৭০ দশকের শেষ দিকের একটা ঘটনা। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে (লেলিনগ্রাদ)লেখাপড়া করছি। থাকি ইউনিভার্সিটির ডর্মে। ডিসেম্বর মাস। শীতের তান্ডবে বিপর্যস্ত শহরের জীবন যাত্রা। তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রীর উপর-নীচে উঠানামা করছে। স্কুল কলেজ বন্ধ এবং ছাত্রদের বাইরে যাওয়া নিষেধ বৈরী আবহাওয়ার কারণে। বাস করার মত যাদের দ্বিতীয় ঠিকানা ছিলনা তারা বন্দী হয়ে গেল ডর্মের চার দেয়ালে। আমিও তাদের একজন। শহরের স্থায়ী বাসিন্দাদের মতে শেষবার এমন শীত পরেছিল ১৯৪১ সালে, যে বছর হিটলার বাহিনী এ শহরকে ৮০০ দিনের জন্যে ঘেরাও অভিযান শুরু করেছিল। গায়ে একাধিক কম্বল চাপিয়ে ভেজা মুরগীর মত ঝিমুচ্ছি আর অপেক্ষা করছি কবে শেষ হবে এ তান্ডব। সে রাতে ডর্মের পানি সরবরাহ বন্দ হয়ে যায় পাইপ ফেটে যাওয়ার কারণে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস দুদিন ধরেই আসা যাওয়া করছিল নিয়মিত বিরতিতে। মোমের আলোতে ব্রীজ খেলে সময় কাটাচ্ছিলাম আমরা কজন বাংলাদেশি।
রাত বোধকরি ১২টা হবে। প্রচন্ড চিৎকারে খানখান হয়ে গেল মধ্যরাতের নীরবতা। রিসিপশনে কারা যেন হৈচৈ করছে। পরি মরি করে ছুটে গেলাম ঘটনাস্থলে। ওখানে গিয়ে যা দেখলাম তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে একদল বিদেশি এসেছে ডর্মে থাকবে বলে, কিন্তু রিসেপশনিস্ট ওদের ঢুকতে দিচ্ছেনা। প্রতিবেশি সমাজতান্ত্রিক দেশ হতে প্রতিবছর ওরা আসে এবং সপ্তাহ দুয়েকের জন্যে আমাদের ডর্মে ঠাঁই নেয়। এ নিয়ে কখনোই কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এ যাত্রায় কি হল এবং রিসেপশনিস্ট কেন এমন ব্যবহার করছে বুঝা গেলনা। ভদ্রমহিলা পাগলা ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে আর অতিথিদের আঙ্গুল উচিয়ে শাসাচ্ছে। যাদের উদ্দেশ্যে এমনটা করছে ভাষা জ্ঞান না থাকায় তারা বুঝতে পারছেনা কেন এই হৈচৈ। শুধু হা হয়ে তাকিয়ে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কিচির মিচির করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। আমরা কাছে যেতে চিৎকারের মাত্রাটা দ্বিগুন করে আগুনে দৃষ্টিতে আমাদেরও শাসাতে শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ শোনার পর বুঝা গেল ভদ্রমহিলার রাগের কারণ। এবার যারা এসেছে তারা জার্মান। পূর্ব জার্মানীর ব্রান্ডেনবার্গ শহরের ভোকেশনাল স্কুলের ছাত্রছাত্রী ওরা। সেমিস্টার জুড়ে ভাল লেখাপড়ার পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হয়েছে এ সুযোগ। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রিসেপশনিস্টের স্বামী খুন হয়েছিল হিটলার বাহিনী হাতে। পোলিশ-বেলারুশ সীমান্তের ব্রেস্ট শহরে বাস করত ওরা। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ছিল স্কুল শিক্ষক। দুই সন্তান আর স্বামী নিয়ে অনন্ত সুখের স্বপ্ন দেখছিল সে। কিন্তু সব খান খান হয়ে যায় যেদিন হিটলার বাহিনী পা রাখে তাদের শহরে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে স্বামীকে, তাকেও ধরে নিয়ে যায় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ৬০ বছর বয়স্কা ভদ্রমহিলার এক কথা, কোন জার্মানকে তার আঙ্গিনায় ঢুকতে হলে তার লাশ ডিঙ্গাতে হবে। ৬ ফুট উচা আর ১৫০ কিলো ওজনের এই মহিলার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল ছাত্র-ছাত্রী নয় বরং হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর সাথে সম্মুখ লড়াইয়ে নেমেছে সে। শীতের ভয়াবহতা উপেক্ষা করে সে রাতে পুলিশ আসতে বাধ্য হয়েছিল। সপ্তাহ দুয়েকের ভেতর শীতের তীব্রতা কমে এলো এবং আমরাও ফিরে গেলাম আমাদের ক্লাসরুমে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও চুপচাপ ও ভদ্রগোছের ঐ মহিলাকে আর কোনদিন দেখা যায়নি রিসেপশন টেবিলে।
