ঘটনার শুরু ৪৮ মাস আগে। স্থান কিউবার মাটিতে লিজ নেয়া মার্কিন ঘাঁটি গুয়ানতানামোয় কোন এক টর্চার সেল। পাকিস্তান হতে ধরে আনা ৯/১১ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহম্মদের উপর নিয়মিত টর্চারের আরও একটা দিন। টর্চারের পদ্ধতি ওয়াটারবোর্ডিং। কুয়েতি এই শেখের কাছে মার্কিনীদের একটাই চাওয়া, সৌদি শেখ ওসামা বিন লাদেনের সর্বশেষ অবস্থান। দিনের পর দিন নির্মম অত্যাচারের ধারাবাহিকতা শেখ মোহম্মদকে বাধ্য করে ওসামার অবস্থান সম্পর্কে কিছু একটা তথ্য প্রকাশ করতে। এ ব্যাপারে নিজের অজ্ঞতার কথা বার বার প্রকাশ করলেও এ যাত্রায় নতুন একটা তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। বাইরের পৃথিবীর সাথে ওসামা বিন লাদেনের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নাকি কয়েকজন বার্তাবাহক, যাদের অবস্থান পাকিস্তানে। এভাবেই শুরু হয় বিন লাদেন হান্টের নতুন অধ্যায়, এবং শেষ অধ্যায়। তথ্য প্রকাশের ২ বছরের মাথায় এমনি এক বাহকের সন্ধান পায় মার্কিন গোয়েন্দারা।
কেবল পাহাড় পর্বত নয়, বছরের পর পর বছর ধরে পাকিস্তানের প্রতিটা সন্দেহজনক স্থাপনার উপর নজর রাখছিল মার্কিন ইন্টিলিজেন্ট। ওবামা প্রশাসনের অনেকেই বিশ্বাস করত আফগানিস্তানের অনাবাসযোগ্য পাহাড় পর্বতে নয়, বরং পাকিস্তানের জনবহুল কোন শহরে লুকিয়ে আছে বিন লাদেন। বিবেচনায় আনা হয় তার কিডনি রোগ ও তার ডায়ালাইসিস ট্রিটমেন্ট। আফগানিস্তান অথবা পাকিস্তানের জনমানবহীন গুহায় এ চিকিৎসা ছিল অসম্ভব। আকাশে গোয়েন্দা বিমান আর মাটিতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে ওসামা বিন লাদেন আজীবন পালিয়ে থাকতে পারবে মার্কিনিরা কখনোই তা বিশ্বাস করেনি। তাই সামান্যতম লীড পেলে হাউ¨ ডগের মত তার পিছু নিতে কার্পণ্য করেনি। খালিদ শেখ মোহম্মদের লীডকেও তারা তথ্য বিভ্রান্তি হিসাবে উড়িয়ে দেয়নি। মাসের পর মাস আঠার মত লেগে থেকে শেষ পর্য্যন্ত গত আগষ্ট মাসে হদিস পায় তথ্য সূত্রের। সন্দেহের তালিকায় যোগ হয় পাকিস্তানী বাসিন্দা দুই ভাই। বিরামহীন অনুসরণের মাধ্যমে মার্কিন গোয়েন্দাদের নজরে আসে রাজধানী ইসলামাবাদ হতে ৭৫ মাইল দুরের শহর এবোটাবাদের অদ্ভুত একটা বাড়ি। নির্জন এবং ভৌতিক, এভাবেই বর্ণনা করা হয় ইন্টিলিজেন্ট রিপোর্টে। সাধারণের চাইতে অনেক উঁচু দেয়াল (১৮ ফুট), দুই ধাপের প্রতিরক্ষা দেয়াল, ফোন, ইন্টারনেট বিহীন মিলিয়ন ডলারের বাড়িটাকে আখ্যায়িত করা হয় হাই প্রোফাইল ক্রিমিনাল লুকিয়ে রাখার পারফেক্ট স্থাপনা হিসাবে। গোয়েন্দা এনালিস্টের সভায় উপসংহারে আসা হয় কেবল ওসামা বিন লাদেনের পক্ষেই সম্ভব এমন একটা বাড়ি মেইনটেইন করা। ব্যাপারটা প্রেসিডেন্ট ওবামার দৃষ্টিতে আনা হয় গত ফেব্রুয়ারীতে। মার্চের ১৪ তারিখ মার্কিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় হতে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে শুরু করা হয় কোর্স অব একশ্যান।
স্যাটেলাইট সার্ভেলেন্স হতে নেয়া বাড়ির ষ্ট্রাকচারকে কপি করে তৈরী করা হয় একই ধাচের একটা বাড়ি এবং এখানেই ট্রেনিং নিতে শুরু করে সেনাবাহিনীর সবচাইতে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য গ্রুপ নেভী সীল। নেভী সীলের অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিলনা তাই প্রেসিডেন্ট ওবামা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন ওসামার অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। ১৯৮০ সালের ইরান হতে জিম্মি উদ্ধার মিশন ব্যর্থ হওয়ার খেসারত দিতে হয় প্রেসিডেন্ট কার্টারকে। পরবর্তীতে এই ব্যর্থতা প্রকট হয় আমেরিকার সোমালিয়া মিশনে। ওয়ার লর্ড ফারাহ আইদিদকে ধরতে গিয়ে নিজেরাই ফেসে যায় মোগাদিসুর অলিগলিতে। এক কথায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় শক্তিধর মার্কিন সেনাবাহিনী। এ যাত্রায় ব্যর্থ হওয়ার ফল কি হতে পারে প্রেসিডেন্ট ওবামার ভাল করেই জানা ছিল। জন্মস্থান ও জাতীয়তা প্রশ্নে সন্দেহের পাশাপাশি যোগ্যতা নিয়ে প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানদের বহুমুখী আক্রমণের ফলে এমনিতেই তিনি ছিলেন কোণঠাসা। এ সময় ওসামা নিধনে ব্যর্থ অভিযান তার পুনঃ নির্বাচনের সম্ভাবনায় শেষ পেরেক এটে দিত। প্রেসিডেন্ট পিছিয়ে যাননি। নিশ্চিত হওয়ার পর গত শুক্রবার রাত ৮টা ২০ মিনিটে অনুমতি দেন পাকিস্তান অভিযানের।
রোববার দুপুর ২টায় ফাইনাল রিভিউর পর অভিযান শুরু হয় বিকেল ৩টায়। ২টা হেলিকপ্টার সহ দুই ডজন কমান্ডো অংশ নেয় এ অভিযানে। ৪০ মিনিট স্থায়ী অপারেশনে মার্কিন নেভী সীলদের মুখোমুখী হতে হয় দুই স্তরের বাধা। প্রথম বাধা আসে নীচ তলার রক্ষীদের কাছ থেকে। সর্বশেষ স্ত্রী নিয়ে বিন লাদেন বাস করতেন দুই তলায়। নীচতলার বাধা প্রতিহত হওয়ার পর উপর হতে শুরু হয় দ্বিতীয় দফা আক্রমন এবং এ আক্রমনে অংশ নেন খোদ বিন লাদেন ও তার ছেলে। নেভী সীলদের টিম লিডার ওসামাকে সারেন্ডারের আহ্বান জানালে পালটা আক্রমন আরও জোরদার হয়। বাধা দূর হওয়ার পর সাঁড়াশি আক্রমনে কমান্ডোরা উঠে যায় উপর তলায়। শয়নকক্ষে ওসামাকে আবিস্কার করা হয়। স্ত্রীকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নিজকে আড়াল করার চেষ্টা করলে কমান্ডোরা উভয়ের উপর গুলি চালায়। প্রথমে গুলি করা হয় বিন লাদেনের বক্ষে, দ্বিতীয়টা কপালে যা মস্তক সহ বেরিয়ে আসে পিছন হতে। তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয় ওসামা বিন লাদেনের। একই সাথে নিহত হয় তার ৩য় স্ত্রী ও এক সন্তান। কমান্ডোরা থাবা মেরে খুলে নেয় কম্পিউটারের অংশ যেখানে রক্ষিত ছিল আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের গুরত্বপূর্ণ তথ্যাবলী। নিহত ওসমার লাশ ঝড়ো গতিতে উঠানো হয়ে অপেক্ষমান হেলিকপ্টারে এবং কমান্ডো গ্রুপ ভোজবাজির মত মিলিয়ে যায় দিগন্তরেখায়। ল্যান্ড করার সময় উড্ডয়ন ক্ষমতায় ত্রুটি দেখা দেওয়ায় কমান্ডোরা উড়িয়ে দেয় একটা চপার।
প্রযুক্তির সহায়তায় ৪০ মিনিটের এ অভিযান সরাসরি প্রচার করা হয় হোয়াইট হাউজে জমায়েত ওবামা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্যে (উপরের ছবি)। ‘জোরানামো‘ ’জোরানামো‘...‘ই কে আই এ'..., চীৎকার করে উঠে কমান্ডো নেতা। এটাই ছিল তাদের সংকেত যার অর্থ ’এনিমি কিলড ইন একশ্যান‘। তাৎক্ষনিক ডিএনএর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় ওবামা বিন লাদেনের মৃত্যু। কেবল তারপর প্রেসিডেন্ট ওবামা মুখোমুখি হন আমেরিকান জনগণের এবং ঘোষনা দেন বহুপ্রতীক্ষিত মৃত্যুর।
ইসলামী বিধান মতে বিন লাদেনকে গোসল করান আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ’কার্ল ভিনসেন্টে’ কর্মরত জনৈক মুসলমান নৌ সেনা। তার জানাজা হয়ছিল কিনা তা নিশ্চিত করা হয়নি। সবশেষে সাদা কাপড়ের কফিন পরিয়ে এ্যারাবিয়ান সাগরের উত্তাল ঢেউ রাশিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় এক কালের শক্তিমান পুরুষ ওসামাহ বিন মোহাম্মদ বিন আওয়াদ বিন লাদেনকে।
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম হতে সংকলিত