কিছু সমস্যা আছে যার সাথে আপোস করা খুব সহজ। চোখ কান বন্ধ করে পাশ কাটিয়ে গেলেই খেলা ফাইনাল। কিন্তু কাজটা খুব সহজ হয়না যখন হাবিল-কাবিল ফেরেস্তাগণের মত বিবেক নামের অশরীয় কোন কিছু তাড়া করে বেড়ায়। পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে সমস্যা আমার পুরানো সমস্যা। যা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে, যা দেখে না দেখার ভান করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়না, এ ধরণের অনেক কিছুতে নাক গলাতে গিয়ে হাজারো ঝামেলা মোকাবেলা করতে হয়েছে জীবনে। সব এনকাউন্টারের ফল যে ভাল হয়নি তা বলাই বাহুল্য। যেমন ধরুন কাকরাইল মসজিদের উলটো দিকের সরকারী বাসাটার একটা ঘটনা। লাকড়ি মার্কা ৩০৩ রাইফেল হাতে ৩/৪ জন মুলিবাঁশ স্বাস্থ্যের পুলিশ সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছে বাড়িটা। প্রধান বিচারপতি পদের কেউ একজন বাস করেন চার দেয়ালের বেড়াজালে। মন্ত্রী পাড়ার রাস্তাগুলোতে তখনও আভিজাত্যের টম এন্ড জেরি দৌড়াদৌড়ি শুরু করেনি। আমার মত ভাগ্যহত স্বদেশিরা চাইলে রিক্সা করে ঘুরে বেড়াত সক্ষম হত রূপবান আর রহিম বাদশাহদের স্বপ্নপুরীতে। তো ঘুরে বেড়াচ্ছি একদিন। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল হয়ে কাকরাইল মোড়ের দিকে যাব বলে রিক্সায় চেপেছি। রিক্সা বিচারপতির বাসভবনের সামনে আসতেই অদ্ভুত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। এক লোক দাড়িয়ে পেচ্ছাব করছে বাসভবনের দেয়ালে। দেখে মনে হচ্ছিল পেচ্ছাবের বেগ দিয়ে জনপ্রিয় কোন গানের স্বরলিপি লিখতে চাইছেন ভদ্রলোক। কৌতুহল চেপে রাখা জটিল হয়ে গেল কারণ একটু দূরেই ছিল ২/৩ জন দেশীয় মোজাফর (৮০ দশকে বিলাতে অনেক সিলেটি ভাইদের মুখে পুলিশকে মোজাফর ডাকতে শুনেছি)। বেজার হলেও রিকশাওয়ালাকে থামতে বললাম। তার আবার আড়াইটায় রিক্সা ফেরৎ দেয়ার তাড়া ছিল। হাতে ক্যামেরার অভাব অনুভব করছিলাম ভীষন ভাবে। ধরে রাখতে পারলে ছবিটা পেত বিশ্বখ্যাতি। তৃতীয় বিশ্বের বিচার বঞ্চিত একজন মানুষ মুতে দিচ্ছে গোটা বিচার ব্যবস্থার উপর, এমনটাই হতে পারত ছবিটার ক্যাপশন। ডিজিটাল দুরে থাক, সাধারণ ক্যামেরাও তখন অমাবস্যার চাঁদ। চাঁদ হয়েই রয়ে গেল মুহূর্তটা। যা না করলেও চলত তাই করতে গেলাম, লোকটা এবং অনতিদূরে লাকড়ি হাতে লেফট-রাইটরত বাংলাদেশ পুলিশ কোরের ২-৪ জন স্বঘোষিত বাদশাহর দৃষ্টি আকর্ষন করলাম। শুরু হল মহা ফ্যাসাদ। লোকটা তেতে উঠে জানতে চাইল এটা আমার বাবার বাড়ি কি-না। পুলিশ এল এবং যথারীতি বনে গেল মাস্টার অব দেয়্যার অউন ডোমেইন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থল হতে আমাকে তাড়ানো জরুরী হয়ে গেল পুলিশের জন্যে। রাস্তার ওপারে রিকশায় চেপে অপেক্ষায় রইলাম নাটকের বাকি অংশ দেখার জন্যে। প্রকাশ্যে কেউ একজন মুতে দিল, তাও আবার প্রধান বিচারপতির মুখের উপর এবং সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল পুলিশের সাথে অবৈধ লেনাদেনার মাধ্যমে, জন্মভূমিকে কাছ হতে দেখার এমন অভিজ্ঞতা চাইলেই কি পাশ কাটানো যায়?
