ক্ষমতার রাজনীতিতে সরকার ও বিরোধীদলের ভূমিকা এবং এদের পারস্পরিক সম্পর্ক যে কোন দেশেই এখন প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত তিক্ত। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও গড় বিবেচনায় এর অন্যতম কারণ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। এ ধরণের মন্দা কেবল বাজারকেই প্রভাবিত করছে না, বরং প্রভাবিত করছে রাজনীতি সহ সামাজিক জীবন। অনিশ্চিত বাজার কাঠামো পৃথিবীর দেশে দেশে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা। নভেম্বরের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটছে তা এক কথায় অভাবনীয় ও নজিরবিহীন। পুঁজির অবাধ বিকাশ তত্ত্বের উপর দাঁড়ানো মুক্ত বাজার অর্থনীতিতেও কথা উঠছে সম্পদের অসম বন্টন ও সামাজিক বৈষম্য নিয়ে। কেবল মুখ আর কলমে থেমে না থেকে এসব কথা এখন বেরিয়ে পরছে দেশটার মাঠে ময়দানে। মানুষ অনন্যোপায় হয়ে রাস্তায় নামছে, প্রতিবাদের পাশাপাশি ঘেরাও অবরোধের মত চরম পথে হাঁটতেও বাধ্য হচ্ছে। পুঁজি বিকাশের সনাতনী ধারায় যারা পিছিয়ে পরছে তারা দায়ি করছে উঁচুতলার ভাগ্যবানদের, আর ভাগ্যবানরা আঙ্গুল দেখাচ্ছে নিজেদের যোগ্যতার দিকে। দরকষাকষির প্রেক্ষাপটে গোটা দেশ ৯৯% ও ১%’এর প্লাটফর্মে বিভক্ত হয়ে একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার অবস্থানে চলে গেছে। স্বভাবতই এর প্রভাব পরছে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ডেমোক্রেটরা বলছে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পূর্বসূরি জর্জ ওয়াকার বুশের ব্যায়বহুল দুটো অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ ও ধনীদের জন্যে ব্যাপক ট্যাক্স কমানোর ফসল হচ্ছে আজকের পতনোন্মুখ অর্থনীতি। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা বলছে প্রেসিডেন্ট ওবামার কথিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই মার্কিনিদের নিয়ে গেছে প্রায় ৯% বেকারত্বে। দেশটার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পণ্ডিতদের অনেকেই স্বীকার করেন মন্দা হতে বেরিয়ে আসতে পারলে রাজনৈতিক ঝড় অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসবে এবং হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠা রাজনৈতিক মঞ্চও জনশূন্য হয়ে পারবে। এ ধরণের অভিজ্ঞতা দেশটার জন্যে প্রথম নয়, তাই গড় মার্কিনিরা বিশেষ ততটা চিন্তিত নয় যতটা চিন্তিত দেশটার রাজনীতিবিদগণ।
বিশ্বমন্দার বলয় হতে বাংলাদেশের মত কাঠামো বিহীন রাজনীতি তথা এর আর্থ-সামাজিক জীবন নিরাপদ থাকবে এমনটা আশা করা হবে বোকামি। স্বভাবতই এর প্রতিফলন ঘটছে সমাজের সর্বস্তরে। রাজনীতিতে অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার যে ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্যে বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ি করা গেলেও এর কিছুটা হলেও দায় বর্তাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতার উপর। আমরা যারা অর্থনীতির মারপ্যাঁচ বুঝিনা তাদের হয়ত বুঝতে কষ্ট হবে দুরের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বস বাংলাদেশের মত রুচিহীন রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে বিশ্ব রাজনীতির ব্যারোমিটার যতই উত্তপ্ত হোক না কেন স্থানীয় রাজনীতির এমন কিছু উপাদান আছে যা এর তাপমাত্রাকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। এ বিবেচনায় পাল্লা দিয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে চলছে বর্তমান সরকার। রাজনীতি থাকলে রাজনৈতিক বিতর্কও থাকবে, থাকবে আলোচনা, সমালোচনা আর চরিত্র হননের হরেক রকম কৌশল। এ কেবল বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর সব দেশের সব কালের রাজনৈতিক সাংস্কৃতি। কিন্তু গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় গিয়ে খোদ গণতন্ত্রকে কবর দেয়ার মনমানসিকতা বাংলাদেশের জন্যে ইউনিক। ৭০ দশকে আইন করে এ চর্চাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল। এর খেসারত শুধু বিশেষ একটা দলকে দিতে হয়নি, বরং গোটা জাতিকে দিতে হয়েছে তার হাজার বছরের আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধ বলি দিয়ে। বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পাকিস্তানী সাংস্কৃতি পুনঃ জন্মের ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসাবে