সকালটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হল ছ্যারছ্যারের কাছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি তার। প্রতিরাতের মত দুঃস্বপ্ন আজও পিছু ছাড়েনি। মধ্যরাত হতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে কেবল। ফজরের নামাজেও যাওয়া হয়নি আজ। অন্ধকারকে এমনিতেই ভয় পায় ছ্যারছ্যার, তার উপর যোগ হয়েছে অবিশ্বাস্য রকম কুয়াশা। শীতকালটা বলতে গেলে ঘরে বসে কাটাতে হচ্ছে তাকে। কোথায় যেন থমকে গেছে তার জীবন। গেল একটা বছর এক রাতের জন্যেও ভাল করে ঘুমাতে পারেনি। চোখ বন্ধ করলে সামনে এসে দাড়ায় চেনা একটা মুখ। রক্তমাংস হীন কঙ্কালের মত অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, কি যেন জিজ্ঞেস করতে চায়। প্রশ্নটা শোনার আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। দরদর করে ঘামতে থাকে। ধর ফর করে উঠে বসে বিছানার উপর। রাতের পর রাত ঘটে যাওয়া ঘটনার আজও ব্যতিক্রম হলনা। কিন্তু তারপরও সকালটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হল তার কাছে। প্রতিদিনের মত কুয়াশার হিস হিস শব্দটাও আজ তীব্র অনুভূত হলনা। সূর্যটাও মনে হল সকাল সকাল বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। দরজা খুলে শীতের সকালটা দেখার ইচ্ছা আজ আর চেপে রাখতে পারল না। বেরিয়ে এলো নিঃশব্দে।
সাপের মত হেলে দুলে এদিক ওদিক করছে সকালের কুয়াশা। দশ হাত দুরের জুমাঘরটাও দেখতে অসুবিধা হল ছ্যারছ্যারের। উচু মিনারটাকে দেখাচ্ছে অনেকটা দৈত্যের মত। প্রতিদিনের মত আজ আর ভয় পেলো না সে। ভাল কিছু ঘটতে যাচ্ছে আজ, বাতাসে তার গন্ধ পেল। কুয়াশা ভেদ করে কারও হাঁটাচলার আওয়াজ পেয়ে সজাগ হয়ে উঠল সে। সক্রিয় হয়ে গেল তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। পকেটে হাত দিয়ে পিস্তলের উপস্থিতিটা নতুন করে পরখ করে নিল। বিদ্যুৎ গতিতে পিছু ফিরল এবং পিস্তল উচিয়ে খোঁজ করল অদেখা শত্রুর।
’ভয় পাইয়েন না মামা, আমি চেঙ্গিস দফাদার, আফনের ড্রাইভার কাম বডিগাট’।
চেঙ্গিসকে দেখে অবাক হলনা ছ্যারছ্যার। গেল একটা বছর ছায়ার মত লেগে আছে তার পেছনে। যেখানেই যায় তার যাওয়াও বাধ্যতামূলক। এমনটাই নাকি ওপরমহলের নির্দেশ। বাংলাদেশি আসল ন্যাশনালিস্ট পার্টি ছেড়ে আমজনতা লীগে যোগ দেয়ার পর হতেই এসবের শুরু। গুড়া কৃমির মত বংশবিস্তার করেছে তার শত্রু। এমনকি তালাক দেয়া স্ত্রীদের কেউ কেউ নাম লেখাচ্ছে শত্রু শিবিরে। এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ছ্যারছ্যারের। তালাক দিলেও মাসোহারা দিচ্ছে চার স্ত্রীর সবাইকে। অনিয়মিত শারীরিক মিলনও বাদ যাচ্ছে না মেনু হতে। ঘরের তিন বিবির এ নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। তবু কেন শত্রু ক্যাম্পে নাম লেখাতে হবে এর কোন কুল কিনারা করতে ব্যর্থ হল ছ্যারছ্যারের মগজ।
