ছুটির আগে বাকি সবার মত আমাকেও এক মাসের প্রাকটিক্যালে যেতে হবে। সেমিষ্টার কার্যক্রমের এটা শেষ পর্ব। এর পর তিন মাসের ছুটি। হাতে একটা তালিকা ধরিয়ে পছন্দ করতে বলা হল। দুজন রুশ বন্ধুর সাথে জোট করে নাম লেখালাম ইউক্রেনের চেরনোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে। আগের বার থারমাল ও হাইড্রো প্লান্টে কাটাতে হয়েছিল ১৫ দিন করে। এ যাত্রায় নতুন কিছু দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে অপেক্ষায় রইলাম স্প্রিং টার্মের শেষ দিনের। দেশে যাওয়া হয়না অনেক দিন। এবারের ছুটিতে আর লন্ডন নয়, দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অপেক্ষার আর তর সইছিল না যেন। টিমের বাকি দুজনকে অনুমতি দিলেও আমাকে আটকে দিল শেষ পর্যন্ত। বলা হল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট সোভিয়েট রাষ্ট্রের স্ট্র্যাটিজিক পয়েন্ট, তাই বিদেশীদের জন্যে উন্মুক্ত নয়। কি আর করা, বাধ্য হয়ে স্থানীয় একটা থারমাল প্লান্টে নাম লেখালাম।
১৯৮৬ সালের ২৬ শে এপ্রিল। ক্যালেন্ডারের হিসাবে বসন্ত এসে গেলেও প্রকৃতিতে তখনও শীতের রাজত্ব। পৃথিবীর এ অংশটাই এরকম। শীত সহজে বিদায় নিয়ে চায় না। মে মাসের শেষ অথবা মধ্য এপ্রিলেও এখানে তুষারপাত হয়। তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে হিমাংকের নীচে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। খবরটা স্থানীয় মিডিয়াতে এলো না। অভ্যন্তরীন সমস্যা নিয়ে ন্যাশনাল মিডিয়াতে কথা বলা সমাজতান্ত্রিক অভ্যাস নয়, তাই চেপে গেল সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যম। রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে বিবিসির রুশ অনুষ্ঠান শুনার অভ্যাস অনেকদিনের। দরজা আটকে খুব গোপনে শুনতে হয়, কারণ সমাজতন্ত্রের চোখে এটাও এক ধরণের রাষ্ট্রীয় অপরাধ। খবরটা পেলাম ওখানেই। ভয়বহ কিছু একটা ঘটে গেছে ইউক্রেনের চেরনোবিলে। ঘটনার ম্যাগনিচুট বুঝার মত কারিগরী জ্ঞান না থাকায় অন্যদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করতে চাইলাম। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে রাজী হলনা। পরদিন গেলাম ডিপার্টমেন্টে। ওখানেও সুনসান নীরবতা, যেন কিছুই ঘটেনি। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত খবরটার রেফারেন্স দিয়ে জানতে চাইলাম আসল ঘটনা। অনেকে উলটো উপদেশ দিল পুঁজিবাদী প্রচার মাধ্যম যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার।
দুর্ঘটনার ইতিহাসের সবচাইতে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে চেরনোবিল পাওয়ার প্লান্টে। ইন্টারন্যাশনাল নিউক্লিয়ার ইভেন্ট স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭। প্লান্টের ৪ নাম্বার রিয়েক্টরের রুটিন কোর কুলিং সিস্টেম টেস্ট করার সময় শুরু হয় অতিরিক্ত পাওয়ার সার্জ। জরুরী ভিত্তিতে বন্ধ করতে গেলে তা চেইন রিয়্যাকশ্যনের মত ডেকে আনে আরও সার্জ। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের একটা রিঅ্যাক্টর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ঠান্ডা রাখতে প্রতি ঘন্টায় দরকার হয় প্রায় ২৮,০০০ লিটার পানি। অভ্যন্তরীন পাওয়ার ব্যাহত হওয়ার ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে চালু হয় রিজার্ভ জেনারেটর। কিন্তু চেরনোবিলে সময় নেয় ৬০-৭৫ সেকেন্ড। যার ফলে ক্ষণিকের জন্যে থমকে যায় প্লান্টের ওয়াটার পাম্প গুলো। ৩৭৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে গলতে শুরু করে রিয়েক্টরের কোর, এবং ফলে ঘটতে থাকে একটার পর একটা বিস্ফোরণ। বাতাসে হু হু করে ছড়িয়ে পরে রেডিও একটিভ সাবসটেন্স। পশ্চিম রাশিয়া হয়ে এ বিষ পাড়ি দেয় পূর্ব ইউরোপে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশের বাতাসও ভারী হয়ে যায় এর প্রভাবে। অশ্রুত ও অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক বিপর্যের মুখে পড়ে গোটা ইউরোপ। খোদ ইউক্রেনে কতজন প্রাণ হারিয়েছিল তার সরকারী কোন হিসাব নেই। ৫০ জন প্লান্ট কর্মী প্রাণ হারিয়েছিল শুধু এ সত্যটা সরকারীভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক গন আশংকা করছেন এ সংখ্যা আসলে কতটা হবে তার হিসাব কষতে আমাদের বোধহয় আরও শত বছর অপেক্ষা করতে হবে। ক্যান্সার, বিকলাঙ্গতার মত মরণব্যাধি গুলো চলতে থাকবে বছরের পর বছর ধরে। আমার রুশ দুই বন্ধুর ভাগ্যে কি ঘটেছিল কেউ জানতে পারেনি। শুনেছি ওরা বেঁচে আছে এবং কিরগিজস্তানের কোন এক পংগু হাসপাতালে রাষ্ট্রীয় গবেষণার গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহূত হচ্ছে।
