ভিসা নিয়ে আমেরিকান দূতাবাস হতে বেরুতে বেরুতে বেশ বেলা হয়ে গেল ছ্যারছ্যার আলীর। ভিসা তদ্বীরে ঢাকা ফেনী দৌড়াদৌড়ি আর নেতা-নেত্রীর পা ধরাধরি করতে গিয়ে জীবনটাই ওষ্ঠাগত হওয়ার মত অবস্থা। ভিসাটা হাতে আসতেই নিজকে বেশ হাল্কা মনে হল। কয়েকটা ফোন করা দরকার। কিন্তু এ মুহুর্তে ভিসা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছিল না তার। বাদ দিল ফোন করার তাগাদা। আইনুন নাহারের কাছে যাওয়ার ইচ্ছাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সকাল হতে। কিন্তু ওখানে আজ ওসি সাহেব আসবেন, তাই ইচ্ছাটা ত্যাগ করতে হল আনেকটা বাধ্য হয়েই। গুলশানের নিকুঞ্জে ছাগলনাইয়্যার সাংসদ ইলশা হাজী বেনামে একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন, ওখানটায় রাখা হয়েছে আইনুন নাহারকে। শহরের ডিসি, এসপি, ওসি সহ গন্যমান্য যারাই ঢাকায় আসেন ইলশা হাজীর নিকুঞ্জ ফ্লাটে মেহমান হন। আইনুন নাহারের অতিথি হতে কে কোনদিন ঢাকা আসবে এ নিয়ে অলিখিত একটা রুটিন আছে ছাগলনাইয়ার উচু মহলে। ছ্যারছ্যার আলী গেল সপ্তাহে দু’টা দিন কাটিয়ে গেছে আইনুন নাহারের কাছে, এ সপ্তাহটা ওসি সাহেবের জন্য বরাদ্দ। আজ ওখানটায় যাওয়ার কোন সূযোগ নেই, ভাবতেই মনটা তিরিক্ষি হয়ে গেল তার। পাসপোর্টটা খুলে ভিসাটা আরও একবার পরখ করল, এবং গাড়ির ড্রাইভারকে কষে একটা চড় মেরে ফেনী রওয়ানা হওয়ার হুকুম দিল ছ্যারছ্যার। ড্রাইভারও জানে কেন তাকে চড় মারা হয়েছে, তাই এ নিয়ে সে উচ্চবাচ্য করল না।
ছাগলনাইয়ার একেক্ জনের কাছে একেক্ পরিচিতি ছ্যারছ্যার আলীর। এ নিয়ে শহরে চালু আছে হাজার রকম গল্প। কারও কাছে তিনি নেতা, কারও কাছে দেবতা, কারও ফেন্সিডিল ব্যবসার বস, আবার কারও কাছে মদ, মেয়েমানুষ ভোগ করার বিশ্বস্ত পার্টনার। যদিও সব ছাপিয়ে ছ্যারছ্যার আলীর বড় পরিচয় তিনি ছাগলনাইয়্যা এএনপির (আসল ন্যাশনালিষ্ট পার্টি) সাধারণ সম্পাদক, নিজকে গরীবের বন্ধু আর অনাচারীদের জন্যে দস্যু বনহুর হিসাবে পরিচয় দিতে ভালবাসেন তিনি। গেল ৮টা বছর পার্টির জন্যে দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন বড় কোন পদ ছাড়াই। যদিও র্দুমূখদের কাছে শুনতে গেলে শোনা যাবে ভিন্ন কাহিনী। দল ক্ষমতা হারানোর পর হতেই ৭নং বিবি ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে দিয়েছে, ’অনেক হয়েছে জনসেবা, এবার আমাদের বিশ্রাম দরকার’। আমেরিকা যাওয়ার ধারণাটা আসলে ওখান হতেই জন্ম। বিবির মুখটা মনে হতে মুচকি হাসল ছ্যারছ্যার, অশ্রাব্য কিছু খিস্তি বেরিয়ে এল মুখ হতে, ’শালী! আমেরিকা মারাও! কংকাল লইয়া আমেরিকা গিয়া আমি কি রোজা থাকুম না-কি !’ সাদা মেয়ে মানুষের কথা মনে হতে জিহ্বায় পানি এসে গেল তার। ছাগলনাইয়া গিয়ে প্রথম কাজ হবে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী প্রাক্তন সাগরেদদের ফোন করে খবরটা পৌছানো, ভাবল ছ্যারছ্যার।
আগষ্টের ২১ তারিখ। গ্রীষ্মের সোনাঝরা সকালে গলফ এয়ারের ফ্লাইট হতে বেরিয়ে এল ছাগলনাইয়্যা এএনপির সাধারণ সম্পাদক ছ্যারছ্যার আলী। নিউ ইয়র্ক! চারদিকে ছিমছাম ভাব আর বহুত কিসিমের মেয়ে মানুষ দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে গেল তার। ’ইয়েস স্যার’ ’নো স্যার‘ ‘মাই লীডার স্যার‘ ‘নো কম্পোপ্রাইজ উইথ এরশাদ স্যার‘- ইমিগ্রেশনে এ জাতীয় ক’টা ইংরেজী বাক্য ব্যায় করে গর্বিত পায়ে বেড়িয়ে এল জেএফকে’র ৪নং টার্মিনাল হতে।
’কিরে বান্দির পুত জইল্যা, খবর কি? শরীরটা ত বেশ বালা বানাইছস‘, টার্মিনালে প্রাক্তন সাগরেদ জলিলকে দেখে চীৎকার করে উঠল ছ্যারছ্যার। ‘আপনি ইডা কি কইত্যাছেন ছ্যারছ্যার ভাই, আমার নাম জইল্যা না, জেলি রোমেন, আর যা কওনের আস্তে কন, ইমিগ্রেশন শুইন্যা ফেলাইলে বিপদ অইব‘, হায় হায় করে উঠল ছাগলনাইয়ার জলিলুর রহমান, ওরোফে নেংরা জইল্যা। এক সময় ফেনীর নামকরা পকেটমার ছিল জলিল। ৬ বার গণধোলাই আর ১৩ বার পুলিশের ধোলাই খেয়ে জানটা যখন কবুতরের মত আসে যায় তখনই ছ্যারছ্যার আলীর সাথে দেখা, তাও আবার থানায়। জহুরীর জহর চিনতে ভূল হয়না, ছ্যারছ্যারেরও ভূল হয়নি জলিলকে চিনতে। মেয়ে সাপ্লাই বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। ছ্যারছ্যারের ঠিকাদারী কোম্পানী ’এয়ার & এয়ার লিমিটেড’এ কাজ পেয়ে জলিলও যোগ্য প্রতিদান দেয় মনিবকে। সমস্যা দেখা দেয় ২টা বছর পর। আমজনতা লীগের কমিশনার ইজ্জত আলীর মেয়েটাকে হাত করতে গিয়ে ফ্যাসাদে জড়িয়ে পরে জলিল। মেয়েটার চরিত্র এমনিতেই ভাল ছিলনা। কিন্তূ ছ্যারছ্যার আলীর নাম শুনতে কেন জানি ঢোল বাজিয়ে চারিদিক রটিয়ে দেয় কুমতলবের কথা। ছ্যারছ্যারের সাজানো বাগানে হঠাৎ করেই দেখা দেয় অমানিশার অন্ধকার। কমিশনারের গুন্ডা বাহিনী তক্তা মাইর মেরে ডান পা’টা অচল করে দেয় জলিলের। মান-ইজ্জত বাচাতে নিজ পকেটের ১৯ লাখ টাকা খরচ করে জলিলকে নিউ ইয়র্কগামী এক যাত্রা দলের সাথে ভিড়িয়ে দেয় ছ্যারছ্যার। ‘ছ্যারছ্যার ভাই, কথাটা আফনেরে জানাইয়্যা রাখা ভাল, হুটহাট কইর্যা আমারে জইল্যা নামে ডাইকেন্না, আফটার অল আমি এএনপি নিউ ইয়র্ক শাখার লিয়াজো অফিসার’ গম্ভীর গলায় জানিয়ে দিল এক কালের নেংরা জইল্যা। ‘কি কইলি, লেজুড় অফিসার? ইডার লাইগ্যা কি তুরে আমি আমরিকা পাঠাইছিলাম শালা বাইন চুত?‘ ফেটে পরল ছ্যারছ্যার।