’চ্যাঙ্গিস, তুই ঘরে যা। আইজ একলা ঘুরতে মুন চাইতাছে। আমার কিছু হইব না। যা ঘরে গিয়া নাস্তা খা’। চেঙ্গিসেরও অন্য চাহিদা মেটানোর সময় ছিল এটা। তাই সানন্দে, অনেকটা ভুতুরে কায়দায় মিলিয়ে গেল কুয়াশার ঘন চাদরে। চেঙ্গিসের বিদায়ের সাথে সাথে চারদিকটা নতুন করে দেখে নিল ছ্যারছ্যার। আকাশের দিকে তাকাল এবং বুক ভরে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল। ছাগলনাইয়া তার পাচ আঙ্গুলের মত, অথচ একটা বছর অনেকটা গর্তের ভেতর কাটাতে হয়েছে তাকে। রাজনীতির পাশাপাশি পাবলিক ফাংশনও বন্ধ। সাত পাচ মিলিয়ে এমনটা হওয়ার কোন কারণ ছিলনা। অনেক আশা নিয়ে যোগ দিয়েছিল আমজনতা লীগে।
তত্ত্ববধায়ক আমলের শুরুতে ছ্যারছ্যার বুঝে গিয়েছিল আসল ন্যাশনালিষ্ট পার্টির দিন শেষ। মাল কামানোর দৌড়ে টিকে থাকতে হলে তাকে দল বদলাতে হবে, এবং তা যথা সম্ভব দ্রুত। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্বান্ত নিতে আগে অনেকবার দেরি করেছে। তার ফলও পেয়েছে হাতেনাতে। তাই এ যাত্রায় সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মনস্থির করল। বন্ধু ইলশা হাজি তাকে রাস্তা দেখাল। ফেঁপে উঠা ব্যাংক ব্যালেন্সের মাপকাঠিতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদটা খুব ছোট মনে হয়েছিল তার কাছে। তাই চোখ উপরের দিকে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিল। হাজির ভাষায় পুরানো এমপি তত্ত্বাবধায়কের দালালি করেছে বিধায় নমিনেশনের বাজার এবার খোলা। চাইলে যে কেউ সওদা করতে পারবে। পৌষ মাসের কোন এক সোনাঝরা সকালে গায়ে আতর, মুখে তিব্বত স্নো আর সাথে সাত নম্বর বিবি নিয়ে রওয়ানা দিল ঢাকার দিকে।
নমিনেশন বোর্ডের মুখোমুখি হতে পাক্কা একমাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল ছ্যারছ্যারকে। দিনটা ছিল শুক্রবার। রোজা রাখতে বাধ্য করেছিল বিবি খামুসি বেগম। মিরপুর মাজারেও মানত করেছিল। গুলশানের গেস্ট হাউজ হতে ধানমন্ডি নমিনেশন বোর্ডে পৌঁছতে পাক্কা দুই ঘন্টা লেগে গেল তাদের। নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘন্টা দেরি হওয়ায় তেলে বেগুনে ভাজি হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন নেত্রী। হাজির হতেই তাৎক্ষণিক ভাবে ফুটন্ত কড়াইয়ে নামিয়ে দিল ছ্যারছ্যারকে। মৌখিক সালামের পাশাপাশি পা ছুয়ে সালাম দেয়ার চেষ্টা করতে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল তাকে।
’অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ মিয়া। আপনে তামাম দুনিয়ারে বোকা বানাইবার পারেন, মাগর আমারে পারবেন না। আমি এ লাইনের ডক্টর’। নেত্রীর কঠিন ভাষায় সজাগ হয়ে গেল ছ্যারছ্যার। নমিনেশন বোর্ডে যাদের আশা করছিল তাদের কাউকে না দেখে একটু হতাশ হল। কথা ছিল ফেনীর আয়নাল হাজারীও থাকবে এবং সমর্থন জানাবে তার প্রার্থিতার। নেত্রী আর তার একমাত্র বোনকে দেখে প্রথম ধাক্কায় বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। ভাবলেশ হীন দুই বোনের চেহারার সবটা জুড়ে ছিল খাই খাই ভাব। এর প্রমান পেতেও ছ্যারছ্যারকে বেশিক্ষণ আপেক্ষা করতে হয়নি।
’মুখের কথায় চিড়া ভিজে না মিয়া, পানি লাগে, তরল পানি। তা কত দিতে পারবা খোলাসা কর। ইলশা হাজী ৫৫ লাখের অফার দিছে। এক পয়সা কম হলে দোকান বন্ধ।’ ৮৫ লাখে দফারফা হল শেষপর্যন্ত। সিদ্ধান্ত হল ৮০ লাখ যাবে বাবার নামে তৈরী মাজারে, আর বাকি ৫ লাখ দলীয় ফান্ডে। প্রথম অংকটা পরিশোধ যোগ্য কেবল নগদে, দ্বিতীয়টা চেক হলেও নাকি ক্ষতি নেই। সবকিছু ভালয় ভালয় শেষ হওয়ায় ফুরফুর মেজাজেই বের হল ইন্টারভিউ বোর্ড হতে। রাজ্যের উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষমান খামুসি বেগম খবরটা পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরল। অবশ্য কান্নাকাটি ও রোজা আনন্দে আর পানাহারে রূপ নিতে বেশিক্ষণ লাগল না। ছ্যারছ্যার আনন্দেও কমতি ছিলনা, কিন্তু একটা বাস্তবতা তার মনে খচখচ করতে থাকল, ইলিশা হাজী! হাজীর সমর্থন নিয়েই সে ঢাকায় এসেছিল, অথচ নেত্রী জানাল সওদার বাজারে সেও নাকি একজন সওদাগর। ব্যাপারটা তার কাছে ঘোলাটে মনে হল। খোলাসা করার তাৎক্ষণিক তাগাদা হতে ফোন করল ইলশাকে। কিন্তু ও প্রান্ত হতে কেউ উত্তর দিল না। ছ্যারছ্যারের মনে হল হাজির ব্যাটা ইচ্ছা করেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। অশ্লীল একটা গালি দিয়ে ছুড়ে ফেলল ফোনটা।
পরের ছয়টা মাস বহমান নদীর মত বয়ে গেল ছ্যারছ্যারের জীবন। ইলেকশন বাতাসে লন্ডভন্ড হয়ে গেল তামাম দুনিয়া। তিন বিবি আর ইলশাকে নিয়ে ছাগলনাইয়্যার আকাশ আর মাটি এক করে ফেলল সে। আমজনতা লীগের অনেকেই সমর্থন নিয়ে এগিয়ে গেল, অনেকে আবার গোপনে আসল ন্যাশনালিস্ট পার্টির দালালি করল। এ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করল না ছ্যারছ্যার। রাজনীতির সমীকরণ তার ভাল করেই জানা ছিল। এ-ও জানা ছিল এখানে স্থায়ী শত্রু-মিত্রের পাশাপাশি দিনরাত বলেও কিছু নেই। সবকিছু ছিল টাকার খেলা। তার চোখে টাকায় যেমন নমিনেশন কেনা যায় তেমনি দিনকে ও রাত বানানো যায় রাজনীতির সুক্ষ্ম চালে । ছ্যারছ্যার নিজকে