ছবিগুলো দেখি আর নিজেকে দাঁড় করাবার চেষ্টা ওদের জুতায়। একই জুতা যদি আমাকে পরতে হত অবস্থাটা কি দাঁড়াত ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। সাড়া জীবনের সঞ্চয় কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে খুইয়ে রাস্তায় ভাংচুর করছি, ছবিটা বিদেশে বসে অস্বাভাবিক মনে হলেও দেশে অহরহই ঘটছে এবং কে জানে, তাদের সাথে মিশে গিয়ে হয়ত আমিও ঝাপিয়ে পরতাম চলমান কোন রিক্সা অথবা গাড়ির উপর। আমেরিকার অর্থনীতির গতি তখন দক্ষিণমুখী। পুঁজি বাজারে এর প্রতিফলন হচ্ছে প্রতিদিন। ছয় বছর পরিশ্রমের প্রায় সবটা বিনিয়োগ করেছিলাম ওয়াল ষ্ট্রীটে। দু সপ্তাহেই হাওয়া গেল বিনিয়োগের ৯০ ভাগ। আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমের ছোট্ট এই শহরটায় ভাংচুর করার কিছু ছিলনা, তাই ধকলটা গেল আমার তিন বছরের সার্বক্ষনিক সংগী প্রিয় লেপটপটার উপর দিয়ে। দরপতনের রোলার কোস্টার সামাল দেয়ার মত যথেষ্ট নার্ভ না থাকায় থামাতে হল এ পাগলামি। অবস্থা বদলাচ্ছে ধীরে ধীরে। মার্কিন অর্থনীতিও ফিরে পাচ্ছে তার পুরানো গতি। যে কোম্পানী গুলোতে বিনিয়োগ করে ফতুর হয়েছি তার প্রায় সবকটির মূল্য এখন উর্ধ্বমুখী। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, আমি ধরা খেয়েছি ওয়াল স্ট্রীটের জুয়া খেলায়।
কাকে দায়ি করতে পারতাম আমার এ অপ্রত্যাশিত ক্ষতির জন্যে? বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝড় আসছে এর পূর্বাভাস ছিল সর্বত্র। মার্কিন হাউজিং ইন্ডাস্ট্রি ফুলে ফেঁপে এতটা উপরে উঠে গিয়েছিল এর পতন ছিল সময়ের ব্যাপার। তাই ঘটল বুশ শাসনের শেষ দিকে। তাসের ঘরের মত ধ্বসে পরল ফুটন্ত হাউজিং ইন্ডাষ্ট্রি। ডমিনো এফেক্ট দেখা দিল অর্থনীতির অন্যান্য শাখায়। বুঝতে পারেনি এ সব, তাই বোকার মত ঝাপ দিলাম পতনোন্মুখ বাজারে। ব্যাংক অব আমেরিকা, সিটি ব্যাংক, এমবাক ইন্সুরেন্স, লাগ ভেগাস স্যান্ডসের মত জাঁদরেল কোম্পানী গুলোর শেয়ার কচুপাতার পানির মত ভেসে গেল। ভাবলাম রাতারাতি বড় হওয়ার এই তো সুযোগ। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাষ উপেক্ষা করে কিনতে থাকলাম এক কালের জায়ান্ট কোম্পানী গুলোর শেয়ার। কিন্তু পতনের গতি অনেকটা ব্রেকহীন গাড়ির মত এগিয়ে চলল। কোন এক সুন্দর সকালে ব্রোকারেজ কোম্পানীর ফোন পেয়ে বুঝে গেলাম রাতারাতি ভাগ্য বদলানো জুয়া খেলা এ যাত্রায় শেষ।
আমেরিকায় সিএনবিসি নামের একটা ক্যাবল চ্যানেল আছে যেখানে মার্কেট গুরু জিম ক্রেমারের ’ম্যাড মানি’ অনুষ্ঠানটা প্রচারিত হয়। মার্কিন অর্থনীতির বেসামাল অবস্থার মধ্যভাগে ক্রেমারের একটা মন্তব্যে অবাক এবং বিচলিত হলাম। বিশ্ব অর্থনীতির ঘোলাটে ও অনিশ্চিত বাস্তবতার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে টেনে আনলেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বর্ণনা করলেন অর্থনীতির নিয়ম কানুনে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কি করে বাংলাদেশের পুঁজি বাজার রকেট গতিতে এগিয়ে চলছে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই ফোন করলাম দেশে। ভাই-বোনদের সবার কাছে জানতে চাইলাম শেয়ার মার্কেটে কেউ বিনিয়োগ করছে কি-না। এ ফাঁকে দেশ হতে গোটা বিশেক ফোন পেয়েছিলাম টাকা পাঠানোর জন্যে। ভাতিজা, ভাগ্নে, বন্ধু-বান্ধব সহ অনেকে পুঁজির জন্যে অনুরোধ করছে। সবার যাত্রা এক ঠিকানায়, শেয়ার মার্কেট। ওয়াল স্ট্রীটের ধাক্কা কাটিয়ে উঠার মত যথেষ্ট শক্তি ছিলনা তাই নতুন করে এ রাস্তায় হাঁটার কোন ইচ্ছে হল না। শুধু তাই নয়, যারা টাকার জন্যে ঘন ঘন ফোন করত তাদের সবাইকে সাবধান করে দিলাম সম্ভাব্য পরিণতির জন্যে। আমার হুঁশিয়ারী আমলে নিয়ে কেউ উপকৃত হয়েছে কিনা জানিনা, তবে দেশের পুঁজি বাজারে যে ধ্বস নামতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা।
