মুনি-ঋষিরা বলে থাকেন ছবি নাকি কথা বলে। সত্য মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ হয়নি, তাই ছবি কথা বলে কিনা বলতে পারবো না। হয়ত ভাবুক জগতের একজন নই বলে ছবিরাও বুঝতে পারে আমার অযোগ্যতা। তাই তারাও কথা বলে না আমার সাথে। ছবির সমুদ্রে বাস করে আজ পর্যন্ত এমন একটা ছবির দেখা মেলেনি যার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়। চারদিকে যত ছবি তার সবটাতেই কেমন মিথ্যার বেশাতি, অসত্যের হলুদ রং। অপেক্ষার শেষে শেষ পর্যন্ত দেখা মিলল কাঙ্খিত তেমন ছবির যে ছবি কথা বলে, সত্যের কথা। ভাল করে তাকিয়ে দেখুন উপরের ছবিটা। কি এবং কাকে দেখছেন? একজন পুলিশ ও একজন আসামী? আপাত যা দেখছেন তার সবটাই সত্যি। একজন পুলিশ আসলেই একজন আসামীকে গ্রেফতার করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। এবং আসামীর হাতে হাতকড়া। খালি চোখে যা দেখছেন সেটাই ছবির একমাত্র কথা নয়। এর বাইরেও কিছু কথা আছে, এবং সে কথা গুলি নিয়েই আমার কথা।
ছবির একজনের পরিচয় পেতে কষ্ট করতে হবেনা, পোশাকই বলে দেবে তার আসল ও একমাত্র পরিচয়, পুলিশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারও গায়ে পুলিশের পোশাক উঠলে তার মনুষ্য পরিচয়ের দরকার হয়না, সে তখন কেবলই পুলিশ। দ্বিতীয় জনের একটা নাম আছে, আছে ধাম ও পেশার পরিচয়। আজিজার রহমান, বাড়ি জয়পুরহাট এবং পেশায় একজন কৃষক। ১২ বছর আগে আলু চাষের জন্যে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন স্থানীয় জনতা ব্যাংক হতে। ভাল দাম না পাওয়ায় জমেনি আলু চাষাবাদ। সংগত কারণে থমকে যায় ঋণ প্রবাহ। ডিফল্টারের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হন কৃষক আজিজার। ২০১০ সালে সুদে আসলে ঋণের অংক দাড়ায় ২০ হাজারে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশের আইন। ব্যাংকের ২০ হাজার টাকা লোপাট করে কোথাকার কোন আজিজার পার পেয়ে এমনটা হওয়ার দেশ বাংলাদেশ নয়। পার পায়নি আজিজারও। হাতকড়া লাগিয়ে হাজির করা যথাযত কর্তৃপক্ষের সামনে। আইন হয় সমুন্নত এবং ধন্য হয় জননী জন্মভূমির আইন ও বিচার ব্যবস্থা।
একজন পুলিশ ও একজন কৃষক। পেশার বিবেচনায় বিপরীত মেরুর দুই বাসিন্দা। একজন ফলায় এবং অন্য জন সে ফলনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এ ধরণের আরও কিছু মানুষ ও তাদের পেশার আবর্তেই বেড়ে উঠে একটা সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ। সমাজে বাস করতে গেলে কৃষকের প্রয়োজন যতটা গুরুত্বপূর্ণ ততটাই বাধ্যতামূলক পুলিশি বাস্তবতা। এরা একে অন্যের পরিপূরক। আরও একবার তাকিয়ে দেখুন ছবির দুজনকে। এবার একটু ভাল করে। পুলিশের উচ্চতা, ওজন ও চেহারার ঔজ্জ্বল্যের সাথে তুলনা করুন কৃষক আজিজারের। ডোরাকাটা শার্টের নীচে লুকিয়ে থাকলেও আজিজারের স্বাস্থ্য যে জীবন্ত কঙ্কালের বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকে বলবেন আজিজার কৃষক, গ্রীষ্ম বর্ষায় তাকে থাকতে হয় খোলা আকাশের নীচে। দুবেল দুমুঠো আহারের জন্যে তাকে শক্ত মাটিকে নরম করতে হয়, কাদামাটিকে শক্ত বানাতে হয়, এক পশলা বৃষ্টির আশায় তাকিয়ে থাকতে হয় আকাশের দিকে। স্বাস্থ্য ভাল থাকবে কি করে? পোশাকেই যার পরিচয় সে পুলিশকেও কাজ করতে হয়। কারণ তারও পেট আছে যা পূর্ণ করতে হয়, আছে বিশাল একটা পকেট যা ভর্তি করতে হয়। তবে সে কাজ অন্য কাজ। তার জন্যে রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আজিজারের মত কিছু ফলাতে হয়না। তার ফসল তাৎক্ষণিক, যা ঘরে তুলতে ব্যবহার করতে হয় ডান হাত বাম হাত এক সাথে। নাদুস নুদুস আর ইউরোপীয় চেহারার পুলিশের কাজ জয়পুরহাটের বেশ্যাখানায়, ভিক্ষুক আর ছিনতাইকারীদের আড্ডায়, চোরাচালানিদের মেলায়, ভেজাল ব্যবসায়ীদের কারখানায়। হিন্দি ছবির নায়কের মত অসত্য আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে একক লড়াই তার কাজ নয়, বরং জল, স্থল এবং অন্তরীক্ষের সম্ভাব্য সব জায়গা হতে কমিশন আদায়। এটাই তার প্রফেশন, বেচে থাকার মাধ্যম। আজিজারের মত কৃষক যারা ব্যাংক হতে সামান্য কিছু লোন নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন তথা জাতির মুখে খাবার তুলে দেয়ার প্রাণকর লড়াই করে যাচ্ছে তাদেরও রেহাই নেই কমিশন বাণিজ্য হতে। ছবির পুলিশ তাদেরই একজন যাদের অবদানে বাংলাদেশ নামক একটা দেশ বিশ্ব দুর্নীতিতে দাপটের সাথে রাজত্ব করে যাচ্ছে। এমন একজন পুলিশ হাতকড়া লাগিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কৃষক আজিজারকে। এটাই কি বাংলাদেশের আসল ছবি নয়? এটাই আমাদের আসল পরিচয় নয়?
এবার দেখুন নীচের মানুষটাকে। চোখ খুলে দেখুন। বিবেকের অলিগলিতে এক গামলা ঠান্ডা পানি ঢেলে দেখুন।
কি দেখছেন? একজন সৌম্য, শান্ত, শুভ্র ও পবিত্র দরবেশ, তাইনা? এ ছবি কার সাথে কি কথা বলে জানা নেই, কিন্তু আমার কাছে এ কেবলই একজন চোর, জালিয়াত, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট আর ঠগবাজের ছবি। নামে বেনামে এই দরবেশ ব্যাংক হতে হাজার কোটি সরিয়ে ফেঁদে বসেছেন এমন এক সাম্রাজ্য যে সাম্রাজ্যে এখন আর অস্ত যায়না। ১০ হাজার টাকার জন্যে আজিজারের হাতে ঝুলছে হাতকড়া আর এক হাজার কোটি টাকার ডিফল্টারকে পুরস্কৃত করা হয়েছে পুঁজিবাজারের দায়িত্বে বসিয়ে। আমাদের বিচার ব্যবস্থার এটাই কি আসল চেহারা নয়?
খবরে প্রকাশ, নোবেল বিজয়ী ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস ৫ কোটি আয়ের বিপরীতে কর দিয়েছেন ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। পাশাপাশি রাজনীতিবিদ নামের সোমালিয়ান জলদস্যুর দল আয়কর দুরে থাক বাৎসরিক আয় প্রকাশ করায় অনীহা প্রকাশ করেছে। কারণ উনারা খোদা প্রেরিত স্বর্গীয় আদম। ডক্টর ইউনুসকে টেনে হেঁচড়ে নামানো হয়েছে তারই প্রতিষ্ঠান হতে, আর করা না দেয়া জলদস্যুদের গায়ে ঝুলানো হচ্ছে জনপ্রতিনিধির তকমা। হিপোক্রেসির এমন উলঙ্গ প্রদর্শনীর অপর নামই কি বাংলাদেশি ছবি নয়?
পুলিশ আর আজিজারের ছবিটাই আমাদের আসল ছবি। এ ছবিই কথা বলে, বলে আসল কথা, সত্য কথা। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শেখ মুজিবের ছবি না টাঙিয়ে বরং টাঙানো হোক এ ছবি। এ ছবি জনপ্রতিনিধি মতিউরে ছবি, এ ছবি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাজাহান মিয়ার ছবি। মিথ্যাকে ধামাচাপা দেয়ার পারফেক্ট সৃষ্টি।