দেওয়ার ভেতর নাকি এক ধরণের আনন্দ আছে। কথাটা বহুবার শুনেছি গুরুজনদের মুখে, বিশেষকরে ছোটবেলায়। সময় ও বাস্তবতা হয়ত অনেককিছুই বদলে দিয়েছে। দেওয়া নয়, আজকাল নেওয়াটাই শক্ত আসন করে নিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতিতে। জাতি হিসাবে আমাদের আজকের যে অবস্থান তার সবটাই আবর্তিত হচ্ছে নেওয়ার ভেতর। ব্যবসায়ী নিচ্ছে জনগণের পকেট হতে, রাজনীতিবিদ আর আমলারা নিচ্ছে সরকারের পকেট হতে, বিচারক কাটছেন আসামীর পকেট, আসামী কাটছে জনগণের পকেট। একই চক্রে জড়িয়ে যাচ্ছে প্রায় গোটা জনগণ। আজকাল প্রেম ভালবাসায়ও রাজত্ব করছে কেবল নেওয়া। কোচিংয়ের নামে শুধু অর্থ হাতড়িয়ে সন্তুষ্ট থাকছে না পরিমল ধরের দল, এর বাইরেও হাত বাড়াচ্ছে নিষিদ্ধ সীমানায়। গোটা জাতি যখন এই নেওয়ার মহামারিতে আক্রান্ত তখন ১৭ কোটি মানুষের সামনে উদাহরণ স্থাপন করলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। নেওয়ার পৃথিবীতে বাস করেও কি করে দেওয়া যায় এক অর্থে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি।
দেয়ার শুরুটা সোনিয়া গান্ধিকে দিয়ে। ২০০ ভরি সোনা দিয়ে পরিশোধ করলেন ৭১’এর ঋণ। বর্তমান বাজার দরে এর মূল্য হবে প্রায় ১ কোটি টাকা। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার যে নতুন পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে তার দাড়িপাল্লায় দাঁড় করালে এর মূল্য কি হবে তা নির্ণয় করতে আমাদের হয়ত কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। ডাইনাসোর অর্থনীতির দেশ ভারতের অলিখিত প্রধান ইতালিয়ান নাগরিক সোনিয়া গান্ধি ২০০ ভরি সোনা অথবা ১ কোটি টাকা নিয়ে খুব একটা উচ্ছসিত অথবা বিচলিত হবেন ভাবার কোন কারণ নেই। এই দেওয়ার ভেতর উচ্ছাস বলতে যা ছিল তার সবটাই ছিল আমাদের। সোনিয়া গান্ধি হাসলেন, ধন্যবাদ জানালেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন মৃতা শাশুড়িকে সন্মান জানানোর জন্যে। একজন প্রফেশনাল রাজনীতিবিদের যতটা করা যৌক্তিক তার সবটাই করলেন ভারত নেত্রী। এ বিবেচনায় আমাদের নেত্রী ও তার মন্ত্রিপরিষদের মহিলা মন্ত্রীদের ভুবনজোড়া হাসি আর বিশ্ব কাঁপানো উচ্ছাস নতুন করে প্রমান করেছে কেবল নেওয়া নয়, দেওয়ার ভেতরও সুখ লুকিয়ে থাকে। আর এ সুখ প্রকাশের জন্যে চাই একটা উপলক্ষ। ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিল তেমনি একটা উপলক্ষ। অবশ্য মন্দ লোকের ধারণা শাশুড়িকে নয় বরং গেল নির্বাচনে ক্ষমতায় বসানোর মূল্য পরিশোধ করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
বোধহয় দেওয়ার কোন মন্ত্র দিয়ে গেছেন সোনিয়া গান্ধি। তা না হলে এই নেত্রীর বিদায়ের পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার কেন দেওয়ার প্রতিযোগীতায় নামবেন। প্রতিযোগিতাটা অবশ্য নিজের সাথে নিজের মধ্যেই সীমিত রেখেছেন তিনি। প্রথম ঘোষনা এলো অনুপ চাটিয়াকে দেয়ার। আসামের উলফা নেতা অনুপ চাটিয়া অনেকদিন ধরেই আমাদের হাতে বন্দী। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে নয়,ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে উপহার দেয়া হচ্ছে অনুপ চাটিয়াকে। এ যেন রাজার পদতলে প্রজা বলি দেয়ার সামন্তযুগীয় আচার! সাথে আরও দেয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর, দেশের নড়বড়ে রাস্তাঘাট, জরাজীর্ণ রেললাইন সহ ক্ষয়িষ্ণু অবকাঠামোর অনেককিছু। বিনিমিয়ে কোন কিছু দাবি করা হবে বেহায়াপনা, এমনটাই ঘোষনা দিয়েছেন সরকারের জনৈক মন্ত্রী।
এখানেই থেমে থাকেননি চ্যাম্পিয়ন দেশপ্রেমিক নেত্রী। আজকের পত্রিকায় আরও কিছু দেওয়ার ঘোষনা এসেছে।
ভারতকে বাংলাদেশের ২৬১ একর জমি দিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা আসার আগেই বাংলাদেশের তামাবিল, নলজুড়ি ও লিঙ্কহাট সীমান্তের ২৬১ একর জমি ভারতের হাতে তুলে দেয়ার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করবে বাংলাদেশ সরকার। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাও জানিয়েছে এ খবর।
ফেলানী রক্তের সবটাই কি শুকিয়ে গেছে? নাকি কাঁটাতারে সীমান্তে এখনো ঝুলে আছে তার পরিধেয় বস্ত্র আর সাথে শুকিয়ে যাওয়া দুএক ফোটা রক্ত? বাংলাদেশিদের জীবন নিয়ে হোলিখেলায় অভ্যস্ত বেনিয়া ভারতীয়দের খাতিরযত্ন আর সেবাদাসত্ব করার যে উলঙ্গ সাংস্কৃতি চালু করছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার আসল উদ্দেশ্য কি কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে নীচের খবরটায়ঃ
ভারতীয় অর্থ এবং পরামর্শে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ফুটতে শুরু করে। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট সম্প্রতি প্রকাশ করেছে এ ধরণের একটি প্রতিবেদন।
http://www.economist.com/blogs/banyan/2011/08/bangladesh-looks-back
দুটি প্রতিবেশি দেশের সম্পর্ক কতটা অসম ও অনৈতিকতার উপর দাড়াতে পারে তার লজ্জাজনক উদাহরণ স্থাপন করতে যাচ্ছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এবং তার সবটাই করছেন মুক্তিযুদ্ধের নামে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কজন ভারতীয় মনেপ্রাণে স্বীকার করে জানা আছে কি ভারতপ্রেমী প্রধানমন্ত্রীর? ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দেনা শোধ করার থাকলে প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ হবে নিজের পকেট হতে দাসত্বের মূল্য শোধ করা। বিলিয়ন ডলার বানিজ্য ঘাটতি, ফারাক্কা অভিশাপ আর সীমান্তে ফেলানিদের লাশ রেখে প্রতিবেশীর দেনা শোধ করার মত তেমন কিছু নেই আমাদের। ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার দেনা শোধ যদি বাকি থাকে তাহলে বলব, কাড়ি কাড়ি অর্থ দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ই তা শোধ করে দিয়েছে সেই ৭১ সালে।