আরও অনেক ব্যাংক আছে বাংলাদেশে, এত ব্যাংক থাকতে শুধু গ্রামীন ব্যাংক নিয়ে কেন এত মাতামাতি বুঝতে একটু কষ্ট হয়। ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসই কি বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংকার যাকে নিয়ে হৈচৈ করতে হবে? আবদুল জলিল, মোসাদ্দেক হোসেন ফালু আর আখতারুজ্জামানরা কি বিশিষ্ট ব্যাংকার নন, উনাদের নিয়ে কেন কথা হয়না? গ্রামীন ব্যাংকের শতকরা সাড়ে তিন ভাগের মালিক সরকার এবং বাকি ৯৬ দশমিক ৫০ ভাগের মালিক এর ৮৩ লাখ গ্রাহক। বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে একটা জুটমিলের বেশ কিছু শেয়ারের মালিক হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল (হয়ত এখনও আছি)। পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত মিলটির উদ্যোক্তাদের সবাই ছিলেন দেশি। দেশি মানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী। ভালই চলছিল জুটমিল ব্যবসা। বাধ সাধল সহস্রাব্দের সেরা বাঙালীর সমাজতন্ত্র। কলমের এক খোঁচায় হাতছাড়া হয়ে গেল ২০ বছরের পরিশ্রম। ৭৫’এর পট পরিবর্তনের পর অবশ্য তা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ততদিনে এ আর জুটমিল থাকেনি , পরিনত হয়েছিল মৃত আওয়ামী কংকালে। মিলটি চালু করতে নগদ অর্থের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় সাহায্য নিতে হল সরকারের। সরকার দেখিয়ে দিল সোনালী ব্যাংকের রাস্তা। ব্যাংকটির কাছে মিলের ৪৯ ভাগ শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে চালু করা হয় প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের আমিও তখন সক্রিয় সদস্য। পর্ষদে ব্যংকের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠানো হয় একজন উঁচুদরের সরকারী ব্যাংকারকে। মিল মালিকানা নিয়ে ৪৯-৫১ ভাগের লড়াই হতে দেখিনি, কেবল বছরে একদিন প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক সাধারণ সভায় দেখা হত সরকারী প্রতিনিধির। সভা শেষে পেটমোটা একটা খাম নিয়ে হাসি মুখে চলে যেতেন ভদ্রলোক এবং ব্যাংকে ফিরে চমৎকার একটা রিপোর্ট দিতেন প্রতিষ্ঠানটির স্বাস্থ্যের উপর। এই পেটমোটা খামটাকে ঠাট্টাচ্ছলে আমারা সবাই অক্সিজেন মিয়া বলে আখ্যায়িত করতাম। বাস্তবেই রুগ্ন এ প্রতিষ্ঠানটা চালু রাখতে এ ধরণের অক্সিজেনের বিকল্প ছিলনা। কিন্তু দিন বদলের সাথে অক্সিজেনের চাহিদা এত বেশি বৃদ্ধি পায় যা মালিক পক্ষের সাধ ও সাধ্যের বাইরে চলে যায়। রুগির অবধারিত মৃত্যু তরান্বিত হয় মহান জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দফার ঐতিহাসিক ক্ষমতায়নে। শুনেছি প্রতিষ্ঠানটি এ মুহূর্তে লাশ হয়ে শুয়ে আছে কোন বাংলাদেশের কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
