কাঁচা হাতের বাঁকা লেখা যাই লিখি না কেন ইদানিং বেশ কটা ব্লগ আমার লেখা ছাপাতে অনীহা প্রকাশ করছে। আভিযোগ, শব্দের ব্যবহার। প্রথম আলো ব্লগের মত ব্লগ গুলো হয়ত তীর্যক শব্দ সম্বলিত রাজনৈতিক লেখা ছাপিয়ে সরকারী রোষানলে পরতে চাচ্ছে না। তাদের আসরে আমাকে ঢুকতে দিতে এ জন্যেই হয়ত অনীহা। অন্যের ব্লগ আমার পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, কার লেখা ছাপবে আর কার লেখা এড়িয়ে চলবে তা একান্তই ব্লগ মালিকদের ব্যাপার। এ নিয়ে অভিযোগ করার মত তেমন কিছু নেই। ইদানিং কারও দিকে সরাসরি আঙুল না তুলে ছ্যারছ্যার আলী নামের কাল্পনিক একটা চরিত্রের জন্ম দিয়ে তাকে সামনে আনার চেষ্টা করছি। বলার অপেক্ষা রাখেনা চরিত্রের সবটা জুড়ে থাকে বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি। আমরা যা মুখে বলি, কান দিয়ে শুনি আর চোখে দিয়ে পড়ি তা নিজের করে লিখতে পারব না এমনটা দাবি করা নিশ্চয় হিপোক্রেসি। রাজনীতিতে সক্রিয় একজন নির্বাচিত অথবা অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মুখের ভাষা কতটা ’শ্রুতিমধুর’ তা জানতে আশাকরি ব্লগ মালিকদের দ্বারস্থ হতে হবেনা। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক রাজনীতি আমাদের সবার রক্তে। আর যাদের নিয়ে লেখালেখি তাদের সাথে ওঠাবসা আমাদের প্রতিদিনের জীবন। ভাষা ব্যবহারের বিশেষ গুন দিয়ে ঈশ্বর ওনাদের তৈরী করছেন তার কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, স্বভাবতই আমরা ধরে নেব এসব জনপ্রতিনিধি আমাদেরই অংশ। অস্থির ও অনিশ্চিত সমাজের ভাষাও হয় ততোধিক অস্থির, বিশেষ করে এ ভাষা যদি হয় ভাগ্য পরিবর্তনের পরিপূরক। ভাড়া বেশি চাওয়ার ’অপরাধে‘ একজন রিকশাওয়ালাকে ’খা-কির পুত, চু-নির পুত, ছিড়া ফেলামু, কাইট্টা ফেলামু, বহুল ব্যবহূত এ সব বাক্যালাপ ব্যবহারের সাথে এলোপাথাড়ি উত্তম-মধ্যম, অনেকটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মত ঠাঁই করে নিয়েছে আমাদের রক্তে। আমার নিজস্ব ভাষায়, এ রক্ত বিপ্লব। হিন্দি সিনেমার নায়ক অথবা ভিলেনদের ’কুত্তে, ম্যায় তেরে খুন পি লোঙ্গা’ জাতীয় হুমকি এখন আর শয়নকক্ষে টিভির ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং তা ছড়িয়ে পরছে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কথায় বলে, সব মাছে গু খায় বদনাম কেবল টাকি মাছের। রাজনীতিবিদদের অশ্লীল আর রুচিহীন ভাষা ব্যবহার করবেন আর আমার মত অখ্যাত ওয়াচডগ তাদের সমালোচনা করতে বঙ্কিমচন্দ্রের কথাকাব্য ব্যবহার করতে বাধ্য থাকবে, এমনটা দাবি করা কি হিপোক্রেসি নয়? প্রশ্নটা ব্লগ মালিকদের জন্যে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল খবরটার দিকে তাকিয়ে। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়ত কমলাপুর বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে বিবাদমান কোন পক্ষ এসব কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলছে। আজকাল বস্তি উচ্ছেদেও রাজনৈতিক পক্ষ থাকতে হয়। তা না হলে এ কাজের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। উচ্ছেদের হোতাদের পেছনে সরকারী ছায়া থাকা বাধ্যতামূলক। অনেকক্ষেত্রে সরকার নিজেই নামে এ ভূমিকায়। উচ্ছেদ পর্বের হৈ হোল্লর, চীৎকার আর কান্নাকাটির নোনাজলে মুখের ভাষা কোন নদীতে সাতার কাটে তার সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। মাঝে মধ্যে পত্রিকাওয়ালারা এসব নিয়ে খবর ছাপায় নিজেদের স্বার্থের তাগিদে। দৈনিক কালের কণ্ঠ ও প্রথম আলোর মধ্যে বিবাদমান কাইজ্জা এখন আর কর্পোরেট কাইজ্জায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা নোংরামির কাদাজলে সাতার কেটে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছে প্রিন্ট মিডিয়ায়। তাই প্রথম আলোয় খবরটা পড়ে ভাবলাম হয়ত কালের কণ্ঠের ভূমি দস্যুতা নিয়ে নতুন কোন ঘটনার সূত্রপাত করতে যাচ্ছে এ পত্রিকা। কিন্তু বস্তির মাতারির নাম ভূমিকায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম দেখে কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। অবিশ্বাসের এক নিশ্বাসে খবরটা পড়ে নিজেকে ধিক্কার দিলাম। ধিক্কার অবশ্য প্রথম আলো অথবা প্রধানমন্ত্রীকে নয়, বরং নিজেকে। এসব নীচ ও আবর্জনার কীটদের নিয়ে সময় নষ্ট করার ধিক্কার। ইতিমধ্যে ব্লগ দুনিয়ার সবাই হয়ত জেনে গেছেন পিতার ৯২তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন। যাদের জানার সৌভাগ্য হয়নি তাদের জন্যে বক্তব্যের সারমর্ম সংক্ষেপে তুলে ধরছিঃ
