এমন একটা খবর কিছুক্ষণের জন্যে হলেও জীবনকে থাকিয়ে দেয়, বাতাস ভারী করে দেয় আর চারদিকে অনুভূত হয় অক্সিজেনে অভাব। এ শোক ভাষা দিয়ে প্রকাশের শোক নয়, কান্না দিয়ে ধুয়ে ফেলা্র কষ্ট নয়। এ শোক, এ কস্ট জীবন ও মৃত্যুর মাঝ পথে ক্ষনিকের জন্যে থমকে যাওয়া একটা গলি। এ গলিতে কান্না নেই, হাসি নেই, কস্ট নেই, দুঃখ নেই। এ গলি বোবা দের গলি। আমরা প্রবাসীরা বোবা গলির বাসিন্দা, তাই চাইলেও সংগী হতে পারছি না দেশবাসীর সাথে।
আমার এ লেখা চট্টগ্রামের শোক নিয়ে নয়। আমার কলম এত নিখুঁত নয় যা দিয়ে দু'চার লাইনে এত বড় শোক তুলে ধরা যাবে। এ লেখা বরং ছিদ্দিক নামের একজন বাংলাদেশী ড্রাইভারকে নিয়ে। জ্ঞান হওয়া অবধি দেখছি ছিদ্দিক আমাদের গাড়ি চালায়। শিং মাছের মত পিছলা চরিত্র। একজন ড্রাইভার হিসাবে যতটা পাপাচার শোভনীয় তার অনেক নীচে নামতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করত না সে। তেল চুরি, গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ নিয়ে ঘাপলা বাজী, নতুন ব্যাটারী ক্রয় দেখিয়ে পুরানো ব্যাটারী স্থাপন, সময় অসময় মদ্যপান এবং বেপরোয়া ড্রাইভ করে রাস্তায় ত্রাস সৃষ্টি সবই ছিল তার নিত্যদিনের সাথী। ড্রাইভারি জীবনে গোটা দশেক বড় দুর্ঘটনা ও ৩টা মৃত্য আছে তার হাতে। চেষ্টা করেও তাকে বিদায় করা যায়নি কারণ বিকল্প হিসাবে যারা আসত তারাও একধাপ এগিয়ে থাকত। এই ছিদ্দিক মিয়া একটা নির্মান প্রকল্পে ড্রাইভারের চাকরি নিয়ে হুট করেই একদিন পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আবুধাবীতে।
সেবার দেশে গিয়ে দেখা ছিদ্দিক মিয়ার সাথে। ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। নিউ ইয়র্ক ফিরতে আমাকেও আবুধাবী বিমান বন্দরে ১৬ ঘন্টা কাটাতে হবে শুনে ছিদ্দিক মিয়ার চোখে মুখে শিহরন খেলে যায়। আমার আগেই ফিরে যাচ্ছে সে। ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার দিয়ে আবুধাবীতে পৌঁছে যোগাযোগের জন্যে হাতে পায়ে ধরল আমার। কোন অসুবিধা ছিলনা আমার। এয়ারপোর্ট নেমেই ফোন করলাম। বাতাসে উড়ে এল সে এবং উড়ন্ত চিলের মত ছোঁ মেরে নিয়ে গেল তার আস্তানায়। গর্বের সাথে পুরানো মনিবকে পরিচয় করিয়ে দিল সহকর্মী ড্রাইভারদের কাছে। বেশ ক’জন বাংলাদেশী ড্রাইভার ছোট্ট একটা রুমে পাখীর মত গাদাগাদি করে বাস করছে। সন্মান এবং শ্রদ্ধার সবটুকু উজাড় করে সবাই মিলে আপ্যায়ন করল আমায়। অনেক কথা হল ড্রাইভারদের আসরে এবং কথার ফাঁকে বেড়িয়ে এল এই ছিদ্দিক ড্রাইভারের কাহিনী। তাকে কোম্পানীর শ্রেষ্ঠ ড্রাইভার হিসাবে গন্য করছে মালিক পক্ষ এবং বলতে গেলে বাংলাদেশী ড্রাইভার গ্রুপের সবাই অঘোষিত দলনেতা হিসাবেও মেনে নিয়েছে।
এই সেই ছিদ্দিক ড্রাইভার বাংলাদেশে ড্রাইভিং সিটে বসলে যার রক্তে খেলে যায় যাত্রী নিয়ে হোলি খেলার নেশা, চোখে মুখে চিকমিক করে যার চুরি চামারির ধান্ধা। অথচ একই ছিদ্দিক আবুধাবীতে গিয়ে অর্জন করেছে মালিকের বিশ্বস্ততা এবং ড্রাইভার হিসাবে লাভ করেছে সহকর্মীদের শ্রদ্ধা। তাহলে আসল ছিদ্দিক ড্রাইভারকে চিনতে কি আমাদের ভূল হয়েছিল? মীরের সরাইয়ের মত বাংলাদেশের যে কোন দূর্ঘটনায় কোন না কোন ভাবে ছিদ্দিক ড্রাইভারদের হাত থাকে, থাকে তাদের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কলঙ্কিত অধ্যায়। ছিদ্দিক ড্রাইভার মানুষ হত্যা করে হাজির হয় মনিবদের কাছে, আর আইনের ফাঁক ফোকর গলে তাদের উদ্বারের জন্যে মনিবরাও এগিয়ে যায় বিনা দ্বিধায়। এভাবেই চলছে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা, যার বলি হয়ে প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে শত শত বাংলাদেশী। আবুধাবীতে এগুলো সম্ভব নয় বলেই হয়ত বাংলাদেশের বেপরোয়া ছিদ্দিক পরদেশে বনে যায় সভ্য ড্রাইভার। আইনের শাসন একটা দেশে শুধু মানুষকেই বদলে দেয় না, সাথে বদলে দেয় তার মনুষ্যত্ব, পরিবর্তন আনে তার অভ্যাসে। কেবল আইনের শাসন নিশ্চিত করা গেলেই হয়ত ৪৫ জন কিশোরের মত হাজার হাজার বাংলাদেশিকে বাঁচানো যেত দুর্ঘটনার করুন পরিণতি হতে।