’সিম্পল লিভিং এন্ড হাই থিংকিং’, উইকএন্ড সকালটা এমন একটা চমৎকার বানী দিয়ে শুরু হবে ভাবতে পারিনি। নব বর্ষের শুরু হতে একটার পর একটা ভাল খবর পাচ্ছি। মন মেজাজ এমনিতেই ছিল ফুরফুরে। তার উপর এমন একটা চমৎকার বানী, এ যেন অঝোর বর্ষন শেসে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। হতে পারে অনেকের জন্যে বানী, কিন্তু আমার বেলায় তা গোটা জীবনের প্রতিচ্ছবি, আয়নায় দেখা নিজের জীবন। যাপিত জীবনের সবটাই বোধহয় কাটিয়ে দিয়েছি এমন একটা স্বপ্নকে সেন্টার অব গ্রাভিটি বানিয়ে, ’ছেড়া কাঁথায় বাস কর এবং স্বপ্ন দেখ লাখ টাকার’। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে দিনান্তে ঘরে ফিরে জীর্ণ আর মলিন বিছানাটায় শুয়ে কতই না অসম্ভব স্বপ্ন দেখেছি। অথচ বিছানার কয়েক ক্রোশ দূরেই ইটের উপর ইট গেথে দৈত্যের মত দাড়িয়ে থাকে বিশাল সব অট্টালিকা। সন্ধ্যা নামতে ওখানটায় জমে উঠে আলোর মেলা, মুখরিত হয় স্বল্পবসনা রমণী আর রঙ্গিন পানির ঝলকানিতে। রাতের পর রাত কল্পনা করেছি বিত্ত বৈভবের ঝলকানিতে আমিও আলোকিত করছি এসব এলাকা। কিন্তু সিম্পল লিভিংয়ের সংজ্ঞায় বাস করতে গিয়ে হাই থিংকিং হিসাবেই থেকে গেছে এসব চাওয়া পাওয়া।
গেলবার দেশে গিয়ে পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা। পল্টন লাইনের আজাদ প্রডাক্টের সামনে বন্ধুকে দেখে চিনতে পারিনি প্রথমে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, চোখ ঢুকে গেছে কোটরে। ইদানিং কি করা হয় জিজ্ঞেস করতে উত্তর দিল নতুন একটা এয়ারলাইনস খোলার ধান্ধায় আছে। বিস্তারিত জানাতে গিয়ে যা বলল তাতে ইমপ্রেসড না হয়ে পারিনি। তার সহজ কথা, ছেড়া কাঁথায় শুয়ে যদি স্বপ্নই দেখতে হয় তাহলে লাখ টাকা কেন, কোটি টাকার স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি! ইদানিং বন্ধুর ভুতই হয়ত আমার উপর ভর করেছে। কাছাকাছি একটা শহরে বৃটিশ বিলিয়নার স্যার রিচার্ড ব্রানসন মহাশূন্য যাত্রার কমার্শিয়াল ফ্লাইট চালু করতে যাচ্ছেন। স্বপ্নই যদি সিম্পল লিভিংয়ের একমাত্র উপাদান হয়ে তাহলে টাকা দিয়ে মহাশূন্যে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে অসুবিধা কোথায়? সে জন্যেই বোধহয় স্বপ্ন দেখি মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি এবং শত শত মাইল উপর হতে অবজ্ঞা ভরে দেখছি নিজের বিবর্ণ জীবন। এক কথায় সিম্পল লিভিং বাট হাই থিংকিং।
শনিবার সকালটা আমার সাথে শেয়ার করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা এতদিন ছিল একান্তই নিজস্ব কিছু, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটা প্রকাশ্যে এনে বৈধতা দিলেন । ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গণভবনে আয়োজিত শুভেচ্ছা সভায় আমার গোপন কথাটাই যেন প্রধানমন্ত্রী ফাঁস করে দিলেন। তিনি বললেন, ‘ধন-সম্পদ-টাকা-পয়সা-জৌলুস কিছু দিতে পারেনা, আর ওদিকে নজর দিলে জাতিকেও কিছু দেয়া যায়না। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সিম্পল লিভিং এন্ড হাই থিংকিং মাথায় রেখে চলতে হবে।’ উনি বলছিলেন খাল কেটে কুমির আনার প্রসঙ্গ নিয়ে। রাজনীতির জটিল ভাষার সহজ বাংলা করলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সারমর্ম দাড়াবে, তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা খাল, আর এ সরকারের সাথে জড়িতরা কুমির। তিনি প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের সে প্রশ্নই করছিলেন, খাল কেটে কেন কুমির আনা? তত্ববাধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়, প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের এমন ’গোয়ার্তুমি’ দাবির জবাব দিতে গিয়ে তিনি বললেন, ’তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রয়োজন