ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাবু মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ আগমন এখন সময়ের ব্যাপার। এ নিয়ে চলছে তুমুল আয়োজন। শাটল ডিপ্লোম্যাসিতে সরগরম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। প্রতিবেশি ৫টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে মনমোহন বাবু যেদিন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবেন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশিয় নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি সক্রিয় থাকবে প্রতিবেশি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার অনেক সদস্য। এডভান্স টিম হিসাবে ওদের অনেকেই এখন বাংলাদেশে। সরকার প্রধানের নিরাপত্তা প্রতিবেশি দেশের উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, তাই দফায় দফায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে পরখ করে নিচ্ছে স্থানীয় আয়োজনের নাট বল্টু। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সমকালীন ভূমিকা বিচার করলে ভারতের এহেন আচরন অনেকের কাছে অসংগতিপূর্ণ মনে হতে পারে, বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেখানে ভারতের বর্তমান পরিচয় উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে। কিন্তু আমরা যারা এই উদীয়মান শক্তির নিকট প্রতিবেশি তাদের অনেককেই অবাক করবে না একটা বেনিয়া জাতির আন্ত-প্রতিবেশি সম্পর্কের এই রুগ্ন চিত্র। পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ সহ প্রতিবেশি কোন দেশের সাথেই গ্রহনযোগ্য তেমন কোন সম্পর্কে নেই যা নিয়ে গর্ব করতে পারে আজকের ভারত। প্রতিবেশি দেশগুলোর অভ্যন্তরীন সমস্যার আড়ালে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা এতদিন সফল হয়ে আসলেও ইদানিং মুখ খুলতে শুরু করেছে বিশ্ব সম্প্রদায়। এ দৌড়ে ব্রিটেনের দ্যা ইকনোমিষ্ট ম্যাগাজিন অনেকটাই এগিয়ে। পাহাড় সমান বানিজ্য ঘাটতি, সীমান্ত জুড়ে ইসরায়েলী কায়দায় কাটাতারের বেড়া, চোরাচালান বানিজ্য নিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাব এবং ফ্রি স্টাইল বাংলাদেশি হত্যা কোন অবস্থাতেই যে সুপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাব প্রকাশ করেনা সাম্প্রতিক এক প্রকাশনায় তার বিস্তারিত তুলে ধরেছে এই ম্যাগাজিন। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর টানাপোড়ন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এমনটাই আশা করছে ভারত বান্ধব বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি ভিত্তিক সম্পর্কের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতীয় কমিটমেন্ট কতটা হাল্কা তার প্রমান মেলবে অতীতের পানি বন্টন চুক্তি ও এর বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় আনলে।