সওদাগর ভাবতে ভালবাসে। তার চোখে সওদার ময়দানে অসম্ভব বলে কিছু নেই, মুল কথা দিন শেষে আসল পণ্যের মালিকানা। নির্বাচনে জিতে তেমনি এক পণ্যের মালিক বনে গেল রাতারাতি। ইলশার সাথে ভুল বুঝাবুঝিটা ইলেকশনের শুরুতে মিটিয়ে নিয়েছিল অনেকটা বাধ্য হয়ে। হাজীর সমর্থনটা তার জন্যে জরুরি ছিল বিভিন্ন কারণে। কোটি টাকা খরচের জন্যে বিশ্বস্ত দুটো হাতের প্রয়োজন ছিল, পাশাপাশি প্রয়োজন ছিল তিন বিবি ম্যানেজ করার কৌশলী একজন খেলোয়ড়। ইলশাকে চিনতে ভুল হয়নি তার। কারণ সে ছিল তেমনি একজন পাকা খেলোয়াড়। এবং ভুলটা করেছিল এখানেই।
ইলশা হাজী আর খামুসি বেগমের গোপন সম্পর্কটা তরতর করে বেড়ে উঠে অনেকটা ছ্যারছ্যারের নাকের ডগায়। নির্বাচন উপলক্ষে ছাগলনাইয়ার গ্রামে গঞ্জে ওরা একসাথে ঘুরে বেরিয়েছে বিনা বাধায়। গঞ্জের বাজারে স্বামী স্ত্রী পরিচয় দিয়ে মিলিত হতেও কোন অসুবিধা হয়নি। ছ্যারছ্যারের লোকেরাও তাদের চিনতে পারেনি খামুসী বেগমের চোখ মুখ বন্ধ করা বোরকার কারণে। ইঙ্গিতটা প্রথম পায় ড্রাইভার চেঙ্গিসের কাছ হতে। কিন্তু ইলেকশনের কারণে আমলে নেয়ার সময় পায়নি। তাছাড়া চেঙ্গিসকে সময় অসময়ে আসল ন্যাশনালিস্ট পার্টির দালাল বলে সন্দেহ হয়েছে তার। তাই বিশ্বাস অবিশ্বাসেরও একটা প্রশ্ন ছিল। এমপি হওয়ার কারণে ছাগালনাইয়্যা ছেড়ে ঢাকা আসাটা ছিল বাধ্যতামূলক। ৩ কোটি টাকার নির্বাচনী বিনিয়োগ লাভজনক করায় প্রয়োজন ছিল বিরামহীন পরিশ্রমের। কম বয়সী খামুসিকে ঢাকায় আনতে তাই মন সায় দেয়নি। কারণ সে জানত ঢাকায় তাকে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকতে হবে। তাছাড়া চেঙ্গিসের ইঙ্গিতটাও সে ভুলেনি। কিন্তু এ ব্যাপারে ইলশার যুক্তির কাছে হার মেনেছিল অন্য কারণে। মন্ত্রিত্ব চাইলে স্ত্রী-সংসার থাকা নাকি বাধ্যতামূলক।
দুপুরটা চাইলেও ভুলতে পারবেনা ছ্যারছ্যার। আসল ন্যাশনালিস্ট পার্টির ডাকে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলছিল সেদিন। সৌদি সাহায্য ফান্ডের জনৈক সৌদিকে ৫০ লাখ টাকা কমিট করেও দিতে পারছিল না ব্যাংক বন্ধ থাকার কারণে। বাসায় রাখা নগদের কথা মনে হতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সেদিকেই রওয়ানা দিল। ঝামেলায় এতটাই মগ্ন ছিল খামুসিকে ফোন করতে ভুলে গেল। রাস্তার হরেক ঝামেলা চুকিয়ে গুলশানের বাসায় যখন হাজির হল ততক্ষণে বেলা বেশ পরে গেছে। এমন অসময়ে শেষ কবে বাসায় এসেছিল মনে করতে পারল না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। খামুসি আর ইলশা এক অন্যকে জড়িয়ে গড়াগড়ি গাচ্ছে বৈঠকখানার মেঝেতে। দুজনেই উলঙ্গ। ভূমিকম্পটা কোথা হতে শুরু করবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না সে। নামে হাজী হলেও বয়সে তরুণ ইলশা আসলে হাজী নয়। হাজী নিয়ে হজ্ব ব্যবসা তার আদিম ব্যবসা। ব্যবসার খাতিরেই হাজী টাইটেল ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। কুচকুচে কালো চেহারা, পেটা শরীর আর মুখে ঘন কালো চাপ দাড়ির কারণে দেখতেও অনেকটা আজরাইলের মত দেখায়। বয়সের পার্থক্য থাকলেও তাকে বন্ধু হিসাবেই নিয়েছিল ছ্যারছ্যার। উপহার হিসাবে সামনের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদটাও বরাদ্দ রেখেছিল তার জন্যে। ইলশাও জানত ব্যাপারটা।
পয়েন্ট ফাইভ ক্যালিবারের পিস্তলটা পকেটে না থাকায় সে যাত্রায় বেচে গিয়েছিল ইলশা। তবে তা বেশিদিনের জন্যে নয়।
আইডিয়াটা মাথায় ঢুকে চেঙ্গিসের একটা মন্তব্যে। পরিকল্পনার বাকিটা ছিল তার নিজের। সমঝোতার কথা বলে সংসদ ভবনে নিয়ে আসার দায়িত্ব দিল চেঙ্গিসকে। সবকিছু জানার পর বিপদের খুটিনাটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল চেঙ্গিস। কিন্তু এ নিয়ে তর্কে গেলনা সে। তার দায়িত্ব ছিল মোহম্মদপুর বাসা হতে ভুলিয়ে ভালিয়ে ইলশাকে গাড়িতে উঠানো। এ কাজে তার কামিয়াভির আসল কাহিনী ছ্যারছ্যারের বোধহয় কোনদিনই জানা হবেনা। কথা মত দশটার আগেই ইলিশাকে হাজির করা হল সংসদ ভবনের আঙ্গিনায়। চেঙ্গিসের ফোন পেয়ে উপর হতে নেমে এলো ছ্যারছ্যার। পকেটে পয়েন্ট ফাইভ ক্যালিবারের লোডেড পিস্তল। নাটকের নাটবল্টু আগেই টাইট দেয়া ছিল, অপেক্ষা ছিল কেবল শেষ পর্বের। দরজা খুলে ইলশাকে দেখে বাঁকা একটা হাসি দিল ছ্যারছ্যার। চোখ মুখ ঠান্ডা হয়ে গেল ইলশার। ছ্যারছ্যারের এহেন চাউনির সাথে তার পরিচয় অনেকদিনের। কি ঘটতে যাচ্ছে তা অনুমান করতে সামান্যতম অসুবিধা হলনা। ভয়ে বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল তার চোখ মুখ। মুখ হতে মৃত্যুর কলেমাটা বেরিয়ে এল অনেকটা যন্ত্রের মত। শেষ করতে পারল না কলেমা তার আগেই গর্জে উঠল ছ্যারছ্যারের পিস্তল। ছাতি বরাবর ছোড়া গুলিটা এপাশ ভেদ করে ওপাশে চলে গেল। রক্তের প্লাবন এসে ধাক্কা দিল ছ্যারছ্যারের চোখে মুখে। পকেট হতে রুমাল বের করে মুছার চেষ্টা করল। কাজ হলনা তাতে। ব্যকসীটে লুকানো গামছার বস্তাটা বের করে দিল চেঙ্গিস। প্রয়োজনীয় পানিও তৈরী ছিল পরিকল্পনা মাফিক।
’মামা, হেয় দেহি মরে নাই। কৈ মাছের মতন খালি চিৎপটাং দিতাছে। কি করুম জলদি কন’।
চেঙ্গিসের কথায় খুব একটা অবাক হলনা ছ্যারছ্যার। শক্ত লোহা পেটানো শরীরে বুলেট ঠিকমত ঢুকবে কিনা এ নিয়ে তার আগেই সন্দেহ ছিল।
’যা, এইবার প্লান বি মত কাজ কর। খানকির পুতেরে পুরানো ঢাকার আলেয়া ক্লিনিকে নিয়া যা। কথা বলা আছে হেগো লগে, শেষ কামটা হেরাই কইরা দিব।’