‘গাই মইত্তা কই?' আবদুল মতিন ওরফে গাই মইত্তা। তার চাক্রী ছিল পরশুরাম গরুর হাটে ছ্যারছ্যারের জন্যে চাঁদা উঠানো। চাঁদা না পেয়ে গাই গরুর ওড় হতে সারাসরি দুধ খেয়ে ’গাই মতিন’ উপাধি পায় নিউ ইয়র্ক এএনপির বর্তমান সাংস্কৃতি সম্পাদক এম এ মে-টিন। চীনা এক পতিতাকে বিয়ে করে এ দেশে বৈধ হয়েছে, তাই নামটাতেও যোগ করতে হয়েছে কিছু চাইনিজ মশলা। ‘ও এখন জাতিসংঘে এশিয়া বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারির সাথে সাপ্তাহিক মিটিং করছে, শেষ করেই আপনার কাছে চলে আসবে‘, জবাব দিল জেলি রোমেন। ছ্যারছ্যার আলী আকাশের দিকে তাকায়। চারদিকের বাতাস কেমন ভারী ঠেকল তার কাছে। ’এরা কারা! যাদের দিয়ে দুনিয়ার আকাম কুকাম করিয়েছে আজ তাদের জাতিসংঘে ঘুরাফেরা, চাইনিজ মাল ভক্ষণ‘, হিসাব মেলাত পারল না ছ্যারছ্যার। ‘খানকির পুলারা, এএনপির মিটিং ডাক, আমি ভাষন দিমু, দরকার লাগলে নিউ ইয়র্ক ছ্যড়াবেড়া কইরা ফেলামু, পয়সা দিয়া একস্ট্রা কিছু মানুষ যোগাড় কর,’ এক দমে কথাগুলো বলে ফেল্ল ছ্যারছ্যার। ’লেংগুর বহুত লম্বা হইছে বান্ধীর বাচ্চাগো, এইবার কাটন লাগব। আমি ছ্যারছ্যার ৭ বিবি ফালাইয়্যা এতদূর আইলাম, আর তুরা খবর পাইয়্যাও জাতিসংঘ মারান শুরু কইর্যা দিলি?‘ রাগে ক্ষোভে ফেটে পরল সে। ছাগলনাইয়ার অতি পরাক্রমশালী নেতা ছ্যারছ্যার আলীকে জেএফকে’র বাইরে এনে এক বাংগালী ক্যাব ড্রাইভারের হাতে গছিয়ে দিয়ে জনারণ্যে মিশে গেল নিউ ইয়র্ক এএনপির অন্যতম কর্ণধার জেলি রোমেন। সেন্ট্রাল কমিটির এক জাঁদরেল নেতা এসেছেন ঢাকা হতে। নেতার জন্যে চীনা পল্লীতে পতিতা খোজার দায়িত্ব পরেছে তার উপর। আগামী কাল উডসাইডের ’ঢাকা ক্লাব’এ আয়োজন করা রয়েছে নেতার জন্যে বিশাল এক সম্বর্ধনা। দু’দিন পর ব্রুকলেন ডিসষ্ট্রিক্ট কোর্টে হাজিরা দিতে হবে চেস ব্যাংকের দায়ের করা ক্রেডিট কার্ড ফ্রড মামলার শুনানিতে। মনটা এমনিতেই ভাল নেই জেলির। তাই ছ্যারছ্যার আলীর মত পাতি নেতা নিয়ে মাথা ঘামানোর তাগাদা অনুভব করল না ।