তাই হল শেষ পর্যন্ত। ফুটন্ত পুঁজিবাজারের অন্ধকার ও কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে এল নেংটা হয়ে। দেশীয় রাজনীতির আয়না হয়ে আবির্ভূত হল বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। ভাগাড়ে শকুনের দল যেভাবে মৃত পশু খুবলে খায় একই কায়দায় এ দেশের রাজনীতিবিদ ও তাদের নিয়ামক শক্তিগুলো লুটে নিল লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর কষ্টের পয়সা। চাঁদাবাজিতে সমস্যা অনেক, অনেক বিজাতীয় সরকার এসে বেকায়দায় ফেলে দেয় এর আর্কিটেক্ট দের। তাই চাঁদাবাজীর নতুন পথ আবিষ্কার করতে বাধ্য হল রাজনীতির পশু শক্তি। পুঁজিবাজার ম্যানিপুলেশ করা খুব সহজ বিশেষ করে যে সব দেশে আইনের শাসন নেই। এ বিবেচনায় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন। ওয়াল স্ট্রীটও মাঝে মধ্যে আক্রান্ত হয় ইনসাইডার ট্রেডিং ও হেজ ফান্ড গুলোর ম্যানিপুলেশনে। কিন্তু এ দেশে আইন আছে তাই মার্থা স্টুয়ার্টদের মত রুই কাতলাদেরও জেল খাটতে হয় শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির কারণে। জাতীয় চরিত্রের বিবেচনায় বাংলাদেশি পুঁজিবাজারকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করালে সন্দেহ নেই রুই কাতলাই কিলবিল করবে আসামীর কাঠগড়া। দলীয় বিভেদ, নেত্রী বিভেদ, পিতা-ঘোষক বিভেদ, মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার বিভেদ, কোন বিভেদই ভূমিকা রাখে না জাতীয় লুটপাটে। লুটের বাজারে ওরা এক মার পেটের খালাত ভাইয়ের মত।
ঘটনাটা হয়ত অনেকের মনে নেই। একটা সময় ছিল যখন শেখ পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল নড়বড়ে। এমনই এক সময় পরিবারের অন্যতম সদস্যা শেখ রেহানার স্বামী সিংগাপুরের এক হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলেন। স্বামীর কষ্টলি ব্রেইন সার্জারী করার মত যথেষ্ট অর্থ নেই শেখ রেহানার হাতে। এমনি এক পরিস্থিতিতে খোলা পকেটে এগিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের অন্যতম আর্থিক কনট্রিবিউটর সালমান এফ রহমান। বহন করলেন সার্জারির যাবতীয় খরচ। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি মি রহমানকে। আওয়ামী লীগের প্রথম টার্মেই পুঁজিবাজার হতে সুদে-আসলে উঠিয়ে নেন শেখ পরিবারে বিনিয়োগকৃত অর্থ। শেয়ার বাজারে লুটে নেয়া অর্থ অলিগলি পার হয়ে শেষ পর্যন্ত কোন বন্দরে ঠাঁই নেয় তার ট্রেইল ঘাঁটলে আরও অনেক চমকপ্রদ উপাখ্যান বেরিয়ে আসতে বাধ্য। শুনছি গোয়েন্দাদের নজরদারীতে আছেন অনেক রুই-কাতলা। বেশ কটা কমিটিও বানানো হয়েছে পুঁজি বাজারের লুটপাট তদন্তের জন্যে। যথারীতি কাউকে না ছাড়ার কথাও ঘোষণা দিয়েছেন সরকার প্রধান সহ বিখ্যাত স্বরাষ্ট্র ও বানিজ্য মন্ত্রীদ্বয়। এসব মাংকি মন্ত্রী আর ক্যাঙ্গারু বিচারকদের নিয়ে নজিরবিহীন এ কেলেঙ্কারির তদন্ত হবে অনেকটা শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মত। শেয়ার বাজারের মধু যাদের শয়নকক্ষে যাওয়ার তা চলে গেছে, এ নিয়ে তদন্ত করলে কেবল নতুন কজন জজ মিয়ার নাম সামনে আসবে।
শুনছি হাসিনা সরকার জাহাজ ভাংগাকে শিল্প হিসাবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে। আমার মন্তব্য চাইলে ভাল একটা উপদেশ দিতে পারতাম। ডকে পাঠানোর আগে জাহাজ গুলোকে মতিঝিলের কোন এক মোড়ে প্রদশর্নীতে রাখলে কলা বেচা ও রথ দেখার মত একসাথে দুই কাজ হয়ে যেত। পুঁজি বাজারে নিঃস্ব হওয়া বিনিয়োগকারীর দল নিরীহ রিকশাওয়ালাদের উপর চড়াও না হয়ে চড়াও হত জাহাজ গুলোর উপর। আর তাতে একদিকে যেমন বিনিয়োগকারীদের আক্রোশ প্রশমিত হত পাশাপাশি জাহাজ গুলোও খুঁজে পেত তাদের নির্ধারিত চেহারা।