বিরোধীদলীয় নেত্রীর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর জন্ম শিলিগুড়ির চা-বাগানে। তাঁর নানা-নানির নাম কী? জিয়াউর রহমানের জন্ম ভারতে, পড়াশোনা করেছেন পাকিস্তানে। তাঁর বাবা-মার কবর পাকিস্তানে। দেশের প্রতি তাঁদের দরদ থাকবে কী করে? তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা। বিএনপির নেতা মেজর হাফিজের লেখা বইয়ে আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলারা বেগম জিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে এসেছিলেন। তিনি যাননি। তিনি ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মেসে ছিলেন।’
যেহেতু কথা গুলো জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বলা আমাদের ধরে নিত নিবে বক্তব্যের টার্গেটেড অডিয়েন্স ছিল দেশের কোটি কোটি শিশু। একই সভায় প্রধানমন্ত্রী নতুন করে আবিস্কার করলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্মস্থান, এবং প্রশ্ন তুলেলেন নানা-নানির নাম তথা পরিচয় নিয়ে। কথা গুলোর সহজ বাংলা করলে যা দাড়ায় তা হবে, খালেদা জিয়া পরিচয় বিহীন পরিবেশে শিলিগুড়ির চা-বাগানে জন্ম নিয়েছিলেন এবং যেহেতু নানা নানির সঠিক কোন পরিচয় নেই তাই তিনি জারজ। পরিচয় পর্বে আরও একধাপ এগিয়ে তিনি জিয়াউর রহামানকে আবিস্কার করেছেন ঘটনাচক্রের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ নতুন কোন আবিস্কার নয়, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিকে ঘায়েল করার কাজে দেশে দেশে এ সাংস্কৃতি চর্চা করা হচ্ছে। কিন্তু স্বীকৃত এ চর্চার নোংরা, কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল দিককে যদি আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করানো হয় আমাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন এ কাজে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং ১নং আসামী। শিলিগুড়ির চা বাগানে জন্ম নেয়া কোন অপরাধ নয়, তেমনি অপরাধ নয় ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া। অপরাধ ক্ষমতার ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করা। এ অপরাধের কালিমা নিয়ে খালেদা জিয়ার পুত্রদ্বয় আজ দেশছাড়া। প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার এসব মোক্ষম অস্ত্র এড়িয়ে জন্ম ইতিহাস আর একজন মুক্তিযুদ্ধা নিয়ে অশ্লীলতা কোনদিনই এদেশের মানুষ সহজ ভাবে নেবে না। প্রধানমন্ত্রীর হয়ত জানা নেই, বাস্তবতা হচ্ছে, দিন বদলে গেছে। নয় নয়টা চেকের মাধ্যমে একজন ব্যবসায়ীর পকেট কাটার অভিযোগ নিয়েও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছেন, জন্ম প্রেক্ষাপট দুরে থাক এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কি তিনি হজম করতে সক্ষম হবেন ? আর যদি মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্নই আসে তাহলে প্রধানমন্ত্রী দয়া করে বলবেন কি, যে পিতা আর ভাইদের নামে তিনি বাংলাদেশের আকাশ বাতাস নামকরণ করছেন তারা কোন ফ্রন্টে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল? ক’মাস আগে বগ্ল দুনিয়ার কেউ একজন শেখ মুজিবের জন্ম নিয়েও বানোয়াট খবর প্রকাশের মাধ্যমে চাঞ্চল্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা হালে পানি পায়নি, বরং এ ধরণের কুরুচিপূর্ণ তথ্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এ দুনিয়া। আশাকরি শেখ হাসিনার অশ্লীল, ইঙ্গিতপূর্ণ ও রাজনৈতিক দুনিয়ায় অগ্রহণযোগ্য এসব কথাবার্তাকেও সমানভাবে পদদলিত করবে ভার্চুয়াল দুনিয়া।
