গ্রাম্য আদালত একত্রিত হয়েছে অনেকদিন পর। স্থান বাংলাদেশের কোথাও কোন এক গ্রাম। সময় বাদ জুমা। একই গ্রামের ফজর আলী আসামীর কাঠগড়ায়। ফজর আলীর অপরাধ সে নাকি পবিত্র কোরানের ছিন্ন একটা পাতা কুড়িয়ে পেয়ে তার প্রতি যথাযত সন্মান দেখায়নি। ক্ষোভে ফেটে পরেছে গোটা গ্রাম। আশেপাশের অনেক গ্রামে দাবানলের মত ছড়িয়ে পরেছে খবরটা। জনরোষ থামাতে গঞ্জের হাটে মাইকিং করা হয়েছে ইতিমধ্যে, খোলা আদালতে বিচার হবে ফজর আলীর। বিচারের দিন জুমা ঘর উপচে পরল মুসল্লিদের ভীড়ে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার প্রার্থীদের একজন অতিরিক্ত পানির ব্যবস্থা করেছে, অন্যজন যত্ন নিয়েছে পান-সুপারির। মসজিদ কমিটি বরাবর ১০০ টাকা জমা দিয়ে অস্থায়ী একটা চা স্টল বসিয়েছে গঞ্জের চা বিক্রেতা ফজলু কাজী। বিচারকর্মের শুরুতে অভিযোগ উত্থাপন করল জুমাঘরের ইমাম। অভিযোগ খুবই ঘোরতর, ফজর আলী পাতাটা উল্টে পাল্টে ছুড়ে ফেলেছে রাস্তায়। ব্যস্ত রাস্তার উপর পরে থাকা পবিত্র পাতাটার উপর দিয়ে অনেকেই হেটে গেছে ইতিমধ্যে। ইমাম সাহেবের কাছে খবরটা পৌঁছান গ্রামের মুরুব্বী মাঞ্জু বেপারী। পাতাটা তিনিই কুড়িয়ে পেয়েছিলেন জুমা ঘরে আসার পথে। কেউ দোররা মারার প্রস্তাব করল, কেউ মাথা ন্যাড়া করে তাতে আলকাতরা মাখিয়ে গঞ্জের হাটে ঘোরানোর কথা বলল। ফজর হাঁটু গেড়ে মাফ চাইল, কানে ধরল, তওবা করল এবং সাড়া জীবন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার প্রতিজ্ঞা করল। কিন্তু মুসুল্লিদের ক্ষোভ তাতে এতটুকু প্রশমিত হলনা। সবাই মারমার কাটকাট সুরে কথা বলল। উপায় না দেখে ফজর আলী উঁচুস্বরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
মিশর হতে ফেরার পর ইজ্জত আলী দফাদার ঘর হতে বের হয়নি। তিনদিন ধরে শুধু ঘুমাচ্ছে আর খাচ্ছে। বেশ কটা দিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছিল সাহারা মরুভূমিতে। পুষিয়ে নিচ্ছে হারানো খাওয়া আর ঘুম। কারও উঁচুস্বরের কান্নায় ঘুম ভাঙল তার। দক্ষিনের জানালা খুলে বাইরে তাকাতে অবাক হয়ে গেল সে। গ্রামে কিছু একটা হচ্ছে আজ। আরব দেশ হতে আনা একমাত্র আলখাল্লাটি গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পরল। রায় ঘোষনা হয়ে গেল ফজরের আলীর। ১০০ ঘা বেত, মাথা ন্যাড়া করে গ্রাম ছাড়া করা সহ আরও অনেক কিছু। বিচারের উপসংহারে ইমাম সাহেব লম্বা একটা ভাষন দিলেন। ভাষনে আখেরাতের কথা বললেন, এই দুনিয়ার হাল্কা শাস্তির বিপরীতে আখেরী দুনিয়ায় ফজরের শাস্তি কতটা কঠিন হবে তার বর্ণনা দিলেন। ইজ্জত আলী মন দিয়ে শুনল ইমাম সাহেবের কথা। প্রতিবেশি ছয়নাল মিয়ার কাছে জানতে পারল পুরো ঘটনা। একটু অবাক হল ইজ্জত, ইমাম সাহেবের হাতে ধরা পাতাটা খুব পরিচিত মনে হল তার কাছে। উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। যা ভেবেছিল তাই সত্য হল, পাতাটার আসল মালিক সে নিজে। ভাবল হয়ত ৪ বছরের ছেলে মজিবরের কাজ। রাগ ধরল নিজের উপর, রাগ ধরল ইমাম সাহেবের উপর, গোটা গ্রামের উপর রেগে গেল ইজ্জত আলী দফাদার। ফজরকে দোররা মারার প্রস্তুতি নিচ্ছিল গ্রামের এখলাস মোল্লা। চীৎকার করে উঠল ইজ্জত।
- অই মিয়ারা আফনেরা থামেন, হেরে মারার আগে আমার দুইডা কথা আছে। আমি ইজ্জত আলী, এই গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনদিন আগে দশ বছর পর মিশর হইতে ফিরা আইছি। হেই দেশে গোলমাল, রাইতের আন্ধারে চোরের মত পালাইতে বাধ্য অইছি। ফজরের আফনেরা বিচার করছেন ভাল কতা, তয় বিচারডা মনে হয় সঠিক হয় নাই। যে পাতাডার লাইজ্ঞা হেরে গ্রাম ছাড়া করাতাছেন হেইডার মালিক আসলে হে না, আমি। আমার চাইর বছইরা ছাওয়াল মজিবরের কাম এইডা।
