এ লেখাটা ভ্রমণ কাহিনী নয়। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তাদের কাছে যারা এমনটা ভেবে লেখাটা পড়তে আগ্রহী হয়েছেন। কাঁচা হাতে দু'একটা ভ্রমণ কাহিনী লেখার চেষ্টা করেছিলাম। অনেকের ভাল লেগেছে। অনেকে আবার উৎসাহ দিয়ে চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। ইচ্ছাটা মরে যায়নি, বলতে পারেন সুযোগের অপেক্ষায় আছি। ’এন্ডিজ পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে’ সিরিজটার মত বিশাল একটা ক্যানভাসের প্রহর গুনছি। তবে চাইলেও বোধহয় এসব নিয়ে লিখতে পারব না এ মুহূর্তে। আমার একজন প্রিয় মানুষ আজ আক্রান্ত। নিরাপদ বলয়ের বসবাস হতে প্রিয় মানুষটার জন্যে কিছু করার নেই এক লেখালেখি ছাড়া। বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকতে তাই লিখতে হচ্ছে। শুধু আজ নয়, মানুষটার উপর হায়েনাদের হিংস্র থাবা যতদিন উদ্যত থাকবে ততদিন আমাকে লিখতে হবে। এ আমার প্রতিজ্ঞা, নিজের কাছে নিজের প্রতিশ্রুতি। সহজে পিছু হটছি না এ প্রতিজ্ঞা হতে।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আমার প্রিয় লেখকদের একজন। পরিচয় এবং ভাল লাগার সূত্রপাত লেখকের 100 años de soledad (One Hundred Years of Solitude) উপন্যাসটা হতে। এরপর আর পিছু ফিরতে হয়নি। আমাদের পাঠাভ্যাসে ভার্চুয়াল দুনিয়া বড় ধরণের পরিবর্তন এনেছে, বই পড়াও এ হতে বাদ যায়নি। কিন্তু মার্কেজের লেখালেখির বেলায় ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, না পড়লেই নয় এ লেখকের লেখা। লিও টলস্টয় আর আর্নেস্ট হেমিংওয়ে পর কারও লেখা পড়ায় এতটা তাগাদা অনুভব করিনা যেমনটা করি এই লেখকের বেলায়। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সেবার দক্ষিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায়। রাজধানী বোগোটায় এর আগেও গেছি ক’বার। একজন পর্যটকের যা দেখার তার সবটাই দেখা হয়েছিল প্রথম যাত্রায়। তাই এ যাত্রায় রাজধানী ছেড়ে মফস্বলের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে হলিডে রিসোর্ট সানতা মার্তা, তারপর গায়িকা সাকিরার জন্মস্থান বারাংকিয়্যা হয়ে পা বাড়ালাম সাগর পাড়ের শহর কার্তাখেনা দ্যা ইন্ডিয়ার দিকে। ক্যারাবিয়ান সাগরের নীল জলরাশি আর এর উত্তাল ঢেউগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে বছর জুড়ে লেগে থাকে এখানে পর্যটকের ভীড়। আমিও মিশে গেলাম এদের ভীড়ে। সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি পৃথিবীর এ অংশে আসার আরও একটা কারণ ছিল, প্রিয় লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়ায় শহরকে কাছ হতে দেখা। এপিক উপন্যাস ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড লিখতে গিয়ে এ শহরেও নাকি বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন লেখক।