রিখটার স্কেলে ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে জাপানের সেন্ডাই জনপদ। রাজধানী টোকিওর ৩৭৩ কিলোমিটার দক্ষিন-পূবে সাগরের তলদেশে সৃষ্ট ভূমিকম্প ডেকে এনেছে ভয়াবহ সুনামি। এপিসেন্টারের কাছে পানি ৩৩ ফুট পর্যন্ত ফুঁসে উঠে, এবং রাক্ষুসে শক্তি নিয়ে ঘন্টার প্রায় ৯০০ কিলোমিটার বেগে ধাবিত হয় জনপদের দিকে। ১০ লাখ বাসিন্দার এ শহরে প্রথম ছোবল হানে ভূমিকম্প, তারপর সুনামি। সরকারী হিসাব মতে মৃতের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৬৮০। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ এ সংখ্যা হবে অনেক বেশি। দুদিন আগের মূল আঘাতের পর নিয়মিত আফটার শক অনুভূত হচ্ছে, যার মাত্রা অনেকে ক্ষেত্রে হাইতির ভূমিকম্পের সমান। এ লেখাটা যখন লিখছি ভূমিকম্প ও সুনামির সাথে যোগ হয়েছে নতুন এক বিপর্যয়। এলাকার ফুকুশিমা ডায়েচি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের রিঅ্যাক্টর গুলোর তাপমাত্রা বিপদজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাপানিরা অস্বীকার করলেও মার্কিনিরা নিশ্চিত এরই মধ্যে একটা রিঅ্যাক্টরের কোর গলে গেছে এবং বাতাসে হু হু করে ছড়িয়ে পরছে রেডিয়েশন। ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে প্লান্টের নিজস্ব উৎপাদন যেমন বন্ধ হয়ে গেছে তেমনি নষ্ট হয়ে গেছে এর ব্যাকআপ সাপ্লাই। জরুরী ভিত্তিতে পাওয়ার সাপ্লাই চালু করা না গেলে গলে যাবে প্লান্টের বাকি রিঅ্যাক্টর গুলো, যা ডেকে আনবে স্মরণ কালের ভয়াবহ বিপর্যয়। জাপানী সরকার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছেনা মুহুর্মূহু ভূমিকম্প ও নতুন সুনামির আশংকায়। এলাকা হতে ইতিমধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
এ মুহূর্তে সেন্দাই শহরে কি ঘটছে তার বিশদ বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নেই, টেলিভিশন খুললেই এর ভয়াবহতা চোখে পরবে। এ যেন হলিউডের বিখ্যাত ছবি ’ডিপ ইমপ্যাক্টের’ মত। চারদিকে গা শিউড়ে উঠার মত দৃশ্য। রানওয়েতে যাত্রীবাহী বিমানগুলো পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে দেয়াশালাই বক্সের মত। এক কথায় অবিশ্বাস্য। বিশ্বের কোথাও কোন ভূমিকম্পের কথা কানে এলে কটা মিনিটের জন্যে থমকে যাই। বুকের ঠিক মাঝখানে তৈরী হয় একটা শূন্যতা। কি হবে একই মাত্রার ভূমিকম্প যদি আঘাত হানে বাংলাদেশের কোন শহরে? টিকে থাকবে কি প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যার শহর ঢাকা? আর্ন্তজাতিক সংস্থার মতে ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় অবাসযোগ্য শহর। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট দূরে থাক, এখানে নগর পরিকল্পনা বলতে কিছু নেই। এখানের সবকিছু হয় ব্যক্তির ইচ্ছায়, ক্ষমতায়, টাকায়। টাকা দিলেই দুইতলা ফাউন্ডেশনের উপর গড়ে তোলা যায় চৌদ্দ তলা ইমারত। ভূমিকম্প ছাড়াই এখানে স্থানচ্যুত হয় বড় বড় স্থাপনা। এ নিয়ে কারও সাথে কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেয় আমার আশংকা। তাদের মতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনটাই না-কি একটা সুনামি। কথার পিঠে কথা লাগিয়ে হয়ত অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু বাস্তবতা হল ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে গোটা বাংলাদেশ মিশে যাবে মাটির সাথে। বাংলাদেশের মাটির নিচেও বাস করে একটা দানব, এবং মাঝে মধ্যে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জানিয়ে দেয় নিজের অস্তিত্ব। এ দানবকে কি আজীবন ঘুম পারিয়ে রাখা যাবে? আমরা জাপানি নই, আমরা বাংলাদেশি, বিশ্বের অন্যতম করাপ্ট নেশন। জাতীয় চরিত্রের এই দূরারোগ্য ব্যাধি দূর না করা পর্যন্ত আমাদের দেশে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করা হবে আত্মঘাতী। আসুন মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি কি ঘটছে এবং ঘটতে যাচ্ছে জাপানের ফুকুশিমা পাওয়ার প্লান্টে। তারপর না হয় কথা বলা যাবে সরকারের রূপপুর আনবিক শক্তি প্রকল্প নিয়ে।