'ছ্যারছ্যার ভাই, কিমুন আছেন?’, ক্যাব ড্রাইভারের প্রশ্নে সম্বতি ফিরে পেল ছ্যারছ্যার। ’আমি মলম শেখ, আপনার ডিপটিউবওয়েল প্রজেক্টের উপ-সহকারী হিসাব রক্ষক’। ছ্যারছ্যার আলীর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন, মলম শেখ! তার ৭টা ডিপটিউবওয়েল একসাথে বিক্রী করে প্রধান হিসাব রক্ষক্কে খুন করে প্রায় ৩০ লাখ টাকা নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মলম শেখ, মনে করার চেষ্টা করল ছ্যারছ্যার। ‘হ , আপনি ঠিকই ধরছেন ভাই, আমিই সেই মলম শেখ’, মিনমিন গলায় বলে গেল মলম। ‘গাড়িটা থামলেই আপনার পা ধরে মাফ চেয়ে নেব বড় ভাই, অনেক গুনাহ করছি, মাফ কইর্যা দিয়েন’, প্রায় কেঁদে ফেল্ল মলম। ‘জেলি ভাই আপনাকে আমার হাতে গছিয়ে দিয়ে পালিয়েছে, আমি জানতাম আপনি আসছেন তাই গাড়ি নিয়ে টার্মিনালের বাইরে অপেক্ষায় ছিলাম’, কথাগুলো বলে রেয়ার ভিউ মীররে ছ্যারছ্যার আলীর চেহারাটা দেখার চেষ্টা করল মলম। ’যতদিন আছেন আমার কাছেই থাকবেন, পান-চিনির কোন অসুবিধা অইবনা’, অপরাধীর মত শোনালো মলমের গলা। ‘তুর মার খবর কি?’ জানতে চাইল ছ্যারছ্যার। ‘মা বাইচ্যা নাই’। মলমের মার দিকে হাত বাড়িয়েছিল ছ্যারছ্যার, প্রতিশোধ নিতেই ডিপটিউবওয়েল প্রজেক্টের বারোটা বাজিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় মলম। অনেক খোঁজাখুজি আর প্রচুর টাকা পয়সা উড়ানো হয়েছে মলমের সন্ধানে। কিন্তু কোথাও কোন হদিস মেলেনি। ‘শুইন্যা খুশী হইবেন, প্রবাসী ডিপটিউবওয়েল ব্যবাসায়ী-কর্মচারীদের বড় একটা সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে এই নিউ ইয়র্কে। আপনাগো দোয়ায় আমি এই সংগঠনের প্রধান হিসাব রক্ষক’, অনেকটা গর্বের সাথে বলে গেল মলম শেখ।
গাড়ি গ্রান্ড সেন্ট্রালে উঠতেই প্রচন্ড বজ্রপাতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, সাথে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কথা না বলে জানালার কাচটা একটুখানি নামিয়ে দিল ছ্যারছ্যার। বৃষ্টির ভারি ফোটায় ভিজে গেল তার চোখ মুখ। প্রচন্ড গতির বাতাস আর কড়কড় শব্দের বিদ্যুৎ চমকানীতে সামান্যতম বিচলিত হলনা সে। ছাগলনাইয়ার কথা মনে করার চেষ্টা করল সে। ’আমি রাজনীতিবিদ, আমাকে এত সহজে কাবু করতে পারবেনা জইল্যা চোরার দল, আমি তাগো বাবা, আমার উপর বাটপারি, আমিও দেখে নেব কত ধানে কত চাইল!‘ রাগে, ক্ষোভে শক্ত হয়ে গেল ছ্যারছ্যারের চোয়াল।
‘আসলে আমি না, ইলশা হাজী হাত বাড়িয়েছিল তুর মার দিকে‘, এত সহজে মিথ্যা কথাটা বলতে পারবে ভাবতে পারেনি সে। প্রচন্ড বজ্রপাতে কেঁপে উঠল গাড়িটা। চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল বিদ্যুৎ চমকে। শেষ কথাগুলো মলম শেখের কানে পৌঁছালো কিনা ঠিক বুঝতে পারল না সে।