Chiva নামের এক ধরণের পরিবহন আছে দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। দেখতে অনেকটা মোহম্মদপুর-গুলিস্তান রুটের টাটা কোম্পানীর বাস গুলোর মত। আকারে বেশ ছোট। বাস গুলোকে ব্যবহার করা হয় মূলত বিনোদন কাজে। কার্তাখেনা ভ্রমনে এলে চিভা অভিজ্ঞতা অনেকটা যেন বাধ্যতামূলক। সহজে কেউ মিস করতে চায় না সাগর পাড়ের লাতিনো অভিজ্ঞতা। আমিও করলাম না। রং আর আলোর ঝলকানির সাথে লাতিনো সাম্বা, মেরেংগে, কুম্বিয়া নাচের লাগামহীন উদ্দামতা কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভুলিয়ে দেয় বেচে থাকার কঠিন বাস্তবতা। সংখ্যায় আমরা ১৫ জন। বেশির ভাগ ট্যুরষ্ট এবং এসেছে প্রতিবেশি দেশ ভেনিজুয়েলা হতে। সাথে ১ জন অস্ট্রেলিয়ান, ২ জন জাপানী এবং ১ জন ইউরোপীয় দেশ লুক্সেমবার্গের। কলম্বিয়ান গাইড নিজের পরিচয় দিয়ে বাকি সবাইকে নিজ নিজ পরিচয় প্রকাশ করতে অনুরোধ করল। ভেনিজুয়েলানদের অনেকে নিজের নাম বলার সাথে ভিভা ভেনিজুয়েলা এবং ভিভা হুগো শাভেজ বলে শেষ করলো নিজের পরিচয়। দেশটার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের নাম উচ্চারণের সাথে কেউ উল্লাস করল কেউবা আবার ধুয়ো দিল। সব শেষে আমার পালা। মার্কিন পাসপোর্টধারী হলেও আমার পরিচয় যে একজন বাংলাদেশি তা গর্ব করেই বললাম। কয়েক সেকেন্ড সময় নিল গাইড, স্পেনিশ অনুবাদ শেষ হতে করতালিতে ফেটে পরল সবাই। অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম সহযাত্রীদের অপ্রাত্যিশ আচরণে। করতালির কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। হুগো শাভেজের সমর্থক আর বিরুদ্ধবাদীরা এ যাত্রায় এক হয়ে গেল। হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। গিন্নিকে অনুরোধ করলাম কারণটা খুঁজে বের করতে।
গাইড বুঝতে পারল আমার অবস্থা। ভেনিজুয়েলানদের কেউ একজন দাঁড়িয়ে পাক্কা পাচ মিনিটের একটা ভাষন দিল। স্প্যনিশ বুঝিনা, কিন্তু খুব অসুবিধা হলনা ভাষণের সারমর্ম উদ্ধার করতে, ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের কথা বলছে ওরা! বঙ্গোপসাগর পার হয়ে দক্ষিন আমেরিকার দেশে দেশে ঢেউ লেগেছে ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের মাইক্রোক্রেডিট। ওরা গর্বিত কারণ বাংলাদেশের মত ভেনেজুয়েলাও তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ। লম্বা প্রবাস জীবনের এই পাঁচটা মিনিট ছিল জীবনের সবচাইতে সুন্দরতম মুহূর্ত। গর্ব হল দেশের জন্যে। কিছু একটা বলতে চাইলাম কিন্তু কথা বের হলনা। হঠাৎ মনে হল, ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস নয়, নোবেল পেয়েছি আসলে আমি। ওরা মাথা নত করল আমার সামনে। একজন নোবেল জয়ী বীরের মত মাথা উঁচু করে কাটিয়ে দিলাম সাড়াটা রাত।
ইউনুস স্যারকে আমি দেখিনি, কোনদিন দেখব বলেও মনে হয়না। পাঠকদের কারও সাথে দেখা হলে এই অখ্যাত ওয়াচডগের কৃতজ্ঞতাটা পোঁছে দিলে সারা জীবনের জন্যে ঋণী থাকব। ৫ মিনিটের জন্যে হলেও স্যার আমাকে সম্মানের সর্বোচ্চ আসলে বসিয়ে ছিলেন। ঝড়-ঝাপটা, তুফান-জলোচ্ছাস, বন্যা, ক্যু আর রাষ্ট্রীয় চোরের লীলাভূমিকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও গর্ব করেছিলাম। গর্ব করছিলাম একজন বাংলাদেশি হিসাবে। একদল চোর ও চেতনা ব্যবসায়ীর গ্যাঁড়াকল ইউনুস স্যারের মত বিশাল ব্যক্তিতে অপদস্থ করার জন্যে যথেষ্ট নয়, তার জন্যে চাই ক্যারাবিয়ান সাগরের উন্মত্ত ঢেউ। সে ঢেউ স্যারের দিকে নয় বরং ধেয়ে আসবে লুটেরাদের দিকে, সময়ই তা প্রমান করবে। দুই নেত্রীকে একঘরে বন্ধ রেখে নিজেদের ভেতর কথা বলার আহ্বান জানিয়েছিলেন জোবরা গ্রামের ইউনুস মাষ্টার। আমি বলি কথা বলা নয়, আটকে রেখে আগুন লাগিয়ে দেয়া হোক সে ঘরে। আর সে আগুনে জ্বলে পুড়েই হয়ত জন্ম নেবে নতুন এক বাংলাদেশ।