ফজরের নামাজের আগেই ঘুম ভাঙে ফজর আলীর। ঘরে বাইরে প্রচন্ড শীত, সাথে ঘন কুয়াশা। প্রতিদিনের মত আজও তার গা ভিজে গেল। খারাপ কোন স্বপ্ন দেখেছিল কি-না মনে করতে পারল না। নামাজ পড়ার অভ্যাস নেই, তারপরও গত এক বছর ধরে ঘটছে একই ঘটনা। আজানের আগে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে কোন এক অজানা আশঙ্কায়। ঢাকায় নামকরা বেশ ক’জন ডাক্তার দেখিয়েছে, গঞ্জের কবিরাজের সাথে কথা বলে দামি দুটা তাবিজও এনে দিয়েছে ছোট বিবি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না কোন কিছুতে। এক ধরণের অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে তাকে। আজও এর ব্যতিক্রম হল না।
ছোটঘরের কাজকর্ম সেরে বেরিয়ে পরল ফজর আলী। জেলেপাড়ার ওপাড়ে ঠেঙ্গার বিল, ওদিকেই রওয়ানা দিল সে। নামে বিল হলেও পানির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বিলের মালিকানা নিয়ে এমপি আর চেয়ারম্যানের ভেতর রক্তারক্তি চলছে অনেকদিন ধরে। ঢাকা হতে শহুরে বাবুরা এসে বিশাল এক মৎস প্রকল্প ফেঁদে বসেছে বিল জুড়ে। গোটা তিনেক ডিপটিউবওয়েল পানি তুলছে দিনরাত। ওরা সবাই এমপির লোক। এক সময় ফজর আলীও ছিল ওদের দলে। কিন্তু এমপি যেদিন তার তৃতীয় স্ত্রীর দিকে চোখ উঠাল সেদিন হতে চেয়ারম্যান ক্যাম্পে নাম লেখাতে বাধ্য হয় সে। বিলে চেয়ারম্যানেরও বেশ কটা প্রকল্প আছে যা ফজরকে আগলে রাখতে হয়। কুয়াশাটা আজকে একটু বেশিই মনে হল তার কাছে। তিন চার হাত দুরের কিছু দেখতেও কষ্ট হচ্ছে। সাথে অজগর সাপের মত এক ধরণের হিস হিস আওয়াজ। মাছ চুরির ঘটনাগুলো ঠিক এ সমসয়েই ঘটে থাকে। ফজরের জানা আছে এসব। এ নিয়ে কম ঝড় যায়নি তার উপর দিয়ে। এমপির হয়ে কাজ করতে গিয়ে খুনাখুনি সহ বড় ধরণের ঝামেলা সামলাতে হয়েছে।
আকাশের দিকে তাকাল ফজর। কুয়াশার ঘন চাদর ভেদ করে শেষ রাতের চাঁদটাকে দেখতে অসুবিধা হলনা তার। একটু পরেই আজান ভেসে আসবে চেয়ারম্যানের জুমাঘর হতে। কি মনে করে উপরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। বিলে আসলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। এখানেই পরেছিল বাবার লাশটা। ৭১’এর শেষদিকে শান্তিকমিটির চেয়ারম্যানের লোকজন এসে ধরে নিয়ে যায় বাবাকে। অন্যের জমি গিলে খাওয়ার অভ্যাস আগেই ছিল, শান্তি কমিটি গঠন কাজটাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল কেবল। ফজরদের জমিজমা বলতে যা ছিল তার সবটাই চলে যায় ঐ লোকটার দখলে। স্বাধীনতার এক বছর কোথায় যেন ঘাপটি মেরেছিল সপরিবারে। পুরানো অভিযান নতুন করে শুরু করতে বেশি সময় নেয়নি চৌধুরী পরিবার। পরিবারের একমাত্র সন্তান আওয়ামী লীগের নমিনেশন কিনে যেদিন এমপি বনে যায় সেদিন হতে শুরু হয় তাদের নতুন যাত্রা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের।
গোঙানির মত আওয়াজটা দ্বিতীয়বার শুনতেই সতর্ক হয়ে উঠল ফজর। এ এলাকায় এসব নতুন কিছু নয়। লাশ গুম করার নিরাপদ জায়গা ঠেঙ্গার বিল। এমপি ও চেয়ারম্যান দুজনের হয়েই কাজটা করতে হয়েছে তাকে। ইদানিং থানা পুলিশও ব্যবহার করছে নিজেদের কাজে। একাধিক আওয়াজ ভেসে আসছে কাছাকাছি কোথাও হতে। ঘন কুয়াশার কারণে কিছু দেখতে পেল না ফজর। পায়ের সাথে কিছু একটা ধাক্কা লাগতে সচেতন হয়ে উঠল তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। কিছু একটা ঘটে গেছে এখানে। জীবিত না মৃত ঠাউর করতে না পেরে গায়ে হাত দিল। অবাক হল সে, পুরুষ নয় বরং শাড়ি পরিহিতা কেউ একজন শুয়ে আছে মাটিতে।
- আম্মাজান, আফনে কিডা, এইহানে কি করতাসেন? জিজ্ঞেষ করল ফজর।
- আমি সাহারা খাতুন। রেব আমারে গুলি করসে। বিনা বিচারে আমরা মাইরা ফালাইসে।
- তা আফনে কবরী সাহারা খাতুন না মন্ত্রী সাহারা খাতুন? তা যেই হোন কেন, ঢাকা থুইয়া এই ঠেঙ্গার বিলে কি করতাসেন?’
