লেখাটা যখন লিখছি গাড়ি বহর নিয়ে চট্টগ্রামে শোডাউন করছেন বিরোধী দলের নেত্রী। রাজনৈতিক কার্যক্রমের অংশ হিসাবে গোটা বাংলাদেশকে এধরণের শোডাউনের আওতায় আনা হয়েছে ইতিমধ্যে। বলা হচ্ছে এটা হবে রাজনৈতিক সাংস্কৃতির নতুন সংযোজন রোডমার্চের শেষ পর্ব এবং এরপর আসবে সরকার পতনের ডাক ও এতদসংক্রান্ত নতুন কর্মসূচী (ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে)। যারা বিরোধী রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত তাদের জন্যে নিশ্চয় এটা একটা খবর এবং চাইলে এ নিয়ে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ রাজনীতির নতুন অধ্যায় লিখতে পারবেন। কিন্তু আমার মত দেশীয় রাজনীতিকে যারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার আন্তপারিবারিক লড়াই হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত তাদের জন্যে এসব কোন খবর নয়, বরং ক্ষমতার সিঁড়ি ডিঙ্গবার নয়া কৌশল মাত্র। খালেদা জিয়ার রোডমার্চ ক্ষমতার রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে তা জানতে আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে গাড়ি বহরের মত রাজকীয় রোডমার্চ একটা দরিদ্র দেশে কতটা নৈতিক এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে খুব একটা অন্যায় হবে বলে মনে হয়না। শিল্পোন্নোত যে কোন দেশে এ ধরণের প্রদশর্নী আভ্যন্তরীণ রেভিনিউ সার্ভিসের ঘুম হারাম করার কথা। বৈধ আয়-ব্যয়ের কোন সমীকরণই বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের গ্যারাজে গাড়ি জমা করার কথা নয়। বাস্তবতা হল, আমাদের ডিকশনারিতে বৈধ আয় বলতে কিছু নেই। এখানে সব আয়ই আয় এবং সব আয়ই বৈধ। প্রধান বিচারপতি যেমন অবৈধ রায় দিয়ে ’বৈধ’ অর্থ আয় করেন তেমনি প্রধানমন্ত্রী পিতার নামে মাজার বানিয়ে ’বৈধ’ চাঁদা উঠাতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। ক্ষমতার ভরা যৌবনে বিএনপি ও তার সহযোগীরাও একই পথেই হেঁটেছিল এবং প্রস্তুতি নিয়েছিল দুঃসময় মোকাবেলার। বিএনপির এখন দুঃসময়, এবং এমন একটা সময় মোকাবেলার জন্যে ঝোলা হতে বের করেছে নিজেদের ধন সম্পদ।
শেখ হাসিনা নামের যে অযোগ্য ও ভয়ংকর শাসক বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসেছে তার অবসান এখন জরুরি। কিন্তু এ অবসান যদি আগের বারের মত লগি-বৈঠা, লাশ আর জেল-হাজতের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা হয় বিএনপি নামক পুরানো লুটেরাদের পায়ের নীচের মাটি চোরাবালির মত সড়ে যেতে বাধ্য। জনগণ এখন অনেকটাই সজাগ, যার প্রমাণ চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ আর কুমিল্লার নির্বাচনী রায়। তবে আশার কথা বিরোধী দলীয় নেত্রী দেশবাসীকে বার বার আশ্বস্ত করছেন নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই তারা সরকার বিরোধী আন্দোলন করে যাবে। ২/৩ টা হরতাল ও বিচ্ছিন্ন কিছু সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ছাড়া বিএনপি তার কথা রাখছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সামান্য হলেও এটাকে রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তন হিসাবে ধরে নিয়ে আমরা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা হলেও আশান্বিত হতে পারি। সময়ই প্রমাণ করবে আমার আশা কতটা প্রিম্যাচ্যুরড ছিল।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণে প্রতিপক্ষ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচীর বিরোধীতা করবে তা সহজেই অনুমেয়। তবে বিরোধীদলের রোডমার্চ নামক ঝমকানো কর্মসূচীর সমালোচনার জবাব দিতে একই কাজে বর্তমান ক্ষমতাসীন আর অতীতের বিরোধী দলটির নিজস্ব রেকর্ড জনগণের সামনে আনতে হবে। রেকর্ড লুকানোর মত যথেষ্ট মলমূত্র এখন পর্যন্ত ত্যাগ করতে সক্ষম হয়নি তারা। আগামী দুই বছরে এমন একটা সম্ভবনা সৃষ্টি হবে তার কোন আশা দিগন্ত রেখায় দেখা যাচ্ছে না। প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসে যাবে ১৯৯৩ সাল হতে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দলটির কর্মকান্ড। আসুন এক নজরে দেখা যাক এর একটা গড় চিত্রঃ