জার্মান এবং তাদের সহযোগী বাহিনীর হাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬ কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, যার ভেতর খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নেরই ছিল আড়াই কোটি। বর্বর হিটলার বাহিনীর পরাজয়, পরবর্তীতে মিত্র বাহিনী কর্তৃক দুই জার্মানি সৃষ্টি এবং ঠান্ডা লড়াই শেষে আবার একত্রিত হওয়া জার্মানি, কোন কিছুই স্থায়ী বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি আন্ত ইউরোপিয় সম্পর্কে। বরং অর্থনৈতিক বাস্তবতা মহাদেশকে আরও কাছে এনেছে এবং অভিন্ন মুদ্রা ও পার্লামেন্টের মত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিতে বাধ্য করেছে। তাই বলে পূর্ব ইউরোপের মানুষ স্বজন হারানোর ব্যথা এক অর্থনীতির বেড়াজালে সমাহিত করেছে এমনটা ভেবে থাকলে ভুল ভাবা হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কান্না এখনও রাশিয়ার ঘরে ঘরে। চাকরি উপলক্ষে আমাকে প্রায়ই নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন শহরে যেতে হয়। লস আলামস তেমনি একটা শহর। পাহাড়ে কোল ঘেষে দাড়িয়ে থাকা ছোট্ট এ শহরকে আমেরিকার আর দশটা শহর হতে আলাদা করার কোন কারণ নেই। গেল সপ্তাহে সে শহরেই দেখা হল একজন জাপানির সাথে। এসেছে পাশের শহর টাওসে স্কী করতে। লস আলামসের মত অখ্যাত শহরে জাপানিরা কেন আসে তার সহজ উত্তর ট্যুরিজম হলেও তার আসল কারণ জানতে চাইলে আমদের আবারও ফিরে যেতে হবে ১৯৩৯ হতে ১৯৪৫ সালে। হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে ফেলা আনবিক বোমার জন্ম নিয়েছিল এই লস আলাসমে। শহরের গবেষণাগার এখনও জীবিত এবং ওপেনহাইমারের মত শত শত বিজ্ঞানী এখনও কাজ করে যাচ্ছে নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিস্কারের লক্ষ্যে। মার্কিনীদের হিরোশিমা নাগাসাকি তান্ডব জাপান-আমেরিকা সম্পর্কে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করতে পারেনি একই অর্থনীতির কারণে। মানব সভ্যতার বিবর্তনের সাথে যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস উৎ প্রেত ভাবে জড়িত। গায়ের জোর আর কলমের জোরে এ সত্য চাপা দেয়ার অবকাশ নেই। হিরোশিমা-নাগাসাকি নিয়ে জাপানীদের রাগ, ক্ষোভ আর দুঃখ অর্থনীতির কোন সূত্র দিয়েই উপশম করার উপায় নেই। এ ক্ষত চিরস্থায়ী। পৃথিবীর বুকে যতদিন একজন জাপানি বেচে থাকবে অন্তরের অন্তস্থলে সে লালন করবে সে রাগ, সে ঘৃণা। কিন্তু সে ঘৃণা চালিকা শক্তি হয়ে চেপে বসেনি ইউরোপীয় অথবা জাপানীদের জীবনে।
ইতিহাস নিয়ে গর্ব করার মত পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে। আমরাও তাদের একজন। অন্যায়, অবিচার, আর শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে যারা ইতিহাস লেখে তাদের গর্ব করার অনেক কিছু থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসও তেমনি এক ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে গর্ব থাকলেও এ ইতিহাস অন্যান্য জাতির মত আমাদের এক করতে পারেনি। বরং জাতিকে স্থায়ী বিভক্তির মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের দাঁড়প্রান্তে নিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে আমাদের ইতিহাস। পাকিস্তানী সেনা শাসক ও তাদের দোসর ২২ পরিবারের হাত হতে মুক্তি চাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটার দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য। ৪১ বছর পর স্বাধীনতার চাওয়া পাওয়াকে কাঠগড়ার দাড় করালে ক্ষমতা নিয়ে দুই পরিবারের অসুস্থ ও অস্বাস্থ্যকর লড়াই ছাড়া অন্য কোন প্রাপ্তি চোখে পরবে কি? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই শুধু কি নতুন করে ইতিহাস লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল? না-কি এ লড়াই ছিল বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অন্যায়, অবিচার, শোষণ আর নিপীড়নের বেড়াজাল ভেঙ্গে নতুন সমাজ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্যে?