গ্রামীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ হতে ডক্টর মো ইউনূসের বিদায়ের একদিনের মাথায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এর আমানতকারীরা। নগদ টাকা না থাকায় চাহিদা মেটাতে পারছেনা অনেক শাখা। পাশাপাশি ব্যাংক হতে অতীতে বহিস্কৃত শত শত কর্মচারী চাকরী ফিরে পাওয়ার আন্দোলন শুরু করেছে। এক কথায়, সোনালী আর রূপালী নামের যেসব লাল-নীল ব্যাংক আছে গ্রামীনকে তাদের এক কাতারে শামিল করার চমৎকার প্রেক্ষাপট তৈরী করে দিয়েছেন যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা। সন্দেহ নেই স্বাভাবিক ধারাতেই জন্ম নেবে গ্রামীন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শাখা) এবং এর বিরোধী দল। কালের চক্রে মানুষের স্মৃতি হতে হয়ত মুছে যাবে এর জন্মদাতা ডক্টর মোহম্মদ ইউনূসের নাম এবং ঘুরে ফিরে উচ্চারিত হবে আমাদের সবার পরিচিত পিতা আর ঘোষকের নাম। লাশ হওয়া জুটমিল সৃষ্টিতে শেখ মুজিবের কোন হাত ছিলনা, এর পেছনে পরিশ্রম ছিল একদল নিবেদিত শিল্পপতির। শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গিনিপিগ বানিয়ে ধ্বংস করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত একটা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে। বাবার যোগ্য সন্তানের মতই কন্যা শেখা হাসিনা হাত দিয়েছেন গিনিপিগ প্রকল্পে। এ যাত্রার শিকার গ্রামীন ব্যাংক।
বাংলাদেশের সমসায়িক বাস্তবতায় যারা খুশি তাদের জন্যে এ লেখা নয়। বরং তাদের অনুরোধ করব চোখ ধাঁধানো উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান সমৃদ্ধ ক্রিকেট নিয়ে সময় ব্যয় করতে। আমার মত যারা দেশ নিয়ে অখুশি তাদের কলমে ঘুরে ফিরে ইউনূস প্রসঙ্গ আসবেই। এ নিয়ে কারও চুলকানি দেখা দিলে করার কিছু নেই। শুরুতে অন্যান্য ব্যাংকের প্রসঙ্গ টেনেছিলাম। যারা দেশিয় রাজনীতিকে খুব কাছ হতে পর্যবেক্ষণ করেন তারা হয়ত খেয়াল করে থাকবেন ক্ষমতা ভিত্তিক রাজনীতিতে বেশকিছু ’গুনগত’ পরিবর্তন হয়ে গেছে গেল ক'বছরে । একটা সময় ছিল যখন ক্ষমতার স্বাদ হতে রাজনীতিবিদগণ বাড়ি, গাড়ি, কিছু নগদ আর আয়েশি কটা বিদেশ ভ্রমণ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন। অবস্থা বদলে গেছে অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে, শুধু বাড়ি গাড়ি এখন আর যথেষ্ট নয়, একটা টিভি ষ্টেশন, একটা পত্রিকা এবং একটা ব্যাংক এখন ক্ষমতার বাধ্যতামূলক পুরস্কার। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আবদুল জলিল ব্যাংক, মেসার্স ফালু ব্যাংক, সর্বজনাব আখতারুজ্জামান ব্যাংক এবং এরকম আরও গন্ডা কয়েক ব্যাংক। গ্রামীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ব্যাংকটি দেশ হতে দারিদ্র বিমোচনে কোন ভূমিকা রাখতে পারছেনা। এবার আসুন একটু তলিয়ে দেখা যাক রাজনৈতিক ব্যাংক গুলোর দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচীর কিছু আলোকিত অধ্যায়।
মেসার্স আবদুল জলিল ব্যাংক কোন ঔরসে জন্মায় পাঠকদের আশাকরি তা ব্যাখ্যা করতে হবেনা। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নেত্রী ও দলীয় কর্মসূচীর সফল অর্থায়নের জন্যে ক্ষমতার শীর্ষ হতে জন্ম দেয়া হয় এসব দুধালো গাইকে। প্রয়োজনে ওরা দুধ দেয় এবং দুধের নহবতে মসৃন হয় ক্ষমতার সিঁড়ি, আর সিঁড়ির শীর্ষে উঠে অনেকের সন্তান বনে যায় বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক। এসব ব্যাংক দারিদ্র বিমোচনে সহযোগীতা করে বৈকি, তবে তা বিমোচন করে রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগী আমলাদের দারিদ্র। এ ধরণের ব্যাংক না হলে নাজমুল হুদার দুই মেয়ে মাসে ২০ লাখ আর বাকের ভাই খ্যাত আসাদুজ্জামান নুরের সন্তান কি করে বিলাতে লেখাপড়া করবে? দেশে লেখাপড়া করার দারিদ্র আর যাই হোক রাজনীতিবিদদের জন্যে শোভা পায়না। জনাব আখতারুজ্জামানকে বলা হয় আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের অন্যতম যোগানদাতা। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক শুধু আখতারুজ্জামানের ’দারিদ্র’ নয় বরং দূর করে থাকে অনেক মহিয়সীরও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দারিদ্র। মেসার্স ফালু ব্যাংকের কথা না হয় না-ই উল্লেখ করলাম। কথায় বলে বৃক্ষ নাম তার ফলে পরিচয়।
প্রশ্ন করা যায়, গ্রামীন জনগণের দারিদ্র বিমোচনের সংজ্ঞা আসলে কি? গ্রামীন ব্যাংক হাজার, দুই হাজার, পাঁচ হাজার, এ ধরণের ছোট অংকের লোন দিয়ে কর্মসূচীর সাফল্য দাবি করছে। নাইমুল ইসলাম খানের মত বিজ্ঞ সাংবাদিক এবং ব্লগ দুনিয়ার বিরাট একটা অংশের দৃষ্টিতে এ ধরণের ঋণ গ্রামীন জীবনে পরিবর্তন আনায় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পরির্তন বলতে এসব বিজ্ঞ জনেরা কি বুঝাতে চাইছেন আরা একটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। রাস্তার একজন ভিক্ষুককে ১০০০ টাকা লোন দিয়ে নিশ্চয় আশা করা ঠিক হবেনা সে আসাদুজ্জামান নুরের মত সহসাই সন্তানকে বিলাত পাঠিয়ে মানুষ করে ফেলবে? সে ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যেতে বাধ্য থাকবে এবং পাশাপাশি চেষ্টা করবে কিছু একটা করার। এই কিছু একটা করার নামই বোধহয় দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচী, অন্তত গ্রামীনের চোখে। সবাই কি সফল হয় এ পথে? নিশ্চয় না। সে সফলতায় এমন অনেক বাধা আসে যার জন্যে দায়ি করা যায় মেসার্স জলিল ব্যাংকের ভোক্তাদেরই। ধরা যাক একজন ফকিরকে ১০০০ টাকা ধার দেয়া হল। এই টাকায় বড়জোর সে খোলা আকাশের নীচে ছোট মত একটা পানের অথবা চিতই পিঠার দোকান খুলবে। ব্যবসা কতটা হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু যার নিশ্চয়তা থাকে তা হল এই টোকাই দোকানদার হতেও সরকারী পুলিশ চাঁদা উঠাবে, ক্ষমতাসীন দলের অংগ সংগঠন ছিনতাই করবে। এসবের ফাঁকেও গ্রামীন ব্যাংক তার কর্মসূচী নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে টিকে আছে এবং তাদের ব্যাংকিং খাতায় দেশের ৮৩ লাখ মহিলা নাম লিখিয়েছে। একটা ব্যর্থ কর্মসূচী কিভাবে এত বছর টিকে থাকে এবং কোন মন্ত্রবলে ৮৩ লাখ গ্রাহক আকর্ষন করে আশাকরি নাইমুল ইসলাম খান তার ব্যাখ্যা দিবেন।
ইউসুন স্যার পরাজিত হয়েছেন রাজনীতির মারপ্যাঁচে। বাবার নাম অমর করার ৫০,০০০ কোটি টাকার প্রকল্প আর ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস নাম পাশাপাশি চলতে পারেনা, এটা আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা। গ্রামীন ব্যাংক নয়, আমাদের প্রয়োজন আরও আবদুল জলিল ব্যাংক, ফালু ব্যাংক ও আখতারুজ্জামান ব্যাংক। যতদিন রাজনীতির দারিদ্র দূর করা যাচ্ছে না ততদিন গ্রামের গরীব, সহায়সম্বলহীন মহিলাদের দারিদ্র নিয়ে কথা বলা হবে অপরাধ। আর এ অপরাধের যথাযত শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের উচ্চ আদালত। গ্রামীন ব্যাংক সাগা এরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।