আজকের মত অতটা ঘটনাবহুল ছিলনা তখনকার ছাত্রজীবন। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীদের নজরদারি এড়িয়ে স্বঘোষিত অ্যাডভেঞ্চার করার সূযোগ ছিল খুবই সীমিত। ছকবাঁধা জীবন আর এঁকে দেয়া গন্ডির বাইরে গিয়ে কিছু করতে চেয়েছে এমন সব ’বিতর্কিত’ চরিত্রের নন্দনা বন্দনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত মফস্বলের জীবন। এসব বিতর্ক এড়িয়ে যারাই স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙ্গাতে সক্ষম হত সমাজের কলমে তাদেরই দেয়া হত নন্দিত মানুষের সার্টিফিকেট। তখনকার দিনে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে এমন একটা সার্টিফিকেট পাওয়া ছিল খুবই জরুরী। আমাদের স্কুল জীবন ছিল আরও ভয়াবহ। পারিবারিক ’জেলাখানার’ বাইরে পা দেয়া মাত্র চারদিকে ওঁৎ পেতে থাকত শিক্ষকদের নেটওয়ার্ক। কোন গলিতে কে সিগারেট ফুঁকেছে, মেয়েদের দিকে খারাপ চোখে তাকিয়েছে, মুরুব্বিদের সালাম দিতে দেরি করেছে, খবর গুলো কোন এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে পৌছে যেত শিক্ষকদের কানে। লোয়ার কোর্টের মত ওখান হতেই শুরু হত ’অপরাধের’ একতরফা বিচার পর্ব। শাস্তিতে কাজ না হলে কেস পৌছে যেত উচ্চ আদালতে, যেখানে গিলোটিন হাতে বিচারকের আসনে বসতেন কেবল দুই বিচারক, মা ও বাবা। এক কথায় একটা ফাংশনাল সোসাইটির সবকিছু ফাংশন করত কলকব্জার মত। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল সীমিত।
৬০ দশকের শেষ কটা বছর অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে আমাদের বাইরে তাকাতে হয়নি , বরং স্কুলের দরজায় এসে নিজে হাতছানি দিয়েছে। বার্ষিক পুরস্কার বিতরনী, মিলাদ মাহফিল, স্বরসতী পূজা আর ২১শে ফেব্রুয়ারী, স্কুল জীবনে এগুলোই ছিল একমাত্র বৈচিত্র। ৬ দফা আর ১১ দফা নিয়ে রাজপথে তখন তুমুল উত্তেজনা। স্কুলের সুরক্ষিত দেয়ালের ভেতর বসেও অনুভব করা যেত বাইরের উত্তাপ। চারদিকে ফিসফাস আর চাপা উত্তেজনা। কলেজের বড় ভাইরা প্রায় প্রতিদিন দাড়িয়ে থাকতেন স্কুল ফটকে এবং অনেকটা জবরদস্তি করে আমাদের বাধ্য করতেন রাস্তায় নামতে। ২১শে ফেব্রুয়ারী এমনিতেই আমাদের জন্যে ছিল বছরের সব চাইতে উত্তেজনাপূর্ণ মাস। স্কুলের শহীদ মিনার ঘষে মেজে পরিস্কার করা, আল্পনা আর ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া, এ সবই ছিল নিম্ন আর উচ্চ আদালতের বৈধতা পাওয়া কার্যক্রম। আমরা বছর ধরে অপেক্ষা করতাম এ মাসটার। মহেন্দ্রক্ষণ বলতে যদি কিছু থাকত সেটা ছিল ফুল চুরি উপলক্ষ। এ ছিল আনেকটা ঈদের চাঁদ দেখার মত আনন্দের রাত। অন্যের সাজানো বাগান তচনচ করার ভেতর অন্যায় কিছু থাকতে পারে তার প্রথম স্বাদ পাই যে রাতে আমার নিজের বাগান লুট হয়ে যায়। বাগানের ফুল এমনিতেই নির্ধারিত থাকত শহীদ মিনারের জন্যে। কিন্তু তার জন্যে গোটা বাগান উপড়ে ফেলতে হবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিশোর হূদয়ে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হল। ঘটনাটা ছিল খুবই ছোট, কিন্তু আমার জন্যে ছিল যথেষ্ট। ফুল চুরি ও ২১শে ফেব্রুয়ারীর মধুমিলনে এটাই ছিল আমার শেষ অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতেও কাজ করেছিল একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। প্রথম প্রহরের উত্তেজনা শেষে সূর্যোদয়ের শুরুতে আমাদের নামতে হত রাস্তায়। হাতে লাঠি আর পকেটে ইটপাটকেল নিয়ে মিছিলের নেত্রীত্বে থাকত কলেজের বড় ভাইরা। আমাদের জন্যে নির্ধারিত ছিল কেবল একটা কাজ, চোখের সামনে ইংরেজী বলতে যা পরবে তার উপর ক্ষমাহীন আক্রমণ, অথবা আলকাতরা দিয়ে লেপ্টে দেয়া। মিছিলে পাথর সাপ্লাইয়ের জন্যে সাথে থাকত বেশ কটা রিক্সা। আক্রমণ হতে কাউকে রেহাই দেয়া হত না। এমনকি রিক্সায় ঝুলানো নাম্বার প্লেটে ইংরেজী কিছু পাওয়া গেলে তাও উপড়ে ফেলা হত নির্দয় ভাবে। জঙ্গি মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে উঠত শহরের অলিগলি। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করত নিজেদের সম্পদ রক্ষার, যার মধ্যে অন্যতম ছিল চটের বস্তা দিয়ে ইংরেজী সাইন গুলো ঢেকে রাখা। শহরে আমাদের নিজস্ব বেশ কটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। যেহেতু ও দিকটায় যাওয়ায় অনুমতি ছিলনা তাই সবগুলোর সঠিক অবস্থান ও বাহ্যিক চেহারার সাথে পরিচিত ছিলাম না। জঙ্গি মিছিলের সংগী হয়ে তেমনি এক প্রতিষ্ঠানের সামনে দাড়িয়ে দেখি আমার নিজের নামের একটা সাইন ঝুলছে। সাইনটা বাংলায় হলেও এর কনটেন্ট ইংরেজী, ... & ট্রেডার্স। আর এখানেই আপত্তি মিছিলকারীদের। বাসার কাজের ছেলেটাকে দেখলাম দরজায় দাড়িয়ে। প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলাম। বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করলাম। একগাদা ভাইবোনের মুখে তিন বেলা অন্ন আর মাথার উপর যেনতেন একটা ছায়ার জন্যে কি আপ্রাণ চেষ্টাই না করে যাচ্ছেন দিনরাত। এখানেই থামতে হল আমাকে, এবং এটাই ছিল জীবনের শেষ থামা। বিশেষ করে এ লাইনে।
লেখাটা যখন লিখছি বাংলাদেশে তখন ৩৬ ঘন্টার হরতাল চলছে। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে হরতালের ঢেউ মার্কিন মুলুকের এ অংশে আঘাত হানবে এমন কোন আশংকা নেই। চাইলে এ নিয়ে হয়ত স্বস্তি উল্লাসও করতে পারি। সমস্যাটা বোধহয় এখানেই। প্রবাসে বসে দেশের চিন্তাটা অনেক ক্ষেত্রে দেশের চাইতেও কষ্টকর মনে হয়। সত্যটা বেশি প্রকাশ পায় যখন ব্যক্তিগত দুঃসংবাদ আসতে শুরু করে। ভুক্তভোগীদের তা ভাল করে জানার কথা। গেল ৩ বছর ধরে দুঃসংবাদের মিছিল যেন থামতেই চায়না। পারিবারিক ব্যবসা বলতে যা ছিল তার ৭০ ভাগ হাওয়া হয়ে গেছে সরকারের সাথে প্রণব বাবুদের মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসার কারণে। সুতা আর কাপড়ের কলকব্জা ঘুরানো আমাদের আদি ব্যবসা। এর উপর বেচে থাকে পরিবারের বাকি সবাই। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তার কিছুটা নমুনা পেলাম দাদাবাড়ির সাথে যোগাযোগ করে। ছোটখাট তাঁতিদের অনেকেই পথে বসে গেছে ইতিমধ্যে। বাকিদের অবস্থাও নুন আনতে পানতা ফুরানোর মত। চারদিকে হারানোর হাহাকার। অপরাধ প্রবণতায় আক্রান্ত গোটা জনপদ। ঠিক এমন সময় ৩৬ ঘন্টার হরতাল অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে লাখ লাখ মানুষের বেচে থাকা। খবর গুলো কি জানা আছে কথিত জনপ্রতিনিধিদের? দাদাবাড়ির জানালা খুললে এক সময় দিগন্ত জুড়ে রাজত্ব করত ফসলের মাঠ। আজ সে মাঠে বাড়ির উপর বাড়ি, মাথার উপর মাথা। কাজ নেই, আশা নেই, নেই দেখার মত স্বপ্ন। দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে হাজার বছরের মূল্যবোধ। এবং সবই হচ্ছে আমাদের অধিকারের নামে, গণতন্ত্রের নামে। নতুন সহস্রাব্দের দোড় গোড়ায় দাড়িয়ে নিজেদের কি আফ্রিকা হতে ধরে আনা মার্কিন ক্রীতদাসদের মত মনে হচ্ছেনা? স্বাধীনতার নামে এ কোন খপ্পরে পরেছি আমরা? একদল প্রমানিত চোর, জোচ্চোর, বাটপার, খুনি আর লুটেরা দেশকে জিম্মি করে বখরা আদায়ের লড়াই করবে আর আমরা তা ক্রীতদাসের মত বছরের পর বছর দেখে যাব, এ কোন সভ্যতায় বাস আমাদের?