১৯৭১ সাল হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতার কোন সাল নয় যা উদঘাটনে আর্কিওলজিক্যাল খননের দরকার হবে। আমার মত কোটি কোটি স্বদেশি এখনও সুস্থ মগজ ও শরীর নিয়ে এ দেশের মাটিতে পা রাখছে যারা ইতিহাসের অংশিদার হয়ে ৭১ সালকে কাছ হতে দেখেছে। জাতিকে মিথ্যা আর মনগড়া ইতিহাস গেলাতে চাইলে ইতিহাসবাজদের তাদের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ইতিহাস কোন অপরাধীও নয় যাকে আদালতের রায়ে শোধরাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্যেও ইতিহাস নয় যা লিখতে দা কুড়াল নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। ইতিহাস চলে তার নিজস্ব গতিতে, যার চালকের আসনে থাকে জনগণ ও তার হাজার বছরের সাংস্কৃতি। সমসাময়িক বাস্তবতায় আমাদের ইতিহাসকে সহজলভ্য পণ্য হিসাবে আখ্যায়িত করলে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবেনা। আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস এখন পণ্য যা হাটে মাঠে ঘাটে আদালতে বিক্রি হচ্ছে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে। বাংলাদেশের কোন গলিতে কে স্বাধীনতা ঘোষনা করবে আর কার কণ্ঠে শোনা যাবে এ ঘোষনা তার অপেক্ষায় থাকেনি এ দেশের মানুষ, মানুষ অস্ত্র ধরেছিল তাদের নিজেদের প্রয়োজনে, বাস্তবতার চাহিদায়। স্বাধীনতাকে যারা ওয়ান ম্যান শো হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান হয় তারা বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত অথবা ধোঁকাবাজির মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য গড়ার মিশনে নেমেছেন। ইউরোপিয়ানরা পারলে আমাদেরও উচিৎ ছিল পারা, বুকে আনবিক বোমার ক্ষত নিয়ে জাপানিরা এগিয়ে যেতে পারল আমাদেরও উচিৎ ছিল এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমরা পারিনি। আমাদের অক্ষমতার মূল কারণ বোধহয় আমাদের ইতিহাস প্রীতি, নেতা পুজার মধ্যযুগীয় সাংস্কৃতি।
ওরা লাখ লাখ মানুষ জমায়েতের করছে। কোটি মানুষের শহর ঢাকাকে অচল করে দিয়ে ওরা প্রদর্শন করছে নিজ নিজ পকেট ও বাহুর শক্তি। দাবি করছে গণজোয়ারের। আমরা যারা খেটে খাওয়া মাছে ভাতের বাঙালি তারও পতঙ্গের মত ঝাপ দিচ্ছি রাজনীতি নামের এসব নোংরামিতে। গজারিয়ার মেঘনা নদীতে ৩০০ যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে নৌযান,ভেসে উঠেছে ৩১টি লাশ, ঢাকায় ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছে ভাই, ময়মনসিংহে পিতা খুন করেছে পুত্রকে, দিনাজপুরে কিশোর ও নাটোরে পাওয়া গেছে নৈশপ্রহরীর লাশ, কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ১জন, চট্টগ্রামে মাজার লুটের অভিযোগ উঠেছে র্যাবের বিরুদ্ধে...এসব খবর মাত্র একদিনের, যা-ও আবার অসম্পুর্ণ। একবিংশ শতাব্দীর দোড়গোড়ায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে অর্থনৈতিক
মেরুকরণের অন্বেষণে, পাশাপাশি ১৫ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ ব্যস্ত তার ইতিহাস নিয়ে। কে জাতির পিতা, কে স্বাধীনতার ঘোষক, কার অঙ্গুলি হেলনে কে জেগে উঠেছিল, কার ষড়যন্ত্রে কার মৃত্যু হয়েছিল, কার দয়ায় কে বেচে গিয়েছিল, এসব নিয়েই ব্যস্ত নতুন সহস্রাব্দের বাংলাদেশ। মুক্তবাজার অর্থনীতির দুনিয়ায় সস্তা রাজনৈতিক ভাষন এখন অনেক দেশেই অচল। রাজনীতির ভাষা এখন অর্থনীতিমূখি। আর আমাদের রাজনৈতিক ভাষা হারা মানাচ্ছে অশ্লীল পর্ণের ভাষাকে। সবই হচ্ছে স্বাধীনতার নামে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তথা ইতিহাসের পটভূমিতে। পিতা না ঘোষক, পাকিস্তান না ভারত, মুক্তিযোদ্ধা না রাজাকার, জাতির গলে এসব ধ্বংসাত্মক বিতর্কের ফাঁস জড়িয়ে রাজনীতিবিদেরা অতি সন্তর্পণে গড়ে নিচ্ছেন নিজেদের ভাগ্য।
কতদিন চলবে এ ধাপ্পাবাজি? আর কতকাল প্রলম্বিত হবে এ ভণ্ডামি? জাতি হিসাবে আমরা কি কোনোদিনই অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যু, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, জিডিপি, এসব নিয়ে রাজনীতি করতে পারবো না? একজনকে পিতার আসনে, অন্য জনকে ঘোষকের চেয়ারে বসিয়ে আমাদের কি আজীবন তাদের ছেলে, মেয়ে, নাতি-পুতিদের বিদেশ বিভূঁইয়ে নিরাপদ জীবন গড়ার কারিগর হিসাবে কাজ করে যেতে হবে?