মনমোহন সিংয়ের সফর হতে সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশ কি আসলেই কিছু আশা করতে পারে? একথা বলার আপেক্ষা রাখে না অফিসিয়াল চুক্তির যে কোন ফসল ঘরে তুলবে বাংলাদেশ। চুক্তির মাধ্যমে যোগ করার মত এমন কিছু নেই ভারতীয়দের মেনুতে যা আনঅফিসিয়ালি আদায় হচ্ছে না বাংলাদেশ হতে। গোটা বাংলাদেশ পরিনত হয়েছে ভারতীয় পণ্যের অভয়ারণ্যে। চাল, ডাল, তেল, লবন, হাস, মুরগী, গরুর পাশাপাশি দেশটার আপদমস্তক গ্রাস করে নিয়েছে ভারতীয় হাল্কা ও ভারী শিল্পে। তুলা নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক চালবাজি এক ধাক্কায় পথে বসিয়েছে দেশের গোটা স্পিনিং শিল্পকে। প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল বাংলাদেশ ঘিরে বেড়ে উঠা ভারতীয় সূতা শিল্প। পোশাক শিল্পের সুসম চাহিদা মেটানোর তাগাদা হতেই বেড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের নিজস্ব স্পিনিং নেটওয়ার্ক। কিন্তু বেনিয়া ভারতীয়রা সহজভাবে নেয়নি এই উত্থান। নিজেদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে প্রতিবেশি দেশে পছন্দের রাজনৈতিক সরকার থাকা কতটা জরুরি তার প্রমান রেখেছে আজকের আওয়ামী লীগ সরকার। এই সরকারের কাধে বন্দুক রেখেই ছোড়া হয়েছিল প্রথম ভারতীয় গোলা। হঠাৎ করেই সরকার সিদ্ধান্ত নেয় স্থলপথে সূতা আমদানী বন্ধ করার। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় দেশের তাঁত শিল্পে। সূতার দাম আকাশে চড়ে রকেটের গতিতে এগিয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলস্বরূপ রাতারাতি বন্ধ হয় বাবুরহাট ভিত্তিক হাজার হাজার তাঁত। বেকার হয়ে পরে এর সাথে জড়িত কয়েক লাখ শ্রমিক। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের স্পিনিং মিলগুলো। লাগামহীন মূল্যের কারণে অনেকেই পুঁজি হারিয়ে সর্বশান্ত হতে বাধ্য হয়। গায়ের জোরে টিকে থাকতে গিয়ে বাকিদের বিনিয়োগ করতে হয় অতিরিক্ত মূলধন। ভারত হতে অতিরিক্ত মূল্যে তুলা কিনে নিজদের কারখানা চালু রাখার আয়োজন সমাপ্ত করার সন্ধিক্ষণে ঘটে অলৌকিক ঘটনা। বেনিয়া ভারতীয়রা রাতারাতি সূতার মূল্য অর্ধেক কমিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয় দেশের স্পিনিং মিল গুলোকে। তাঁতশিল্প তার নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কারণে মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হয় ভারতীয় সূতার উপর। মাঝখানে পথে বসে যায় এ কাজে নিয়োজিত স্থানীয় ভারী শিল্প। সাম্প্রতিক সময়ে একই অভিযোগ তোলা হচ্ছে দেশের চিকিৎসা খাত হতে। বড় ও আধুনিক কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে কথায় কথায় ভারতে চিকিৎসা করার সাংস্কৃতি হালে পানি পাচ্ছেনা দেশের উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান পরিবারে। আর এ কারণে পথে বসার অবস্থা হয়েছে বাংলাদেশি রুগী ভিত্তিক গড়ে উঠা ভারতের বিশাল চিকিৎসা নেটওয়ার্ক। দেশের চিকিৎসা খাতকে পরিকল্পিতভাবে অস্থির করে তোলার আভিযোগ এনেছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। অর্থনৈতিক স্বার্থের বাইরে গিয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারত বাংলাদেশের জন্যে কতটা করতে ইচ্ছুক তার নগ্ন উদাহরণ বাংলাদেশি ক্রিকেট। আইসিসির পূর্ণ সদস্য লাভের পর পৃথিবীর সব দেশে খেলার সুযোগ পেলেও আমাদের সবচেয়ে কাছের দেশ ভারতে খেলার সুযোগ পায়নি আমাদের ক্রিকেট দল। কারণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে এর লাভক্ষতির হিসাব। বাস্তবতা হচ্ছে, এমনটাই ভারতের আসল পরিচয়, লাভক্ষতি। এই লাভক্ষতির বাইরে গিয়ে প্রতিবেশি অনুন্নত দেশ বাংলাদেশের জন্যে তারা কিছু করতে ইচ্ছুক এমনটা যারা বুঝাতে চাচ্ছেন হয় তারা জাতি হিসাবে ভারতীয়দের চিনতে ভুল করছেন অথবা একই সরকারের আর্থিক সুবিধা নিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করছেন।
