‘এতই যদি মায়া মিনসারে আপনেগো ব্যাংকের প্রধান বানান না কেনে?’
এমন একটা বাংলা বাক্যের উপযুক্ত ইংরেজী অনুবাদ আছে কিনা তা ভাষাবিদরা ভাল বলতে পারবেন। থাকলেও আমাদের অর্ধ শিক্ষিতা প্রধানমন্ত্রীর তা জানা থাকার কথা নয়। জনবহুল একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি, তাই সাক্ষাৎ পেতে দুর দুরান্ত হতে মেহমানরা ছুটে আসেন। স্বভাবতই কথা বলতে হয়, এবং তা করতে হয় ইংরেজীতে। প্রতিপক্ষকে অশালীন ভাষায় ঘায়েল করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ত ভুলেই গেছেন সরকার পরিচালনায় মাঝে মধ্যে সুস্থতার প্রয়োজন হয়, ভাল ভাল কথা বলতে হয়। জিন ল্যামবার্ট অন্য একটা মহাদেশের পার্লামেন্টারিয়ান নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, বাংলাদেশের মত অসুস্থ রাজনীতির রোগাক্রান্ত পার্লামেন্টের প্রতিনিধি হিসাবে নন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট একটি স্বাধীন ও স্বার্বভৌম লেজিসলেটিভ প্রতিষ্ঠান, যারা কোন ভাবেই জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষক আর যুদ্ধাপরাধী বিচার বিষয়ক বিতর্কের সাথ সম্পৃক্ত নয়। পার্লামেন্টের কোন সদস্যই বঙ্গবন্ধু অথবা জিয়ার নামে পুজা দিতে বাধ্য নয়। উচ্চ আদালতের মোসাহেব বিচারকরাও এদের নামে সমন জারি করার অধিকার রাখেন না। এরা স্বাধীন। এদের পছন্দ অপছন্দও স্বাধীন, যা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার বাংলাদেশিদের এখতিয়ারের বাইরে। ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ গুলোর সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সবাই কেন ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে পছন্দ করে তার জবাব শুধু প্রধানমন্ত্রী কেন, ১৫ কোটি মানুষের কারও কাছেই দিতে বাধ্য নয়। সাক্ষাৎ পর্বে নিশ্চয় এসেছিল ইউনুস প্রসঙ্গ। আর তাতেই বোধহয় ঘা লাগে প্রধানমন্ত্রীর অহমিকায়। জন গুরুত্বপূর্ণ যে কোন বিষয়ে ব্যঙ্গ করা দেশীয় রাজনীতির পরীক্ষিত সাংস্কৃতি, হোক তা সাংবাদিক দম্পত্তি খুনের মত নির্মম ঘটনা। রাজনীতির ভুতুরে শত্রু ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে ব্যঙ্গ করার সুযোগ এ যাত্রায়ও তিনি ছাড়লেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের মত একটা স্থানীয় ব্যাংকের প্রধান হতে অপসারণের জন্যে তিনি নোবেল বিজয়ীর নামে লুটপাটের অভিযোগ এনেছেন, বয়সের অভিযোগ দলীয় বিচারক দিয়ে সত্যায়িত করে বাস্তবায়ন করেছেন। একই ইউনুসকে বিশ্ব ব্যাংকের মত বিশাল এক ব্যাংকের প্রধান বানানোর গরু মেরে জুতা দান প্রস্তাব ইউরোপীয়দের বুঝতে কষ্ট হলেও দেশীয় আমজনতার জন্যে তা ছিল নিতান্তই ডালভাত। এসব অসুস্থ কথাবার্তার অপর নাম বাংলাদেশি রাজনীতি।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক তিক্ততার চরম পর্যায়ে। মন্ত্রী আবুল হোসেনের দুর্নীতি প্রমানের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে প্রকারান্তে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংককেই আসামী কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছেন। ইতিমধ্যে দুদকের গোলাম হোসেন মন্ত্রীকে ফেরেশতার সার্টিফিকেট দিয়ে সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। আওয়ামী-বিশ্বব্যাংক দ্বন্দ্বের ব্যাক ড্রপে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ভূমিকায় এসেছেন নতুন বিধাতা, মালয়েশিয়া। দুবাই হতে টাকা এনে বিশ্ব ব্যাংকের তুলনায় ছয় গুন বেশি সুদে পদ্মা সেতু নির্মানে রাজী হয়েছে মহাথীর মোহম্মদের দেশ। তাই সরকারের কণ্ঠে অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। আবুল মন্ত্রীর সাথে শেখ পরিবারের অপর সদস্যা শেখ রেহানার সম্পর্ক অনেক দিনের। একটা সময় ছিল যখন অর্থাভাবে রেহানার স্বামীর মাথায় অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছিল না। এমন দুর্দিনে নগদ নিয়ে এগিয়ে নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন আজকের আবুল মন্ত্রী। সেদিনের সে সহায়তার প্রতিদানই এই মন্ত্রিত্ব। প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন শেখ রেহানার অনুমতি ব্যতীত আবুল হোসেনকে মন্ত্রীসভা হতে বিদায় করা সম্ভব হবেনা। এ বিবেচনায় বিশ্বব্যাংক কেন, খোদ সৃষ্টিকর্তাও যদি আবুল হোসেনের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন গোলাম হোসেনদের চোখে তা হবে অসত্য। বিশ্বব্যাংকের মত একই খেলা মালয়েশিয়ার সাথে খেলতে গেলে অতিরিক্ত যে সম্ভাবনাটা জীবন্ত থাকবে তা হল দেশটায় কর্মরত হাজার হাজার স্বদেশির ভাগ্য। দেখার বিষয় সরকারের চোর-পুলিশ খেলা পদ্মা সেতুর ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায়।
খবরে প্রকাশ, সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে ঢাকার বাইরে গেছেন আমাদের সরকার প্রধান। প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত তিন ভাইয়ের নামে তিনটা সেতু নির্মান করবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এ জন্যে আয়োজন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় উৎসবের। একই সাথে ঢাকায়ও শুরু হয়েছে অন্য একরকম উৎসব, ন্যাশনাল ফুটবল লীগ। এখানেও প্রধানমন্ত্রীর তিন ভাইয়ের নামে তিনটি ক্লাব টাকা আর ক্ষমতার জোরে আলোড়ন তুলছে। কেবল সেতু আর ক্লাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই আপন জনদের অমর করা প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়দের নাম এখন বাংলাদেশের পথে প্রান্তে, আকাশে বাতাসে। ক্ষমতা আর টাকার জোরে চাইলে দেশের নামও পালটে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তবে এ পালটে দেয়া যে চীরস্থায়ী বন্দোবস্ত হবেনা তা বলাই বাহুল্য। চীর প্রতিদন্ধি বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এলে সন্দেহ নেই রাতারাতি বদলে যাবে তিন ভাইয়ের সেতু ও ক্লাব প্রকল্প। সে বিবেচনায় ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস এমনই একটা নাম যা অমর করতে সেতু আর ফুটবলের দরকার হবেনা। বাংলাদেশ এবং ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস এখন অবিচ্ছেদ্য, একে অপরের পরিপূরক স্বত্ত্বা। শেখ হাসিনার সস্তা ব্যঙ্গ এই বিশালতায় সামান্যতম চিড় ধরাতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়না।