দেশের স্বার্থ রক্ষার কৌশলগত কারণে এক দেশ অন্য দেশের নির্বাচনে অর্থ খাটায়, মুক্তবাজার অর্থনীতির দুনিয়ায় এ বিনিয়োগ এখন স্বীকৃত বিনিয়োগ। বিগত মার্কিন কংগ্রেস নির্বাচনে ভারতীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বিশাল অংকের চাঁদা দিয়েছিল রিপাবলিকান দলের বিভিন্ন প্রার্থীকে। বেনিয়া ভারতীয়রা কোন উদ্দেশ্যে মার্কিন মুলুকে এ অর্থ বিনিয়োগ করেছিল তা জানতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার ছিলনা। মার্কিনিদের বিলিয়ন ডলার কল সেন্টার ব্যবসা এখন ভারতীয় অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ব্যবসা ধরে রাখতে রিপাবলিকান দলীয় ক্ষমতার কোন বিকল্প ছিলনা। প্রেসিডেন্ট ওবামার দল ডেমোক্রেটরা চাইছে বাইরে পাচার হওয়া সব ধরণের ব্যবসা বানিজ্য দেশে ফিরিয়ে আনতে। দেশটার কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৮% বেকারদের কাজে ফিরিয়ে আনতে কলসেন্টার ব্যবসা ফিরিয়ে আনাও ছিল জরুরি। মার্কিন জনগণও তা বুঝতে পারছে এবং এ জন্যে সুর মেলাচ্ছে ডেমোক্রেটদের সাথে। রিপাবলিকানদের পেছনে ভারতীয়রা টাকা খাটিয়েছে নিজেদের বানিজ্যিক স্বার্থে।
ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা নতুন কোন বৈরিতা নয়, আন্তর্জাতিক এ সমস্যার বয়স প্রায় ৬৫ বছর। পারমানবিক ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি দেশের বৈরিতা কেবল উপমহাদেশের জন্যে নয়, গোটা দুনিয়ার জন্যে হুমকি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র সহ উন্নত বিশ্বের প্রায় সবকটা দেশ কোন না কোন ভাবে এ বৈরিতার সাথে জড়িত। প্রতিবেশি দেশ হিসাবে আমরা জড়িত থাকবো না এমনটা ভাবা হবে বোকামি। পাকিস্তানিরা খালেদা জিয়ার মাধ্যমে এ দেশে বিনিয়োগ করবে ভারতীয়দের ক্ষতি করার কাজে, এখানে জটিলতাটা কোথায় বুঝতে আমার একটু অসুবিধা। একই অভিযোগ কি প্রধানমন্ত্রী নিজের বিরুদ্ধে নেই? লন্ডন হতে প্রকাশিত দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকা কি অভিযোগ করেনি ভারতীয়রা বস্তায় বস্তায় টাকা খাটিয়েছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর কাজে? না-কি প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় ভারতীয় টাকা পাকিস্তানি টাকার চাইতে স্বাদে, গন্ধে ভিন্ন আর হজমের জন্যে উপাদেয়? খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের অভিযোগের তুলনায় আমি বরং লন্ডনের ইকোনমিষ্টের অভিযোগকে প্রধান্য দেব, কারণ পাকিস্তানিদের টাকা দিয়ে কেনা যায়, আর লন্ডনিদের কিনতে টাকার পাশাপাশি দরকার হয় আরও অনেক কিছুর।
প্রধানমন্ত্রী পিতা, মাতা, ভাই সহ স্বজন হারানোর শোকে কাতর। হত্যাকারী হিসাবে তিনি অহরহই দায়ি করে থাকেন খালেদা জিয়ার স্বামী জেনারেল জিয়াকে। আর এ জন্যেই বোধহয় রাজনীতির সবটাতে জুড়ে থাকে প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার ভাষা। কোন মৃত্যুই মানুষের জীবনে স্থায়ী শোক সৃষ্টি করতে পারেনা, হোক তা মাতা-পিতার মত আপনজনদের। দুদিন আগে লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ। সন্তান হারিয়েছে তার পিতাকে, মা হারিয়েছে তার সন্তানকে। গোটা এলাকা জুড়ে চলছে শোকের মাতম। কিন্তু এ শোক স্থায়ী আসন করে তাড়িয়ে বেড়াবে না এলাকার স্বজন হারা মানুষদের। জীবনের প্রয়োজনে, বেচে থাকার তাগাদায় মানুষকে বেরিয়ে আসবে শোকের বলয় হতে এবং ফিরে যাবে স্বাভাবিক জীবনে। ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে শেখ হাসিনাকেও বেরিয়ে আসতে হবে শোকের মাতম হতে, বেরিয়ে আসতে হবে প্রতিশোধের রাজনীতি হতে এবং ফিরে যেতে হবে স্বাভাবিক জীবনে। শোকের উন্মাদনা দিয়ে ক্ষণিক আত্মতৃপ্তি লাভ করা গেলেও তা ভোটারদের মন জয় করার জন্যে যথেষ্ট হয়না, এটাই আজকের বাস্তবতা, গণতান্ত্রিক বাস্তবতা। এ যাত্রায় প্রধানমন্ত্রী যা বললেন তার ফল পেতে ওনাকে বোধহয় কিছুটা সময় ধরে অপেক্ষা করতে হবে।