কি? খালা কেটে কুমির আনার দরকারটা কি? তত্ত্ববধায়ক এলেই যে তাদের চ্যাংদোলা করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে তা নয়, বরং আবারো জেলের ভাত খেতে হতে পারে’। তত্ত্ববধায়ক আমলের এই জেল জেল খেলাটা যে তিনি ভুলতে পারেননি সহজেই বোঝা যায়। ভোলার কথাও নয়। ক্ষমতার বিপদজনক কাছ হতে সোজা জেলখানা, এমন বাস্তবতা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির রাঘব বোয়ালদের কারও পক্ষেই মেনে নেয়ার কথা নয়। রাজনীতির এসব জটিল সমীকরণ নিয়ে মাথা ঘামানোর মত উন্নত মস্তিষ্ক আমার নেই, তাই এ নিয়ে গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। সময় হলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাই এর উপর এফিটাফ লিখবেন। তবে আমার মত আমজনতার সহজ সরল হিসাব নিকাস হতে যা বেরিয়ে আসে তা হল, সম্ভাব্য জেলের ভাত হতে দুরে থাকার ভয়ই তত্ত্বাবধায়ক নামক উদ্ভট সরকারকে নির্বাসনে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে বর্তমান সরকার। যদি তাই হয় তাহলে সামনের সাধারণ নির্বাচন যারা চিন্তিত তারা চাইলে হাফ ছাড়তে পারেন। কারণ জেল হাজতের ভয় কেবল এক পক্ষের নয়, এ ভয় হতে দেশের কোন পক্ষই মুক্ত নয়। দেশ নিয়ে আমরা যারা চিন্তিত তারা আশা করব এমন একটা সময় আসবে যখন জেলের ভয় বিবাদমান পক্ষ গুলোকে এক হতে বাধ্য করবে। কোন এক সুন্দর সকালে আমরা যদি জানতে পারি আলোচনার টেবিলে হাসিনা খালেদা দেশ নামক পারিবারিক সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন এবং রাজী হয়েছেন পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতার পালাবদলে তাহলে নিশ্চিন্ত হতে পারব দেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। হতে পারে এমন ভাবনা সিম্পল লিভিং এন্ড হাই থিংকিংয়ের ফসল।
ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর সিম্পল লিভিং এন্ড হাই থিংকিংয়ের আহ্বান শুনে আমার কেন জানি মৌলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর কথা মনে পরে গেল। সুযোগের ভরা যৌবনে ৭১’এর খুনি এই ধর্ম ব্যবসায়ী দেশের পথে প্রান্তে তফসির করে বেড়াতেন, বলতেন ধর্মের কথা, শোনাতেন ন্যায় অন্যায়ের কথা। ছাত্রলীগের আসরে শেখ হাসিনার সিম্পল লিভিংয়ের কথা কেন জানি সাইদীর তফসীরের কথাই মনে করিয়ে দিল। ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী দলের প্রতি সদস্যের হাতে রক্ত, তাদের হাতে জিম্মি দেশের অর্থনীতি, বিপর্যস্ত দেশের সমাজ ব্যবস্থা। এমন একদল ভয়ংকর সন্ত্রাসীর সামনে দাড়িয়ে সিম্পল লিভিংয়ের কথা বলা আর ৭১’এর খুনিদের নিয়ে ধর্মের কথা বলা একই রকম শোনায়, অন্তত আমার কানে। এ কথা চিরন্তন সত্য সাধু হোক আর সন্ত্রাসী হোক ছাত্রলীগে জড়িত তরুণদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচন জেতা খুব একটা সহজ নয়। শেখ হাসিনার নির্বাচনও এর বাইরে নয়। তাই না চাইলেও ছাত্রলীগের তাবৎ কর্মকান্ডের দায়িত্ব নিতে হবে খোদ শেখ হাসিনাকেই। রাজনীতির মাঠে সন্ত্রাসী লেলিয়ে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করার কৌশল বাংলাদেশে অত্যন্ত পুরানো ও পরীক্ষিত কৌশল। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল আর ছাত্রশিবির এ কৌশলের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ভেটারান। এই এরাই শেখ হাসিনার মত নেত্রীদের ক্ষমতায়নের মসলা যোগায়, চুনসুরকিতে পাঁকা করে হাই লিভিং এন্ড সিম্পল থিংকিংয়ের সিঁড়ি। জাতিকে সিম্পল লিভিংয়ের মাসি পিসির গান শুনিয়ে নিজেরা হাই লিভিংয়ের আরব্য উপন্যাস রচনা করবেন এমনটাই বোধহয় আমাদের রাজনীতি। সে রাজনীতির বাস্তবতাই নতুন করে মনে করিয়ে দিল প্রধানমন্ত্রীর চমকপ্রদ তত্ত্ব।