কথাটা বলে শেষবারের মত ফিরে তাকাল ইলশার দিকে। রক্তের সমুদ্রে ডুবন্ত একটা লাশ দেখে ভয় পেয়ে গেল সে। মনে হল চোখ দুটো এখনো নড়ছে ইলশার, ঠোট দুটোও কাঁপছে। কি যেন একটা বলতে চাইছে সে। ’বান্দীর বাচ্চা, ৩ কুটি খরচা কইরা এম্পি হইছি। তুর মত দশটা ইলশা এক লগে ভাজি খাওনের খেমতা রাখি আমি। সইত্যডা সময় মত বুঝলে ইলশা হইয়া তুই আজ কৈ মাছের মত দাপাদাপি করতিনা।’ চোয়াল শক্ত করে লৌহ কঠিন ভাষায় উচ্চারণ করল শেষ কথা গুলো। ইলশার লাল রক্তাক্ত মুখের উপর নোংরা একদলা থু থু মেরে ঝড়ো বেগে বেরিয়ে গেল গাড়ি হতে।
ঘটনার দিন হতে বাকি বছরটা ছ্যারছ্যারকে কাটাতে হয়েছে অজানা আশংকায়। একদিকে জেলের ভয়, অন্যদিকে ক্ষমতা হারানোর শংকা। সবচেয়ে বেশি জ্বালাতন করেছে পেপারওয়ালারা। খামুসি বেগমকে ছাগলনাইয়া পাঠাতেও কষ্ট হয়েছে তার। স্ত্রীর মুখ বন্ধ রাখাটা ছিল খুবই জরুরি। এ কাজে সাহায্য করার মত কাউকে খুজে পায়নি এ যাত্রায়। অবশ্য সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এমনটা বললে মিথ্যা বলা হবে। দুর্দিনে সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল প্রশাসন। একে একে পাশে দাঁড়িয়েছিল থানা-পুলিশ, কোট-কাচারি, ব্যাবসায়ী-রাজনীতিবিদ। ফাগুন মাসের শেষ দিন দেশের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত ফোন করে নিশ্চয়তা দিয়েছিল। তাতেও নিশ্চিত হতে পারেনি ছ্যারছ্যার। হাতে কাগজ অথবা নেত্রীর ফোন না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়ার উপায় ছিলনা তার। দিনগুলো একে একে মাসে রূপান্তরিত হচ্ছিল, মাস গুলো বনে যাচ্ছিল বছর। অন্তহীন অপেক্ষার শেষ কোন বন্দরে তা খুঁজতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল ছ্যারছ্যার।
হাওয়া বদলের পালাটা শুরু হয় তিন মাস আগে। ইলশা হত্যার তদন্তের ভার তারই আপন ভায়রা ভাইয়ের হাতে ন্যস্ত হওয়ার পর বুঝে গিয়েছিল কি ঘটতে যাচ্ছে। এ ফাঁকে কথা বলে চেঙ্গিসকে রাজী করানো গেছে। নগদ হিসাবে তাকে দেয়া হবে এক কোটি, ঢাকায় একটা ফ্লাট, সাথে পরিবারের দায় দায়িত্ব। পিস্তল নিয়ে খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে ইলশা। আর এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার দায় দায়িত্বের সবটাই বর্তাবে চেঙ্গিসের ঘাড়ে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে নাম আসবে ছ্যারছ্যারের। চেঙ্গিস জেলে যাবে এবং খবর ওয়ালাদের মাথা ঠান্ডা হওয়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে অপরাধ মাপ করে দেবেন খোদ প্রেসিডেন্ট। অপরাধ ও শাস্তি পর্বের এমন ঝাঁঝালো কাহিনী অতি উঁচুমহলেও সত্যায়িত হয়েছে। এখন অপেক্ষা শুধু কিছু কাগজপত্রের।