মনমোহন সিং বাংলাদেশে আসছেন এ দেশে আটক উলফা নেতাদের ফিরিয়ে নিতে, আসছেন সাত কন্যার জন্যে করিডোরের ব্যবস্থা করতে। আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম সহ বঞ্চিত সাতকন্যার বাকিদের বুকে দানাবেঁধে উঠা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করা জরুরি হয়ে উঠেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্যে। নিজেদের পছন্দের দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। এমন মোক্ষম সুযোগ হেলায় হারানোর মত বেয়াক্কেল দেশ ভারত নয়। বাংলাদেশিদের চোখে ধুলা দিতে কঠিন কঠিন শব্দে ভরা চুক্তি নামক কাগজে তারা স্বাক্ষর করবে ঠিকই কিন্তু আওয়ামী সরকারের বিদায়ের পর এর বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক হবে তার নমুনা পাওয়া যাবে পানি বন্টন সংক্রান্ত অতীতের চুক্তি হতে। বর্তমান আওয়ামী সরকার জোর গলায় প্রচার করছে দেশ হতে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের। সন্ত্রাসবাদের অর্থ যদি কেবল আসামের উলফা নেতাদের নির্মূল হয় সন্দেহ নেই সরকার চরম সফল এ কাজে। ইতিমধ্যেই সরকারের হাতে আটক অনেক উলফা নেতাকেই তুলে দেয়া হয়েছে ভারতের হাতে। কোন আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতির ভিত্তিতে এই হস্তান্তর সম্ম্পন্ন হয়েছে তার বিস্তারিত জানতে আমাদের বোধহয় আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। একপক্ষীয় এই হস্তান্তর বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ শান্তির ক্ষেত্রে কতটা হুমকির সৃষ্টি করবে তার ধারণা পেতেও অপেক্ষার বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের অন্যতম আখড়া আখ্যায়িত করতে মুখের চামড়া মোটেও মোটা করছে না বর্তমান সরকার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলা ভাই আর শেখ আঃ রহমান অধ্যায়ের পর দেশের মাটিতে এমন কোন ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের নিশানা পাওয়া যায়নি যা নিয়ে বিদেশে উত্থাপনের মত কেস তৈরী করা যেতে পারে। কিন্তু সরকার এমনটাই করে যাচ্ছে অনেকটা তোতা পাখির মত। অতীতের মত বর্তমানেও বাংলাদেশের আসল সন্ত্রাসী সমস্যা এর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা। আমাদের সবার জানা এই সমস্যার আসল জন্মদাতা প্রতিবেশি দেশ ভারত। অস্ত্র আর ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশের বৈধ একটা অংশকে বিছিন্ন করার চেষ্টা করেছিল ভারতীয় সরকার। ভারতীয়দের বেলায় যা বৈধ আমদের বেলায় তা সন্ত্রাসবাদ, এমন একটা হিপোক্রেসির সমাধা না করে পরেশ বড়ুয়া আর অনুপ চেটিয়াদের হস্তান্তর করা হবে আত্মহত্যার শামিল। আওয়ামী লীগ এমন একটা ফাঁদেই বোধহয় পা দিতে যাচ্ছে।
ভারতের মত বিশাল একটা দেশের সাথে স্থায়ী বৈরিতা কোনভাবেই আমাদের মত ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির দেশের কাম্য হতে পারেনা। আজকের ভারত উন্নত বিশ্বের জন্যেও উদাহরণ। আভ্যন্তরীণ সম্পদ কাজে লাগিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিভাবে সুসংহত করা যায় তৃতীয় বিশ্বের জন্যে ভারতীয় ভূ-রাজনীতি হতে পারে পারফেক্ট উদাহরণ। জাতি হিসাবে আমদের অনেক কিছু শেখার আছে ভারতীয়দের কাছে। কিন্তু নেংটা নতজানু অথবা ভাওতাবাজির বিরোধীতা কোনটাই এ কাজে সহায়ক হবেনা। এ সহজ সত্যটাই তুলে ধরতে হবে মনমোহন সিংয়ের সামনে।