১৯৯৪ সালঃ
২৬ শে এপ্রিল - হরতাল
১০ই সেপ্টেম্বর - অবরোধ
১১, ১২ ও ১৩ই সেপ্টেম্বর - হরতাল
২৭শে সেপ্টম্বর - অবরোধ
৩০শে নভেম্বর - অবরোধ
৭ ও ৮ই ডিসেম্বর - হরতাল
২৪, ২৯শে ডিসেম্বর - অবরোধ
১৯৯৫ সালঃ
২, ৩ ও ৪ জানুয়ারী - হরতাল
১৯শে জানুয়ারী - অবরোধ
২৪ ও ২৫শে জানুয়ারী - হরতাল
১২, ১৩ই মার্চ - লাগাতার ৪৮ ঘন্টা হরতাল
২৮শে মার্চ ঢাকা অবরোধ
৯ই এপ্রিল - ৫ বিভাগে হরতাল
২ ও ৩রা সেপ্টেম্বর - লাগাতার ৩২ ঘন্টা হরতাল
৬ সেপ্টম্বর - সকাল সন্ধ্যা হরতাল
১৬, ১৭ ও ১৮ই সেপ্টেম্বর - লাগাতার ৭২ ঘন্টা হরতাল
৭ ও ৮ই অক্টোবর - ৫ বিভাগে লাগাতার ৩২ ঘন্টা হরতাল
১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯শে অক্টোবর - লাগাতার ৯৬ ঘন্টা হরতাল
৬ নভেম্বর - ঢাকা অবরোধ
১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৬ই নভেম্বর - প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
৯, ১০ ও ১১ই ডিসেম্বর - লাগাতার ৭২ ঘন্টা হরতাল
১৭ই ডিসেম্বর - সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
৩০শে ডিসেম্বর - দেশব্যাপী অবরোধ
১৯৯৬ সালঃ
৩ ও ৪ঠা জানুয়ারী - লাগাতার ৪৮ ঘন্টা হরতাল
৮ ও ৯ই জানুয়ারী - লাগাতার ৪৮ ঘন্টা হরতাল
১৭ই জানুয়ারী - সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
২৪শে জানুয়ারী - সিলেটে ১১ ঘন্টা হরতাল
২৭শে জানুয়ারী - খুলনায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
২৮শে জানুয়ারী - খুলনায় অর্ধ দিবস হরতাল
২৯শে জানুয়ারী - ঢাকায় সকাল সন্ধ্যা হরতাল
৩০শে জানুয়ারী - চট্টগ্রামে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
১লা ফেব্রুয়ারী - বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হরতাল
৩রা ফেব্রুয়ারী - অর্ধদিবস হরতাল
৭ ও ৮ই ফেব্রুয়ারী - ফেনীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
১০ই ফেব্রুয়ারী - রাজশাহীতে হরতাল
১১ই ফেব্রুয়ারী - সিরাজগঞ্জে হরতাল
১৩ই ফেব্রুয়ারী - দেশব্যাপী অবরোধ
১৪ ও ১৫ই ফেব্রুয়ারী - ৪৮ ঘন্টা লাগাতার হরতাল
২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭শে ফেব্রুয়ারী - লাগাতার অসহযোগ
৯ হতে ৩০শে মার্চ - লাগাতার ২২দিন অসহযোগ
সূত্রঃ মোহম্মদ সোহেল, একজন ছাত্র
একই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাফন করতে বর্তমান সরকার সময় নিয়েছে মাত্র কয়েক মিনিট। কারণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে নেত্রীর সম্ভাব্য জেল হাজত। বাংলায় একটা কথা আছে, মলমূত্র ত্যাগ করার সময় বেড়াল নাকি মাথা নীচু রাখে যাতে কেউ দেখতে না পায়। এমন একটা কাজ বেড়াল আদৌ করে কিনা জানা নেই, তবে শৌচ কর্মের পর তা ঝটপট লুকানোর চেস্টার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। নিজেদের বেড়ালের কাতারে নামিয়ে সমস্যাকে দেখতে চাইলে আওয়ামী লীগ তা করতে পারে, কিন্তু দেশের বাকি জনগণকে বেড়াল ভেবে থাকলে তারা ভুল করবে। ক্ষমতা ফিরে পেতে দলটি কতটা হিংস্র ও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তা বেড়ালের মত ঝটপট লুকানোর রাস্তা খোলা নেই। বিরোধী দলের সমসাময়িক কর্মসূচীর সমালোচনা করতে চাইলে আওয়ামী লীগকে নতুন কিছু নিয়ে জাতির সামনে হাজির হতে হবে। এক ছাত্রলীগের ডিজিটাল পাপই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার কাফনে দাফন করার জন্যে যথেষ্ট। সরকার পতনের জন্যে এ মুহূর্তে রোডমার্চের মত বিলাসবহুল ও ভোগান্তির কর্মসূচী প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। এ ধরণের কর্মসূচী কেবল সরকারের পক্ষেই কাজ করবে।