- আমিই সেই সাহারা যে মন্ত্রী আছিল।
- বলেন কি, আমি তো জানতাম এক সময় আফনেই আছিলেন রেবের মা-বাপ, আফনেরে আবার গুলি করল কেমনে?’
- এই সব তুমি বুঝবানা মিয়া। আমি আছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রেবের মালিক, আর অহনকার মালিক বাবরের দল হইতাসে স্বাধীনতার বিপক্ষের সরকার। হেগো হাতে মরণ আর আমাগো হাতে মরণ দুইডা দুই জিনিষ’।
মরণ আবার দুই রকম হয় কি করে ভেবে পেল না ফজর। ৭১’এর বাবাকে হত্যার সময় পাকির দলও একই কারণ দেখিয়েছিল। রাজনীতির এসব জটিল কথাবার্তা মাথায় ঢুকে না তার। ভাল করে দেখার চেষ্টা করল মহিলার চেহারা। সোনাদানা থাকলে হাতিয়ে নেয়ার চিন্তা করলে সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না ঘন কুয়াশার কারণে।
- আমি বাচমুনা কিন্তু তুমি বাচবা, সূর্য উঠলে খবরটা তুমি সাড়া দুনিয়ায় পৌছাইয়া দিও, এই সরকার মানবাধিকার লংঘন করসে, বিনা বিচারে আমারে মাইরা ফেলাইসে।
- তা হেগো অভিযোগডা কি আছিল আফনের বিরুদ্বে?।
- আমার হোটেলে না-কি বেশ্যার কারবার আছে। আমি না-কি মিটিং মিছিলে আদম সাপ্লাই দিয়া টেকা খাই। কি কমু, অভিযোগের শেষ নাই।
- তা আম্মাজান একখান জিজ্ঞাসা, যহন ধরতে যায় আফনে কি রেবেরে গুল্লি মারছিলেন?
- ছেঃ ছেঃ ছেঃ, এত বড় মিছা খোদায়ও মাপ করব না।
- কিন্তু আম্মাজান, এই কথা তো আফনে হরহামেশা কইতেন। হেরা গুল্লি মারে আর আত্মরক্কার খাতিরে বাবাজিরা পালডা গুল্লি চালায়।
- মিয়া তুমারে তো আমি আগেই কইসি আমরা বংগবন্ধুর সৈনিক, আংগো মুখের কথা আর হেগো মুখের কথা দুইডা দুই রকম।
কথা বাড়াতে ইচ্ছা করল না ফজরের। মিথ্যার লীলাভূমিতে পরিনত হয়ে গেছে দেশটা ভাবতে ঘেন্না ধরে গেল তার। একজন মহিলাকে এ অবস্থায় ফেলে যেতেও মান চাইছিল না। ঠিক এই সময় আরও একজনের গোঙানির আওয়াজ পেল কাছাকাছি কোথাও। অবচেতন মনে এগিয়ে গেল কিছুটা পথ। রক্তের গন্ধটা তার অতি পরিচিত, হাউন্ড ডগ কায়দায় শুকে শুকে খুঁজে পেল দ্বিতীয় জনকে। এবার আর মহিলা নয়, দস্তুরমত কেতাদুরস্ত একজন পুরুষ।
- আফনে কি মইরা গেছেন স্যার?
- নট ইয়েট। ইটস নট ইজি টু কিল আ বঙ্গবন্ধু সোলজার। আই উইল ফাইট আন্টিল মাই লাষ্ট ব্রেথ।
- আফনে কি বিদেশি, কোন ভাষায় কতা কইতাসেন? বাংলাদেশি হইলে ফেব্রুয়ারী মাসে অন্য ভাষায় কতা কওন ঠিক না। বাংলা কন।
- ব্লাডি ফুল, আমারে চিনলি না, আমি ফারুখ খান। তগো বানিজ্য মন্ত্রী আছিলাম।
- হুজুর আমার কোন দল নাই তাই মন্ত্রীও নাই। যহন যেয় টেকা দেয় তার হইয়্যা কাজ করি। তা আফনেরে ঠেঙ্গার বিলে আনল কি কারণে?
- ব্লাডি ইডিয়ট গুলো বলছে আমি নাকি সামিট গ্রুপেরে দিয়া কোটি কোটি টাকা বানাইছি, শেয়ার বাজার তচনচ করছি, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের শেয়ার খাইছি।
- কতাগুলা কি হাছা না মিছা?