হায় হায় করে উঠল মুসুল্লির দল। ইজ্জতের দাবি অনেকে মানতে চাইল না, ভাবল লেনাদেনা জড়িত এখানে। কেউ কেউ অস্তাগফিরুল্লাহ বলে জিহবায় কামড় দিল। কান্না-কাটি ফেলে এবার হুংকার দিয়ে উঠল ফজরের বিবি। গালি দিল অশ্রাব্য ভাষায়।
- হুনেন, যেই পাতাডারে আফনেরা কোরানের পাতা কইতাছেন হেইডাও হাছা না। একটা ম্যাগাজিনের পাতা এইডা, মিশরীয় ম্যাগাজিন, কিনছি মরক্কোর কাসাব্লাংকা এয়ারপোর্টে। যার লাইগা আলীর বেটারে এতবড় শাস্তি দিতাছেন পইড়া দেহেন কি আছে ঐ হানে, মিশরীয় প্রেসিডেন্ট হসনী মুবারকের আকাম কুকামের কথা, চুরি চামারীর কথা।
গল্পটা আমার নিজের না, ছোটবেলায় একজন বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছিলাম। স্থান, কাল ও পাত্র পরিবর্তন করে মূল লেখার ভুমিকা হিসাবে ব্যবহার করেছি মাত্র। ভূমিকার আকার নিয়ে খিচুরি পাকিয়ে ফেলেছি, তাই মূল লেখাটা ছোট করতে বাধ্য হলাম। জোবরা গ্রামের ’সুদখোর’ ইউনূস মাস্টারকে নিয়ে কথা বলছিলাম জনৈক বামপন্থী নেতার সাথে। উনি বদরুদ্দিন উমর লেভেলের কেউ নন, তবু আমার চোখে বিখ্যাত ভিন্ন কারণে। ভদ্রলোক দুই মিনিট সময় নিয়ে আমার কথা শুনলেন এবং তৃতীয় মিনিটে কথার সুনামিতে সমাহিত করে ফেললেন আমার অস্তিত্ব। ’সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক, কর্পোরেট বিশ্বের বিশ্বস্ত দালাল ইউনূসের কাধে ভর করে আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটে নেয়ার মহাপরিকল্পনা করেছিল পশ্চিমারা।’ গুণীজনদের জটিল শব্দের লেকচার, বিশ্বকোষের রেফারেন্স আর কার্ল মার্ক্সের ডাচ ক্যাপিট্যাল জাতীয় ভাষা ব্যবহার করে যারা গইগেরামের সাধারণ সমস্যার কথা বলেন তাদের লেখা সযত্নে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু আজকাল চাইলেও তা এড়ানো যাচ্ছে না কারণ জাপানী সুনামির মত বাংলাদেশকে গ্রাস করে নিয়েছে ইউনূস নিধন ভাষা। বাংলায় একটা কথা আছে ‘ছাল নাই কুত্তার বাঘ তার নাম’, আজকাল এত বেশি বাঘের তর্জন গর্জন যা অনুবাদ করলে মনে হবে ইউনূস মাষ্টারের সমালোচনা না করা মানেই অর্থনীতি না বুঝা, ব্যাংকিং না বুঝা, শোষণ না বুঝা, পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র না বুঝার মত মূর্খতা। রুশ ভাষায় বলা হত ’নাউচনি কম্যুনিজম’, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হলেও বিষয়টা ছিল আমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক। দ্বান্দিক বস্তুবাদ, সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র, পুঁজির শোষণ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ আর বাংলাদেশ সদ্য প্রসূত রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার তত্ত্ব বছরের পর বছর আমাদের মগজে ঢুকানো হয়েছিল বিশাল আয়োজনে। কিন্তু তত্ত্বের মহাসমুদ্রে ১২টা বছর বাস করতে গিয়ে একটা সত্য উপলদ্ধি করেছি, তত্ত্ব আর বাস্তবতার মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। যাই হোক, ফিরে আসি নেতার সাথে আলাপ প্রসঙ্গ।
- স্যার, দয়া করে খোলাসা করবেন কি লুটপাটের ব্যাপারটা? অর্থাৎ আপনি বলছেন আমাদের সম্পদ লুটপাটের জন্যে ইউনূস মাস্টারকে দিয়ে মহা আয়োজন করেছে সাম্রাজ্যবাদীরা। আমি জানতে চাইছি কোন কোন সম্পদ আছে এ তালিকায়?
