাদেশকে সিংগাপুরের ধারে কাছে নিয়ে যেতে পারবে না। এটা কোন রাজনৈতিক বক্তব্যা নয়, বরং চরম বাস্তবতা। সমস্যা অড়িয়াল বিল নয়, বিলের ফসলী জমি অথবা মৎস প্রকল্প ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা নয়, সমস্যা এর সাথে জড়িত রাজনীতি এবং রাজনীতির নষ্ট ফসল। ঢাকায় শেরেবাংলা নগর স্থাপনের প্রস্তাবেও মানুষ বিরোধিতা করেছিল, বিরোধিতা করেছিল জিয়া বিমানবন্দর নির্মানে। কিন্তু সময় প্রমান করেছে এসবের প্রয়োজন ছিল। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মানের দাবিও হবে সময়ের দাবি। কিন্তু প্রশ্ন দাড়াবে সে সময় হতে আমাদের অবস্থান কতটা দুরে? শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের মৌলিক চাহিদায় বিমানবন্দর ব্যবহারের কোন তাগাদা নেই। সমস্যার দেশ বাংলাদেশ। এখানে বেঁচে থাকার নূন্যতম প্রয়োজন চাল, ডাল, তেল, নুনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস আর পানির নিশ্চয়তা নেই বেশিরভাগ মানুষের। এমন একটা দেশে বিশাল আয়োজনের বিমানবন্দর নির্মানের যৌক্তিকতা কেবল এর উদ্যোক্তা শেখ হাসিনা নিজেই বলতে পারবেন। তবে নেত্রী পরিবারের বাকি সদস্যদের মত সবাই যদি প্রবাসী হয় বাংলাদেশের প্রতি শহরে নতুন বিমানবন্দর নির্মানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে বলে মনে হয়না।
আমি নতুন বিমানবন্দর নির্মানের পক্ষে। তবে তাতে একটা কিন্তু থাকতে হবে। আড়িয়ল বিল হোক আর গোপালগঞ্জের টুংগিপাড়ায় হোক, বিশাল আয়োজনের সফল নির্মাণ শেষে স্থাপনাটাকে কটা বছরের জন্যে ব্যবহার করতে হবে অন্য একটা কাজে। আর তা হবে জেলখানা হিসাবে। প্রচলিত ধারার জেলখানা নয়, বরং ইংরেজিতে যাকে বলে কারেকশনাল সেন্টার হিসাবে। উদ্দেশ্য, নেত্রী শেখ হাসিনা হতে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী যাদের কারণে বাংলাদেশ নামক দেশটায় বেঁচে থাকা গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে চলে গেছে তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা করা। পালাক্রমে এ সেন্টারে আসতে হবে কথিত জাতীয়তাবাদীদের। ভবিষ্যত বিমানবন্দরের ক্লিনার হতে শুরু করে পাইলটদেরও পাড়ি দিতে হবে এ পথ। সংশোধিত চরিত্রের রাজনীতিবিদ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মগজ হতে ৫০ হাজার কোটি টাকার ’অমর পিতা’ প্রকল্প জন্ম নিলে আমজনতার একজন হয়ে তা মেনে নিতে কোন অসুবিধা থাকবে না।
আয়েশি বিলাসী মোগল বাদশা শাহজাহানের শেষ পরিণতিটা কিন্তু খুব একটা সুখকর ছিলনা। প্রেমের নিদর্শন তাজমহল নির্মান সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হলেও তার সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি হতভাগা সম্রাটের। নিজ ছেলে আওরঙ্গজেবের গৃহবন্দী হয়েই কাটাতে হয়েছিল জীবনের বাকি সময়। পিতাকে অমর করার মহা-প্রকল্প বাস্তবায়নে কন্যা শেখ হাসিনা চাইলে শিক্ষা নিতে পারেন তাজমহল হতে।