একা একা ঘুরতে আজ আর ভাল লাগল না ছ্যারছ্যারের। মনটা কেমন আনচান করে উঠল। মেয়ে মানুষের অভাবটা হঠাৎ করেই মাথায় চাপল। ঝামেলার কারণে এ দিকটায় চোখ ফেরানো হয়নি অনেকদিন। ইলশার নিকেতনের ঢেরাটা আপনা হতেই তার কাছে চলে আসবে, মনে হতেই নেচে উঠল তার চোখ মুখ। ভীষন হালকা মনে হল নিজেকে। দুরে কোথাও পাখীর ডাক শুনতে পেল। কুয়াশার ফাক গলে সূর্যটাও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। সংসদে যাওয়া হয়নি অনেকদিন। নাওয়া খাওয়া সেরে ওদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে।
দরজায় পা রাখার আগেই বেজে উঠল ফোনটা। ভায়রা ভাইয়ের নাম্বারটা দেখে উড়ন্ত ঈগলের মত ঝাপিয়ে পরল তার উপর। এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
’দুলাভাই আছেন কিমুন? শৈলডা বালা নি? মনডা বালা নি? - কথার খৈ ফুটল ছ্যারছ্যারের মুখে।
’হ ছোট মিয়া বালা, তয় খবর তো আমার না, খবর আফনের’।
’কি কৈতে চান জলদি জলদি কন, মশকারা বালা লাগে না’
’আরে ছোট মিয়া রিপোর্ট যে দিয়া দিলাম হেই খবর কি আছে আফনের?’
’রিপোর্ট? কন কি? কবে? কার কাছে?
’ধীরে মিয়া, ধীরে। তিনডা মাস কষ্ট করলাম আমি, আর আফনে তা তিন মিনিটে গিলতে চান।’
’দুলাভাই, যা কওনের চালাইয়্যা কন, তর সইতাছে না আর’।
’বুঝি মিয়া বুঝি, আরে আমরাও এই পথা মাড়াইছি। খুন খারাবি আমরাও করছি। তাই খবরের মর্ম বুঝতে কষ্ট হয়না’
’তা কি আছে রিপোর্টে?’
’বিস্তারিত অহন কওন যাইব না, তয় জানাইয়া রাখি শুক্কুর বার বাদ জুমা আফনের ড্রাইভাররে নিতে আইব। ইলশা খুনের অপরাধে তার সামান্য কিছু বিচার হইব। আফনে হইলেন তার স্বাক্ষী।’
আকাশের দিকে তাকালো ছ্যারছ্যার। কুয়াশা ভেদ করে লুটিয়ে পরা সূর্যের রশ্মি গুলো লক্ষ কোটি মাইল বেগে ধেয়ে আসা উল্কা তরঙ্গের মত মনে হল তার কাছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ঐ দিকটায়। ঈশান কোনে ঝুলে থাকা কুয়াশার শেষ খন্ডটা দেখতে কেমন যেন ইলশার মুখটার মত দেখাল। দাঁত বের করে হো হো করে হেসে উঠল সে। ’আমি রাজনীতিবিদ, ৮৫ লাখ খরচ্চা কইরা নমিনেশন কিনছি, এ খালি এমপি হওয়ার নমিনেশন না, তোর মত বান্দীর পোলা গো খুন করারও নমিনেশন। আবার জন্ম নিলে ৫৫ লাখ না, দুই কুটি লইয়া ঢাকা আহিস’। ছ্যারছ্যারের অট্টহাসিতে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল সকালের নীরবতা।
গোলাম আযমের গ্রেফতার উপলক্ষে ঢাকাস্থ ছাগলনাইয়্যা সমিতির র্যালিতে যোগ দিতে হবে ছ্যারছ্যারকে। র্যালির প্রধান অতিথি সে। ইলশা পর্ব এখানেই সমাহিত করে পা বাড়াল বাইরের দুনিয়ায়।