বিভিন্ন কোনা হতে একই ভাষ্যের ই-মেইল পাচ্ছি গেল কবছর ধরে। নাইজেরিয়ান স্ক্যামারদের মত না হলেও অনুরোধের ধরণটা প্রায় একই রকম। ভোট দিতে হবে, তাও একবার নয়, বহুবার। দাবিটার ভেতর আবেগ থাকে, থাকে দেশপ্রেমের স্বর্গীয় তাগাদা। ভোট দিয়ে সুন্দরবনকে পৃথিবীর আশ্চর্যতম স্থাপনা বানানোর প্রতিযোগীতায় সহযোগীতা করতে হবে। একই রকম আরও একটা অনুরোধ পেয়েছিলাম বছর তিনেক আগে। নেংটা কালের বন্ধু হাসান থাকে নিউ জার্সিতে। নিয়মিত যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ফোন করে অদ্ভুত একটা অনুরোধ করল সে। সেরা গায়ক-গায়িকা বানানোর কি একটা জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চলছে বাংলাদেশে। গোটা দেশ না-কি মেতে আছে এ নিয়ে। তার এক ভাগ্নি টিকে গেছে প্রতিযোগীতায়। আমাকে ভোট দিতে হবে, তাও আবার ম্যারাথন। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেও নাছোড় বান্দা। ফোনের উপর ফোন করে জানতে চাইল কটা ভোট দিয়েছি এ পর্যন্ত। মিথ্যা নিয়ে বেশি দূর আগানো যায়না, বন্ধুরও বুঝতে অসুবিধা হলনা আমার অনিচ্ছা। এ নিয়ে বেশ কিছুটা তিক্ততা তৈরী হয়ে গেল নিজেদের ভেতর, যার জট গত ৩ বছরেও খোলা যায়নি। সমসাময়িক বাংলাদেশি গান-বাজনার সাথে আমার সংস্পর্শ নেই, নেই বাংলা টিভি চ্যানেল। এমন একটা বাস্তবতায় প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে রায় দেয়া শুধু প্রতারণা নয়, রীতিমত আপরাধ, অন্তত আমার কাছে। বন্ধুকে এমন একটা ধারণা দিতে গিয়ে বেশ কিছু তিতা-মিঠা হজম করতে হল। সুন্দরবনকে ভোট দেয়ার দাবিটা শুধু বন্ধুদের নয়, ভার্চুয়াল দুনিয়ার সদ্য পরিচিত অনেকের কাছ থেকেও পাচ্ছি অনুরোধটা। অনেকে এটাকে শেক্সপিয়ার কায়দায় ‘টু বি, অর নট টু বি‘ মিশিন হিসাবে নিয়েছেন। যারা এমন একটা ’মহান’ কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, সুন্দরবনকে পৃথিবীর সুন্দরতম স্থাপনা বানানোর মহা আয়োজনে আপনাদের সহযোগী হতে পারলাম না। কিছু জিনিষ আছে যার সাথে কম্প্রোমাইজ নিজের বলতে যা আছে তা বিকিয়ে দেয়ার শামিল। বাচার পথে এগুলোই আমার একমাত্র সম্বল, দেশপ্রেমের ফাকা ভাবাবেগের কাছে তা বিক্রি করতে একান্তই নারাজ। সুন্দরবনকে কেন ভোট দেব না তার কতগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে, নীচের পয়েন্ট গুলো তার কিছুটা হলেও ব্যাখ্যা দেবে।
একই দিনে ভিন্নমুখী দুটো খবর বেরিয়েছে। স্থান এক হলেও এর তাৎপর্য বহু ও ভিন্নমুখী।
১) সুন্দরবনকে বিজয়ী করতে সরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে
তারিখ: ২২-০৫-২০১১
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূল বনাঞ্চল (ম্যানগ্রোভ) সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে বিজয়ী করতে পারলে এ জয় হবে গোটা জাতির। তাই সুন্দরবনকে এগিয়ে নিতে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এ নির্বাচন-প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্বে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও সুন্দরবনের পক্ষে ভোট সংগ্রহ করতে হবে। গত শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সুন্দরবন সমর্থক জাতীয় সমন্বয় কমিটি ও বাংলাদেশ ওয়ান্ডার্স প্রমোশন ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বিশ্ব প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে দুই বাংলার গর্ব সুন্দরবনকে বিজয়ী করতে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ মত দেন। বৈঠকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন যে একটি জাতীয় আন্দোলনের বিষয় হতে পারে, তা জেনে আমি অভিভূত।