অর্থমন্ত্রী কর্তৃক সদ্য প্রকাশিত বাজেট নিয়ে বিশাল সব সভা সেমিনার চলছে দেশের কোনায় কোনায়। রাজনীতিবিদদের পাশে বসিয়ে পাণ্ডিত্যের দামামা বাজিয়ে চলছেন কতিপয় সিজনাল পন্ডিত। কেউ বলছেন শতাব্দীর সেরা বাজেট, কেউ বলছেন গরীব মারার বাজেট। দেশিয় প্রেক্ষাপটে বাজেট মানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের রোডম্যাপ, এই সহজ সরল সত্যটা মুখ খুলে বলার মত একজন পণ্ডিতও নেই গোটা দেশে। উচ্ছিষ্টের মুলা ঝুলিয়ে গোটা জাতিকে গাধা বানিয়ে তার পিঠে সওয়ার হয়েছেন একদল জালিয়াত। এটাই বোধহয় সমকালীন রাজনীতির সাফল্য অথবা ট্রাজেডি।
এমন একটা দাবি তুললে কেমন হয়, রাজনীতির নামে যারা হরতাল ডাকবে অথবা প্রতিরোধ করবে তাদের সবাইকে সপরিবারের দেশে থাকতে হবে। ভাংচুর আর সন্ত্রাসের পুরোভাগে নেত্রীত্বে থাকতে হবে তাদের যাদের জন্য সিংহাসনের পথ পরিস্কার করা হচ্ছে। পরিবারে সবাইকে বিদেশে পাঠিয়ে, নিজেদের ব্যবসা বানিজ্য নিরাপদ করে অন্যের ঘাড়ে কামড় বসানো হবে অন্যায়, অবৈধ ও অনৈতিক। গাড়িতে আগুনই যদি দিতে হয় তা হবে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ি, আর জোর করে গাড়ি নামিয়ে হরতাল ব্যর্থ করতে চাইলে সে গাড়িও হবে নিজেদের গাড়ি। লন্ডনের গ্রসভেনর হোটেলে ছেলের সাক্ষাৎ অথবা কানাডায় হোটেলে ১৮ রুম ভাড়া করে কন্যা দেখতে যাওয়ার রাজকীয় আয়োজনের সাথে আর যাই হোক হরতাল মানায় না। এ স্রেফ ভণ্ডামি, লাম্পট্য ও জাতির অসহায়ত্ব নিয়ে নির্মম তামাশা।
আমরা কি ঘুমিয়ে গেছি? যদি তাই হয় তাহলে কবে ভাঙবে সে ঘুম? ২০, ৩০, ৪০ অথবা ১০০ বছর পর? কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করবে কি অর্থনৈতিক বিশ্বের ধাবমান চাকা? যৌন মিলনের তাড়নায় যে সন্তানের জন্ম দিয়ে পৃথিবীতে নতুন এক জোড়া চোখ, একটা মুখ আর বিশাল একটা উদর উপহার দিচ্ছি কতটা তৈরী রেখে যাচ্ছি সে পৃথিবীকে? আমাদের পৃথিবী তৈরী না হলেও দিন দিন সিল্কের মত মসৃন হচ্ছে একজন হাসিনা, খালেদার পৃথিবী সে বাস্তবতা কি আমরা বুঝতে পারি? ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা হয়ে আর কতদিন বাঁচতে হবে আমাদের?