পৃথিবীর কোথাও হয়ত এখন মধ্যরাত, কোথাও আবার ভরদুপুর। রাতে রাতেও হয়ত পার্থক্য। কোথাও জোৎস্নার প্লাবন কোথাও বা আবার ঘন অমানিশা। প্রকৃতির নিয়মে আমাদের হাত নেই, চাইলেও আমরা তা বদলাতে পারি না। বাকি বিশ্বের প্রকৃতিতে আজ যাই থাকুক দুরের দেশ মিশরে আজ কেবলই আলোর বন্যা। দেশের ৮ কোটি মানুষের প্রায় সবাই এখন রাস্তায়। আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভাসছে গোটা জাতি। ৩০ বছরের স্বৈরতন্ত্র আর ৬০ বছরের একনায়কতন্ত্র ১৮ দিনের গণজোয়ারে ভেসে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। ১৮ দিন আগের পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক আজ নাম লিখিয়েছেন পতিতার খাতায়। ফিলিপিনসের ফার্ডিনান্ড মার্কোস আর ইরানী শাহ রেজা পাহলভীর মত তাকেও এখন ধর্ণা দিতে হবে পৃথিবীর দুয়ারে দুয়ারে। নিরাপদ একটা আশ্রয়ের জন্যে ৭০ বিলিয়ন ডলারও যে যথেষ্ট নয় পতিত স্বৈরশাসকের তা অনুধাবন করার সময় এসেছে। রাজতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের শেষ আখড়া সৌদি আরব অথবা গলফ স্টেট গুলোর কোন একটায় হয়ত ঠাঁই হবে শেষ পর্যন্ত, এবং এখানেই নীরবে নিভৃতে মৃত্যু হবে এককালের শক্তিশালী একনায়ক হোসনি মোবারকের। ইতিহাস শুধু প্রাণহীন কটা পাতা নয়, এরও হাত-পা আছে, আছে একটা মুখ যা দিয়ে সে কথা বলে। রুমানীয়ার চসেস্কু, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো, তিউনিশিয়ার বেন আলী আর কাছাকাছি দেশ ফিলিপিনোদের ফার্ডিনান্ড মার্কোসরা যে পথে হেটে গেছেন সে পথেই হাঁটতে হয় ক্ষমতালিপ্সু ডিক্টেটরদের, এটাই ইতিহাসের অমোঘ পরিণতি। হোসনি মোবারকের ভাগ্য নতুন করে তা প্রমাণ করে গেল। বুখারেস্ট, জাকার্তা, তিউনিস আর ম্যানিলার পর কায়রো; ধোঁকাবাজি আর ছলচাতুরীর বিরুদ্ধে জনগণের চিরন্তন বিজয়ের ঐতিহাসিক ধারায় সংযোজিত হল নতুন একটা অধ্যায়, মিশরীয় অধ্যায়। যুক্ত হল একটা জাতির ইতিহাসে কিছু নতুন পাতা। প্রশ্ন জাগবে, এখানেই কি থেমে যাবে মিশরীয় ইতিহাসের চাকা? সামনের ঘটনা প্রবাহ জানতে আমাদের বোধহয় আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমাদের জানা আছে মিশরের অতীত ইতিহাস। ইতিহাস নিজেই কথা বলে। এর পরিণতি হতে কেউ মুক্ত নয়।
মিশরীয় ইতিহাস হতে শিক্ষা নেয়ার তাগাদা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় কি কড়া নাড়ছে আমাদের দরজায়? অনেকে হয়ত চোখ মাথায় তুলবেন এবং নীল নদের দেশটার রাজনীতির তুলনায় আমাদের রাজনীতির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ডুগডুগি বাজাবেন। সাদাকে সাদা বলতে যারা অভ্যস্ত তারা হয়ত বড় গলায় পার্থক্যটা তুলে ধরবেন, আমরা গণতন্ত্রী, ওরা নয়। আমাদের ইতিহাসটাই এ রকম, সাদার ভেতরও এমন এক সাদা থাকে যা বাইরে সাদা মনে হলেও ভেতরে নয়। মিশরীয় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে আমাদের বাস্তবতার বিস্তর তফাৎ। আমাদের রাজনীতি ভোটমুখী। খালি চোখে দেখার মত স্বৈরশাসক নেই এখানে। শাসক দলের অপর পিঠেই এখানে বিরোধী দলের বাস। মিডিয়ায় আছে বহুদলীয় গন্ধ। শুধু কথায় নয় কাজেও এখানে গণতন্ত্রের জয়জয়কার। চাইলে গোটা একটা শহর জ্বালিয়ে দেয়া যায় বিনা বাধায় ও বিনা বিচারে। কিন্তু অতি-গণতন্ত্রের সাদা আস্তরণের নিচেই বাস করে আসল বাংলাদেশ। মিশরের মত কেবল একজন নয়, এখানে দুই দুইজন স্বৈরশাসকের বাস। হোসনি মোবারকের স্বৈরতন্ত্র ফুটে উঠত মিশরীয়দের চেহারায়, সে তুলনায় আমাদের দ্বি-স্বৈরতন্ত্র অনেকটা ভুতুড়ে, যা খালি চোখে দেখা যায়না।
একজন হোসনি মোবারকের সাথে আমাদের দ্বি-স্বৈরতন্ত্রের পার্থক্যটা কোথায়? মোবারক দেশ শাসনের নামে একনাগাড়ে ৩০ বছর লুটে নিজ ভান্ডারে জমা করেছেন ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বলা হচ্ছে পরিবারের বাকি সদস্যরাও এ দৌড়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। মাঝখানে এরশাদের নয় বছর বাদ দিলে পারিবারিক জাঁতাকলে আমরাও পিষ্ট হচ্ছি ৩০ বছর ধরে। এখানে গণতন্ত্র মানেই দুই নেতার এক দেশ। এক বনে দুই রাজার মত এখানেও গণতন্ত্রের নামে চলে রক্তাক্ত লড়াই। যোগ্যতা নয়, ক্ষমতার মানদণ্ড এখানে পারিবারিক পরিচয়। মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্মগত অধিকার আদায়ের জন্যেই মানুষকে রাজপথে নামতে হয়, লড়াই করতে হয়, ছিনিয়ে আনতে হয় স্বাধীনতা। আমদেরও লড়তে হয়েছিল স্বাধীনতার জন্যে। কিন্তু স্বাধীনতার আসল প্রাপ্তিকে পারিবারিক প্রাপ্তির গোরস্তানে দাফন করতে খুব একটা সময় নেননি দ্বি-স্বৈরতন্ত্রের অগ্রপথিকরা। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা,বাসস্থান, শিক্ষা, আইনের শাসন ও স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর অধিকার বাস্তবায়নের স্বপ্ন শুরুতেই সমাহিত করা হয়েছে একজন শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান মূল্যায়নের কফিনে। দুজনই মাটির সাথে মিশে আছেন সার হয়ে। কিন্তু আমরা বাধ্য হচ্ছি সে সারের পুজা করতে। আর এই সার হতে জন্ম নিয়ে জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানের মত আধা শিক্ষিত আর কুশিক্ষিত নেতা-নেত্রীর দল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতীয়তাবাদের তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে ১৭ কোটি মানুষের একটা জাতিকে নেশাগ্রস্ত বানিয়ে লুটেরার দল লুটে নিচ্ছে সম্পদের পাহাড়। হোসনি মোবারকের বিলিয়নের তুলনায় আমাদের নেত্রীদের সম্পদ যে কম যায়না তার কিছুটা হলেও নমুনা পাওয়া গেছে ইতিমধ্যে।
দেশীয় গণতন্ত্র, যা নিয়ে আমাদের এত গর্ব, তার আসল চেহারা দেখতে ঘুরে ফিরে আমাদের একটা প্রশ্নের উওর খুঁজতে হবে, আর তা হল, ব্যক্তি হাসিনা-খালেদা কতদিন বাঁচবেন এবং কে হবে তাদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী? এর উওর যদি যথাক্রমে জয় ওয়াজেদ ও তারেক জিয়া হয় জাতি হিসাবে আমাদের বোধহয় গণ-আত্মহত্যা করা উচিৎ। গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে যা চলছে তা হোসনি মোবারকের একনায়কতন্ত্রের চাইতেও ভয়াবহ। এখানে যা হচ্ছে তাতে থাকছে গণতন্ত্রের লেবাস, যা অত্যন্ত সফল ভাবে আড়াল করছে এর আদি ও অকৃত্রিম চেহারা, বাংলাদেশি চেহারা।
জগদ্দল পাথরের মত মিশরীয়দের বুকে চেপে বসা হোসনি মোবারকের পতনের শুরুটা ছিল কিন্তু সোস্যাল মিডিয়া ফেইস বুক হতে। তিউনিশিয়ায় বেন আলীর পতনের পর একদল তরুণ প্রথম দাবি জানায় মোবারক লেগাসির শেষ অংকের। দাবানলের মত ছড়িয়ে পরে সে দাবি। নেতার প্রয়োজন হয়নি, জ্বালাময়ী ভাষণও স্থান পায়নি এত বড় একজন ডিক্টেটর কে উৎখাত করতে। মিশরীয়রা সোস্যাল রেভুল্যুশন হিসাবে আখ্যায়িত করছে নিজেদের প্রাপ্তিকে। চাইলে আমরাও কি পারিনা এ পথে হাটতে? আজ হতে ২০ বছর পর যা অবধারিত তার শুরুটা কি এখনই হতে পারে না? আর কতদিন অন্ধ থাকতে হবে আমাদের? আর কত সয্য করতে হবে রাজনীতি নামের এসব নারকীয় তান্ডব আর নির্জলা ভণ্ডামী? হাসিনা-খালেদা লেগাসির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে ব্লগ জগতই হতে পারে পার্ফেক্ট ব্রিডিং গ্রাউন্ড। আসুন এদেরও রাস্তা দেখাই; মোবারকের রাস্তা, বেন আলীর রাস্তা, সুহার্তোর রাস্তা, চসেস্কুর রাস্তা। হয়ত সৃষ্টি হবে শূন্যতা, দেশজুড়ে হয়ত রাজত্ব করবে গভীর নৈরাজ্য। কিন্তু এ শূন্যতা আর নৈরাজ্যের গর্ভেই হয়ত জন্ম নেবে আসল নেত্রীত্ব, যোগ্য নেত্রীত্ব, যারা ১৭ কোটি মানুষের অনিশ্চিত যাত্রায় এনে দেবে নতুন আশা। যোগ্য মানুষের কমতি নেই আমাদের সমাজে। কিন্তু যতদিন পারিবারিক ক্ষমতায়নের কলঙ্কিত অধ্যায়ের কবর না হচ্ছে নেত্রীত্ব তৈরীর প্রকোষ্ঠগুলোতে রাজত্ব করবে অযোগ্য, অপদার্থ আর রক্তচোষা একদল হায়েনা। আসুন কলম ধরি এদের বিরুদ্ধে। মিশরীয়রা পারলে আমরাও পারব।