- নাথিং বাট লাই। মিথ্যা, সব মিথ্যা।
- কিন্তু হুজুর আফনেরা যহন মানুষ মারতেন তহন তো একৌ কতা কইতেন।
- একজন বংগবন্ধু সৈনিকের মিথ্যা আর পাকি দালালগো মিথ্যা দুইটা দুই জিনিষ। তুই একটা বেকুব, এসব বুঝার মগজ নাই, তাই বুঝবি না আমি কি বলতে চাইসি।
রাগে থর থর করে উঠল ফজরের শরীর। পিস্তলটা সাথে না আনায় রাগ হল নিজের উপর। জীবিতদের হত্যা করা তার প্রফেশন, কিন্তু এই প্রথমবারের মত মনে হল একজন মৃতকে হত্যা করতেও হাত তার কাঁপবে না। দ্বিতীয় মহিলার গোঙানির আওয়াজে অবাক হল না ফজর।
- আমি দিপু মনি। কে আছ আমারে বাঁচাও।
আজকের কাগজেই খবরটা পড়েছে সে, মন্ত্রী দিপু মনি বলেছেন শাসন ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছে ক্রসফায়ার, এত সহজে তা বদলানো যাবে না।
- আম্মাজান, আরেক জনমে মন্ত্রী হইলে হুস কইরা কতাবার্তা কইয়েন। নিজের ফান্দে নিজেই ধরা খাইসেন। মরেন, আরামে মরেন। এই মরণ শাসন ব্যবস্থারই অংশ।
আজানের আওয়াজ ভেসে আসল জুমাঘর হতে। সকাল হতে বাকি নেই। ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল ফজর আলী। এমপির সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে দুপুরে। চেয়ারম্যানকে মার্ডার করার প্রস্তাবটা সহজে ফিরিয়ে দিতে পারেনি সে। অনেক টাকার ব্যাপার।
এত সকালে মোর্শেদের ফোন পেয়ে অবাক হলাম না। ও এমনই। যখন খুশি ফোন করে বসে। ইস্ট কোষ্টের সাথে দুই ঘন্টা সময় পার্থক্য আমার। ও সেটা ইচ্ছা করেই বুঝতে চায় না। বিদেশ বিভুঁইয়ে আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাই মনের রাগ মনেই ধরে রাখতে হয়
- কিরে ঘুমাচ্ছিস নাকি?
- তোর কি মনে হয়?
- শোন, এত সকালে ফোন করছি একটা বিশেষ কারণে। তোকে একটা দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে। আমাদের স্কুল বন্ধু ফজর আলী মারা গেছে। আসলে মেরে ফেলা হয়েছে তাকে। র্যাবের গুলিতে মারা গেছে সে। লাশ পাওয়া গেছে ঠেঙ্গার বিলে। র্যাব বলছে সে নাকি দলবল সহ এমব্যুশ করেছিল, আত্মরক্ষার খাতিরে গুলি করতে বাধ্য হয় তারা।
- বলিস কি? স্বপ্নে তাকেই তো দেখছিলাম এতক্ষণ, তাও আবার ঠেঙ্গার বিলে।
- ও গুলো স্বপ্ন না, খোয়াব। শেষ রাতের স্বপ্নকে বলা হয়া খোয়াব। খোয়াবে যা দেখবি বাস্তবে ঘটবে ঠিক তার উল্টোটা।
মায়া হল ফজরের জন্যে। অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত একই স্কুলে পড়েছিলাম। হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায় সে। অনেক গুলো বছর পর আবারও হাজির হয় এলাকায়। ততদিনে নিজের গায়ে পাকা একজন সন্ত্রাসীর পরিচয় লাগিয়ে নিয়েছে। এরশাদ, হাসিনা, খালেদা সহ সব দলের এমপিরাই ব্যবহার করেছে তাকে। ঢাকা হতে দু একজন মন্ত্রীও নাকি ব্যবহার করেছে গোপনে। হত্যা, গুম আর চাঁদাবাজি সহ এমন কোন কাজ নেই যা তাকে করতে হয়নি। বিলের মালিকানা নিয়ে স্থানীয় এমপি আর চেয়ারম্যানের গোলমালের শিকার হয়ে এর আগেও দুয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে রেবের হাতে। এ যাত্রায় এমপির হয়ে কাজ করতে রাজী হয়নি বলেই বোধহয় প্রাণ দিতে হল তাকে।
মুর্শেদের কথাটা আটকে রইল মাথায়। শেষরাতে এমন একটা খোয়াব না দেখলেও বোধহয় চলত। খোয়াব না হয়ে স্বপ্ন হলেই বোধহয় বেঁচে যেত ফজর। নিজেকে সান্তনা দেয়ার আর কোন রাস্তা খুঁজে পেলাম না। স্বপ্নটা উল্টো হলে কার এমন ক্ষতি হত ভেবে পেলাম না।