- আমাদের গ্যাস, আমাদের তেল, কয়লা আরও অনেক কিছু।
- গ্যাসের অভাবে শুনছি ঢাকার মনেশ্বের রোডে চুলা জ্বালছে না। সাম্রাজ্যবাদীরা গ্যাস নিয়ে গেলে শুধু মনেশ্বর রোডে কেন বাংলাদেশের কোথাও কোন চুলা জ্বলবে না। হাহাকার শুরু হবে ঘরে ঘরে। সামাজিক, পারিবারিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং পাশাপাশি তৈরী হবে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতদের জেগে উঠার প্রেক্ষাপট। একজন বামপন্থী হিসাবে এটাই কি আপনার রাজনীতি নয়, শোষিতদের বিপ্লব?
- পেটি বুর্জোয়াদের শোষণ সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র কায়েমের উপযুক্ত শোষণ নয়, তাই এ ধরণের বিপ্লব সহসাই বাংলাদেশে ঘটতে যাচ্ছে না। আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
- ব্যবহার করার মত যথেষ্ট গ্যাস নেই আমাদের, তেলের কাহিনী এখন ইতিহাসের বিষয়, বাংলাদেশের কয়লা মাথায় করে নিয়ে যাবে আমেরিকায়, খোলাসা করবেন কি অর্থনীতির কোন গণিতে এমনটা করতে যাবে পশ্চিমা তথা মার্কিনিরা?
- ইরাক, আফগানিস্তান সহ পৃথিবীর অনেক দেশ হতে মার্কিনিরা সম্পদ লুটে নিচ্ছে। ইউনূস মাষ্টারের নোবেল প্রাপ্তি বাংলাদেশকে এ পথে ঠেলে দেয়ার প্রথম পদক্ষেপ।
- স্যার, ইরাক আফগানিস্তান না টেনে আসুন আমাদের সম্পদের কথা বলি। আমাকে সোজা বাংলায় বলবেন কি, কোন সম্পদ লুটপাটের জন্যে মার্কিনিরা ইউনূস মাস্টারকে নোবেল দেয়ার তদবির করেছিল? ১৭ কোটি মানুষ আর থই থই পানি ছাড়া এ দেশ হতে লুটে নেয়ার মত কি এমন সম্পদ আছে যা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না? আমাদের পাট? চা? তামাক? পোশাক শিল্প? মানব সম্পদ? ইলিশ মাছ? এ গুলো তো ওদের লুটতে হয়না, বরং আমরাই জলে, স্থলে আর অন্তরীক্ষ দিয়ে তাদের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার ধান্ধা করছি। ভাইকে বাপ, বোনকে মা আর স্ত্রীকে বোন বানিয়ে ওদের দেশে প্রবেশের চেষ্টা করছি। প্রতিমাসে লাখ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠাচ্ছি। এ হিসাবে লুট তো করছি আমরা। আমাদের এ লুটের শাস্তি দিতেই কি ইউনূস মাস্টারকে নোবেল দেয়া হয়েছিল? নোবেল প্রাপ্তি বেচারাকে আদালতে ঠেলে দিল, এটা কি শাস্তি নয়?
- সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত চেহারা চিনতে এত সব বুঝার দরকার হয়না। ওরা দেশে দেশে এজেন্ট তৈরী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে থাকে। ইউনূস মাষ্টার তেমনি এক এজেন্ট।
কথা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটা এখানেই মরে গেল। আমার বামপন্থী বড়ভাইয়ের চেহারায় কেন জানি মসজিদের ইমাম সাহেবের চেহারাটা ভেসে উঠল। নিজেকে ইজ্জত আলী দফাদার ভাবতে ইচ্ছে হল এ মুহূর্তে। জোবরা গ্রামের ইউনূস মাষ্টারের চেহারাটা মনে হল অবিকল ফজর আলীর মত। আর এই মাস্টারকে শাস্তি দেয়ার গন আদালত, ব্লগ আদালত, বুদ্ধিজীবী আদালত, হাসিনা আদালতকে মনে হল বাংলাদেশের কোথাও কোন গ্রাম্য আদালতের মত।
- সবাইকে ধন্যবাদ।