কাজ করেছিল আওয়ামী লীগের সে চেষ্টা। ৪০ বছর পর আজকের আওয়ামী লীগ কি সে চেষ্টাই করছে না? চারিত্রিক বিচারের কোন মানদণ্ডেই আওয়ামী লীগকে সক্রিয় অন্য দলগুলো হতে আলাদা করার উপায় নেই। সন্ত্রাস, লুটপাট আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার দৌড়ে আওয়ামী লীগ কোন বিবেচনায়ই প্রতিপক্ষের চেয়ে পিছিয়ে নেই, অনেকাংশে বরং দশ ক্রোশ এগিয়ে। এমনটাই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে কোন বিবেচনায় অথবা অধিকারে আওয়ামী লীগকে এককভাবে দেশ শাসনের লাইসেন্স দিতে হবে? যুদ্ধাপরাধের বিচার দেশ শাসনের ক্রাইটেরিয়া হতে পারেনা, এটা কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা নয় যার বিনিময়ে দেশের মালিকানা দাবি করা যাবে। অপরাধ করলে অপরাধীকে শাস্তি পেতে হয়, এটা নতুন কোন আবিস্কার নয়, বরং মানব সভ্যতার হাজার বছরের সাংস্কৃতি। ৪০ বছরেও কেন ’৭১এর খুনিদের বিচার করা যায়নি সে ব্যর্থতার দায়ভার রাজনীতির নয়, বরং বিচারব্যবস্থার। আমাদের বিচার ব্যবস্থা যেহেতু রাজনীতির ক্রীড়নক ও নিবেদিত সেবাদাস তাই এ ব্যর্থতার সবটুকু দায়িত্ব নিতে সেই রাজনীতিবিদ্দেরই।
বাস্তবতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে একটা সত্য মানতে হবে বর্তমান সরকার এমন একটা সত্য বাস্তবায়ন করতে চাইছে দেশে এক আওয়ামী লীগ ছাড়া দ্বিতীয় কোন দলের ক্ষমতার রাজনীতি করার বৈধতা নেই। সেনা ছাউনিতে জন্ম নেয়ার দোহাই দিয়ে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার অন্ধ আক্রোশকে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রীতিনীতির আওতায় আনা যাবেনা। উর্দির জরায়ুতে বিএনপি নামক দানবের জন্ম দিয়ে জিয়াউর রহমান তার মূল্য শোধ করেছেন নিজের জীবন দিয়ে। সে দিনের দানব আর আজকের বিএনপি এক নয়, আজকের বিএনপি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার (হোক তা রুগ্ন) অবিচ্ছেদ্য অংশ। আওয়ামী লীগের মত তাদেরও আছে কোটি কোটি সমর্থক (হোক তা জংলী)। বাংলাদেশের মাটিতে রাজনীতি করার অধিকার কাদের জন্যে সংরক্ষিত থাকবে তা নির্ধারণ করার মালিক একক আওয়ামী লীগ নয়, বরং দেশের পনের কোটি জনগণ। গায়ের জোর আর আইনের জোরে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ফলাফল কি হতে পারে অন্য কারও চাইতে আওয়ামী লীগের ভাল জানা থাকার কথা।
আক্রোশের রাজনীতি নতুন আক্রোশের জন্ম দেয়, অসুস্থ রাজনীতির এ এক নির্মম বাস্তবতা। ভবিষ্যৎ নির্মমতা হতে রেহাই পাওয়া নিশ্চিত না করে শেখ হাসিনা যদি আক্রোশ মেটানোর রাজনীতি অব্যাহত রাখেন এর ফলাফল বাঁকা দিকে মোড় নিতে বাধ্য। একই পথ মাড়িয়ে বর্তমানের বিএনপি যথাযত মূল্য দিয়েছিল ক্ষমতা হতে সড়ে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ পবিত্রতার সরোবর হতে উঠে আসা কোন পদ্মফুল নয় যা পত পত করে আজীবন ভাসতে থাকবে। সময়ের দাবি মেটাতে এ দেশের মানুষ অতীতে যেমন রাস্তায় নেমেছে সামনেও নামবে। হাতে রক্ত আর আঙিনায় লাশ রেখে ক্ষমতা পোক্ত করার অভ্যাস সেই পাকিস্তান আমল হতেই চলে আসছে। দলীয় চামচা দিয়ে প্রতিপক্ষের সভাস্থলে পালটা সভা ডাকা, শান্তি শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে ১৪৪ ধারা জারী, এসব বেদের মেয়ে জোৎস্না জাতীয় রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামী দেখতে দেখতে জাতির পিউবিক হেয়ার পর্যন্ত পেকে গেছে। পাকা সে চুলে রং লাগাতে চাইলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে নতুন কোন ব্রান্ড খুঁজতে হবে। গোদ্রেজের মত অতীতের তাবৎ ব্রান্ড এখন ব্যর্থ। ব্যর্থতার চুনকালি মুখে নিয়ে কেউ পরজগতে চলে গেছেন, কেউবা এরশাদের মত বেশ্যাবৃত্তিতে নেমেছেন। রাজনীতিতে টিকে থাকতে চাইলে সহাবস্থানের বাস্তবতা মানতে হবে, মানতে হবে গণতান্ত্রিক আচার আচারণ। বাবার নাম আর স্বামীর নাম ভাঙ্গিয়ে ১৭ কোটি মানুষের জীবনকে জিম্মি করার রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষ সচেতন হচ্ছে। হয়ত সময় নেবে, কিন্তু একদিন না একদিন তা ঘটবে, এ দেশের মানুষ ময়লা আবর্জনার মত উপড়ে ফেলবে রাজনীতি নামের এসব অরাজকতা, লুটপাট আর রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামী। এক হানিফ আর সুরঞ্জিত বাবুর মত মেঠো কামলা দিয়ে সে জোয়ার ঠেকানো সম্ভব হবেনা। আমরা মুখ খুলে উচ্চকণ্ঠে বলতে পারছিনা ঠিকই, কিন্তু অন্তরে লালন করছি, অনেকদিন ধরে লালন করছি সে স্বপ্ন।