২) সুন্দরবনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুজন নিহত, ১৭টি আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা ও গুলি উদ্ধার
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে গতকাল শনিবার র্যাব ও কোস্টগার্ডের সদস্যদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছে। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও কোস্টগার্ডের দাবি, নিহত ব্যক্তিরা বনদস্যু। ঘটনাস্থল থেকে ১৭টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বেশ কিছু গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। শরণখোলা রেঞ্জের ডিমের চর এলাকায় গতকাল বেলা ১১টা থেকে দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ বন্দুকযুদ্ধ হয়। উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে রয়েছে একটি একনলা বন্দুক, সাতটি শাটারগান, নয়টি ওয়ান শ্যুটারগান, চারটি রামদা ও ৪২টি তাজা গুলি।
রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির ভাল একটা কথা আছে, ‘নিজেকে মানুষ হিসাবে দাবি করতে চাইলে আমাদের সবকিছু সুন্দর হওয়া চাই। পোশাক হতে শুরু করে ভেতর-বাহিরের সবকিছু‘। আমাদের সুন্দরবন নিশ্চয় সুন্দর। পৃথিবীর যে কোন সুন্দরের সাথে প্রতিযোগীতা করে টিকে থাকার মত ক্ষমতা আছে তার। কিন্তু এক সুন্দরই কি যথেষ্ট বিশ্ব সৌন্দর্য্য প্রতিযোগীতা জেতার? ধরে নিলাম ভোট বাক্সে একাধিক ভোট দিয়ে ছলে, বলে ও কৌশলে জিতিয়ে আনলাম সুন্দরবনকে। তারপর? আমাদের দেশপ্রেম জয়ী হল এবং সুন্দরবন স্থান করে নিল পৃথিবীর আশ্চর্য্যতম স্থাপনার তালিকায়। এমন একটা বিজয় নিসন্দেহে নজর কাড়বে বিশ্ববাসীর। ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকের ঢল নামবে এখানে।
ঢাকা হতে সুন্দরবন! এক কথায় পৃথিবী হয়ে মঙ্গল গ্রহে যাত্রা যেন! এমন একটা ভ্রমণের সাথে কি আমরা পরিচিত নই? মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, লাগেজ পার্টি, পকেটমার, অসৎ পুলিশ, আম্বা লীগ, হাম্বা দল, তালেবানি জল্লাদ, ট্রাফিক কলেরা সহ অলিগলিতে ওঁৎ পাতে থাকে হরেক রকম আজরাইলের দল। পা হতে মাথা পর্যন্ত এসব 'অলংকার' মাড়িয়ে একজন বিদেশি নিরাপদে সুন্দরবন পৌঁছাবে তারই-বা নিশ্চয়তা কোথায়? সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে অনেকেই হয়ত পৌঁছাবে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপর? এই কি সেই সুন্দরবন নয় যেখানে ২৪/৭ সাজেদা চৌধুরী আর ওসমান গনিদের পেট ভরাতে উজাড় করা হচ্ছে গাছপালা? এই কি সেই ভূমি নয় যেখানে ডাকাত আর শিকারি দলের হানিমুনে অতিষ্ঠ থাকে বনের পশু পাখি? এ তথ্য কারও অজানা নয় বদলি বাণিজ্যের নামে এই বনকে ঘিরেই প্রতিবছর লেনাদেনা হয় কোটি কোটি টাকা। কারণটা আন্দাজ করা কি খুব কঠিন? সুন্দরবন বাংলাদেশেরই অংশ এবং বাংলাদেশ আপদমস্তক ডুবে আছে অনাচার, অবিচার আর দুর্নীতির বেড়াজালে। এমন একটা দেশে সুন্দরবনের মত দুর্গম একটা জায়গা বিদেশি পর্যটকদের জন্যে কতটা নিরাপদ তা কি ভেবে দেখেছি?
দেশপ্রেম জাহিরের হাজারটা রাস্তা আছে। আপাতত সে প্রেম দেশীয় গলিতে সীমিত রাখলেই বোধহয় ভাল হবে। দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন একটা জাতি্কে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে সুন্দরবনের মত খণ্ডিত একটা অংশ নিয়ে গর্ব করতে চাইলে (বিশেষ করে বিশ্ব দরবারে)।
সুন্দরবনকে ভোট দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত...