একসাথে তিন নারীর নোবেল জয়, তাও আবার শান্তিতে। গুয়েতমালার সোস্যাল একটিভিষ্ট রগোবের্তা মেঞ্চুর পর নোবেল কমিটি বোধহয় ভুলেই গিয়েছিল নারীদের কথা। তাই এবারের নোবেল কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে বিশ্ব নারী আন্দোলনে। শান্তিতে নোবেল নিয়ে অনেকদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেইন ওবামার নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে। দুই দুইটা যুদ্ধে লিপ্ত একটা দেশের কমান্ডার-ইন-চীফ'কে শান্তিতে নোবেল প্রদান গোটা নোবেল প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। বাংলাদেশের মাইক্রো ক্রেডিটকে পুরস্কৃত করায় বিশ্বের কোথাও প্রশ্ন না উঠলেও খোদ বাংলাদেশে বয়ে গেছে রাজনৈতিক সুনামি। গ্রামীন ব্যাংকের নোবেল প্রাপ্তি অনেকেই মনে করেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপের ফসল। যতদূর জানি নোবেল প্রক্রিয়াটাই এ রকম, কেউ না কেউ, কারও না কারও নাম প্রস্তাব করে যার উপর ভিত্তি করে নোবেল কমিটি নিজেদের সিদ্ধান্ত দেয়। এই কমিটির উপর একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কতটা প্রভাব তার কোন লিপিবদ্ধ রেকর্ড নেই, থাকলেও তা হবে অনেকটা গুড উইল জেস্টারের মত, যা আমরা কোন দিনই জানতে পারব না। ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস ও তার গ্রামীন ব্যাংকের পক্ষে ওকালতি করে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন কতটা অপরাধ করেছিলেন এবং তাতে দেশ ও জাতি হিসাবে বাংলাদেশিরা কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল সময়ই তার বিচার করবে। তবে একটা সত্য না মানলেই নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অথবা সাহিত্যের উপর নোবেল নিয়ে বাকি বিশ্বের মত আমাদের আগ্রহও সীমাবদ্ধ। আমরা এক রকম মেনেই নিয়েছি চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন অথবা অর্থনীতির মত জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর উপর নোবেল যাবে মার্কিন অথবা ইসরাইলি কোন বৈজ্ঞানিক অথবা গবেষকের ঘরে। এসব বৈজ্ঞানিক ও গবেষকদের অনেকেই যদি ইহুদি হয় তাতেও অবাক হওয়ার থাকবেনা। এ ব্যাপারে খোদ সৃষ্টিকর্তাই বোধহয় পেয়ারের বান্দা সৃষ্টিতে বৈষম্য করে থাকবেন।
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইলেন জনসন শারলিফ এবং একই দেশের শান্তিকর্মী লিমাহ গোবি নিজ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কি ভূমিকা রেখেছেন আমার মত সাধারণ পাঠকদের অনেকেরই জানা নেই। নাম দুটি আগে শুনেছি বলেও মনে করতে পারছি না। তবে দেশটায় বছরের পর বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং এই যুদ্ধে শান্তির ভূমিকায় রাজধানী মনরোভিয়া সহ অনেক শহরে বাংলাদেশি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে অথবা দিয়েছিল তার খবর জানতাম। চমৎকার এই দেশটায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে ইলেন জনসন ও তার সহকর্মী অবদান রেখে থাকলে নিশ্চয় তা পুরস্কারের দাবি রাখে। তবে পুরস্কারের টাইমিং নিয়ে খোদ লাইবেরিয়া কথা উঠেছে। এক সপ্তাহের ভেতর দেশটায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিরোধী দল অভিযোগ করছে নির্বাচন প্রাক্কালে এ ধরণের একটি আর্ন্তজাতিক পুরস্কার ভোটারদের প্রভাবিত করবে। আফ্রিকার প্রথম নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট নিজ দলের কাছেই ’লৌহমানবী’ নামে পরিচিত। নির্বাচিত হওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি হবেন এক টার্মের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাড়িয়েছে এ সিদ্ধান্তে। তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতালিপ্সু অনেক নেতা-নেত্রীর মত তিনিও দোহাই দিচ্ছেন জনগণের ইচ্ছাকে। ৭২ বছরের এই মহিলা জীবিত অবস্থায় ক্ষমতা হতে সড়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করবেন কিনা সময়ই প্রমান করবে। শুভেচ্ছা রইল আফ্রিকার এই দুই মহিলার জন্যে।
ইয়েমেনের তাওয়াকুল কারমানের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। পেশায় এই মহিলা একজন সাংবাদিক। মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষনশীল একটা দেশের নারী অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তিনি পথিকৃত। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্যেও তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তবে এখানেও টাইমিং’এর একটা ব্যাপার আছে। গোটা ইয়েমেন জুড়ে চলছে গণবিপ্লব। দেশটার প্রেসিডেন্ট বিদ্রোহীদের গোলার আঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রতিবেশি সৌদি আরবে। ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে দেশটার একজন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীকে শান্তি পুরস্কার অনেকেই চলমান আন্দোলনে পশ্চিমা দুনিয়ার নীরব সমর্থন ও উস্কানি হিসাবেই দেখবেন। সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার তাই গুরুত্ব দেয়নি তাওয়াকুলের নোবেল প্রাপ্তি খবরকে। আভ্যন্তরীণ বিতর্ক যাই থাক নোবেল কমিটি নিশ্চয তাওয়াকুলের মাঝে এমন কিছু দেখে থাকবে যা পুরস্কৃত করা যথাযোগ্য মনে করেছে। অভিনন্দন রইল সমস্য জর্জরিত দেশে সামাজিক বৈষ্যমের শিকার নারীর বিরল সন্মান প্রাপ্তিতে।
শান্তিতে তিন জন নারী নোবেল পেল অথচ এই তালিকায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম নেই ব্যাপারটা কেমন যেন একপেশে মনে হল। গত একটা বছর সন্ত্রাস মোকাবিলা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠ ও স্বদেশে স্মরণ কালের সবচাইতে টেকসই শান্তি নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন শেখ হাসিনা। পরিবেশ ও জলবায়ু সংক্রান্ত এমন কোন আর্ন্তজাতিক সন্মেলন নেই যেখানে সদলবলে যোগ দেননি। দেশে বিদেশে নিয়মিত কথা বলেছেন শান্তির উপর। এর উপর বেশ কটা সম্মানসূচক ডিগ্রিও পেয়েছেন ইতিমধ্যে। জাহাঙ্গির কবির নানক ও মির্জা আজম নামের দুই লেফট্যানেন্ট গেল একটা বছর ধরে পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন শান্তিতে নেত্রীর অবদান ছড়িয়ে দেয়ার মিশন নিয়ে। মাইক্রো ক্রেডিটের মত বাংলাদেশের ’বিরাজমান শান্তি'কে মডেল হিসাবে গ্রহনের জন্যে দেখা করেছেন বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে। মিশনের সফল সমাপ্তির শেষ পর্ব হিসাবে খোদ প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন জাতিসংঘে। ৯০ জন সঙ্গী ও কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ের নোবেল মিশন সফল না হওয়ায় নিশ্চয় আশাহত হয়ে থাকবে এ কাজে নিয়োজিত দলীয় যোদ্ধারা। সমবেদনা রইল তাদের সবার জন্যে। নোবেল প্রতিবছরের পুরস্কার। মন খারাপ করার কিছু নেই, লেগে থাকলে হয়ত সামনের বার সফল হওয়া যাবে।
তবে এর আগে এবারের ব্যর্থতার উপর একটা বিশদ অটোপসি মিশনের সফল সমাপ্তিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করি। এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু রেকোমেনডেশনস আছে। যেমনঃ
- ক্রসফায়ারে হত্যা পর্ব সূর্যোদয়ের পরিবর্তে মধ্যরাতে সমাধা করতে হবে যাতে পশু পাখির দল পর্যন্ত স্বাক্ষী না হতে পারে। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে এই পাখির দল ঋতু পরিবর্তনের সাথে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে উড়ে যায় এবং নোবেল কমিটির কাছে প্রকাশ করে দেয় শান্তি প্রতিষ্ঠার এই অভিনব মডেল।
- মিডিয়া নিয়ন্ত্রনে বাকশালী আইন পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। এ যাত্রায় ৪টা নয়, প্রিন্ট মিডিয়ার সবকটাকে সুযোগ দিতে হবে। শর্ত থাকবে শান্তিতে নোবেল ব্যাহত হয় এমন কোন খবর প্রকাশ করা যাবে না।
- সাগরের তলদেশে সাবমেরিন ক্যাবল কেটে ভার্চুয়াল দুনিয়ার কবর রচনা করতে হবে।
- বিরোধী দলকে রাস্তায় নয়, মোকাবেলা করতে হবে অন্দর মহলে যাতে কূটনৈতিক পাড়ায় না পৌছায় ক্ষমতা স্থায়ী করার এই মডেল।
- গোপনে বিদেশিদের হাতে নয়, শেখ হাসিনার শান্তির মডেল তুলে দিতে হবে দেশের প্রতিটা শিশু, কিশোর, তরুন ও আবাল বৃদ্ব বনিতার হাতে।
- বিদেশ ভ্রমনে ১০০/২০০ জন নয়, সঙ্গী বানাতে হবে ৫০০ জনকে, যাদের মূল কাজ হবে বিদেশের মাটিতে শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তিতে জনমত সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশে বিরাজমান শান্তির সমুদ্রে কেবল ১৬ কোটি মানুষ অবগাহন করবে এমনটা ভাবা হবে অন্যায়। ৫ বিলিয়ন জনসংখ্যার বাকিদের বঞ্চিত রেখে শেখ হাসিনার শান্তি কেবল আমরা ভোগ করবো এ হবে নাৎসিদের অপরাধের শামিল। আমাদের শত বছরের মিশন হাতে নিতে হবে। শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তি নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত থেমে গেলে চলবে না। বাংলায় একটা কথা আছে, একবার না পারিলে দেখ শতবার। শতবার কেন, প্রয়োজনে হাজার বার চেষ্টা করতে হবে।