গ্রীষ্মকালে দেখা পদ্মা নদীর মত শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেল ভরা পকেট। অনেকদিন এমন বিরামহীন রক্তপাত হয়নি ওয়ালস্ট্রিটে। ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত আগেও দিয়েছি, কিন্তু এমন চড়া মাশুল স্টক সুনামির ভরা যৌবনেও দিতে হয়নি। মন এমনিতেই ভাল ছিলনা। বন্ধু মোর্শেদের ফোনটা তাই মরার উপর খাড়ার ঘা'এর মত কাজ করল। কোম্পানীর কাজে ক্যারাবিয়ান দেশ বার্বাডোজে আছে সে। চোখে পরার মত ঘটনা ঘটলে একে অপরের সাথে শেয়ার করার অভ্যাসটা আমাদের পুরানো। হোক তা বাংলাদেশে অথবা মাদাগাস্কারের আন্তানানারিভোতে, খোলামেলা মত বিনিময়ে আমাদের কখনোই অসুবিধা হয়নি। এ যাত্রায় হাই হ্যালো বলার আগেই জিজ্ঞেস করে বসল সুরঞ্জিত বাবুর ঘটনার কথা। জানতে চাইল আমার প্রতিক্রিয়া। জবাবে বললাম প্রতিক্রিয়া দুরে থাক এ ব্যাপারে আমার কোন ক্রিয়াও নেই। একটু অবাক হল আমার ঠান্ডা জবাবে। আশা করছিল হয়ত উপাদেয় ইনগ্রেডিয়েন্টটা নিয়ে নতুন কোন খাবার পাকাতে বসে গেছি ইতিমধ্যে। বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে অনেক দিন ধরে হাউকাউ করছি, লেখালেখি করছি বিভিন্ন ব্লগে। কাজটা করতে গিয়ে বেশ কিছু শত্রু মিত্রেরও জন্ম দিয়েছি। দেশের শতকরা ১০০ ভাগ রাজনীতিবিদ চোর ও চরিত্রহীন, আমার এ বক্তব্যের বিরোধীতা করতে গিয়ে অনেককেই বলতে শুনেছি হাতে গোনা কয়েক জনের কারণে ঢালাও ভাবে সবাইকে চোর বলা অন্যায় ও অনৈতিক। থানা পুলিশের বেলায়ও নাকি একই যুক্তি প্রযোজ্য। এসব পান্ডিত্য আমাকে সহজে বশ করেনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে খুব কাছ হতে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে, তাই এ লাইনের দেবী হতে শুরু করে পূজারিকে পর্যন্ত গণচোর বলতে কখনোই দু’বার ভাবতে হয়নি। কথা প্রসঙ্গে সেটাই মনে করিয়ে দিলাম বন্ধু মোর্শেদকে। সুরঞ্জিত বাবু সদ্য জন্ম নেয়া নতুন চোর নন যার চুরি নিয়ে বিস্ময়ের সুনামিতে ভাসতে হবে। বাবু পুরানো চোর। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় সুনামগঞ্জের হাওর বাওর বিল দখল আর নিজের বৈমাত্রেয় ভাইদের সম্পত্তি দখলের কাজটা তিনি আগের টার্মেই সেরে নিয়েছিলেন। বাবুর পুরানো কাসুন্দির সাথে যারা পরিচিত নন তাদের অনুরোধ করব ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের তৎকালীন মালিক জনাব মইনুল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করতে। এ টার্মে তিনি নগদের সন্ধানে নামবেন এমনটা ছিল অনিবার্য। যারা তা আন্দাজ করতে পারেননি তাদের উচিৎ হবে নতুন করে দেশিয় রাজনীতির ধারাপাত চর্চা করা। চেকের মাধ্যমে দিন-দুপুরে চুরির সাহসী অপশনটি বাবুর দেবীই বিপদজনক করে ফেলেছেন ধরা পরার মাধ্যমে। তাই এ যাত্রায় রাতের আধার আর চটের বস্তা ব্যবহার আমাকে খুব অবাক করেনি। বন্ধুকে চ্যালেঞ্জ দিলাম, মন্ত্রিসভার প্রত্যেক মন্ত্রীর এপিএসের বাসায় যদি চটের বস্তা না পাওয়া যায় আমাকে প্লাষ্টিকে মুড়ে ডোবায় চুবাতে। ঠাট্টা করে বললাম, পাট গবেষণার সাফল্য নিয়ে দুবছর আগে প্রধানমন্ত্রীর লম্ফঝম্পের আসল কারণও ছিল রাতের আধারে সুরঞ্জিত বাবুদের অর্থ পরিবহনের নিরাপত্তা।
রুশ লেখক মাক্সিম গোর্কির ’ডানখো’ নামের গল্পটা পড়া আমাদের জন্যে ছিল বাধ্যতামূলক। গল্পের সবটা মনে আছে এমনটা নয়। চরিত্র গুলোও গুলিয়ে ফেলেছি সময়ের প্রবাহে। তবে সারাংশটা মনে আছে। সমাজের বঞ্চিত মানুষকে পরিবর্তনের কথা শোনায় ডানখো। মানুষও বিশ্বাস করে তার কথা। সময় গড়ায় কিন্তু কাঙ্খিত পরিবর্তন আর আসে না। হতাশা দানা বাধতে শুরু করে বিশ্বাসীদের মনে। আস্থায়ও ভাটা লাগে। হতাশা ক্ষোভে পরিণত হওয়ার আগে সুন্দর এক সকালে গ্রামের সবাইকে একত্রিত করে ডানখো এবং অনুরোধ করে তার সাথে অজানা পথ পাড়ি দেয়ার। রাজী হয় সবাই এবং রওয়ানা দেয় সে দেশে যেখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে সুখ আর শান্তি। দিনের পর দিন চলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরে সবাই। পাশাপাশি ফুরিয়ে আসে পানি আর খাদ্য। দুর্বল হয়ে আসে মনোবল। এক রাতে দলের মুরুব্বীরা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে যাওয়ার এবং ভুল পথে নিয়ে আসার জন্যে ডানখোকে হত্যা করার। ডানখোর কানে যায় সে খবর। অনাহারে, অর্ধাহারে দুর্বল ডানখো হঠাৎ করেই জ্বলে উঠে এবং বুক চিড়ে বের করে আনে নিজের হূৎপিণ্ড। সবাই অবাক হয়ে দেখে ডানখোর হূৎপিণ্ড আগুনের গোলার মত জ্বলছে এবং সে আলোয় চারদিকের ঘন অন্ধকার আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। এক হাতে হূৎপিণ্ডটা উচু করে দৌড়াতে শুরু করে ডানখো। তার পিছু নেয় সবাই। হঠাৎ করেই চোখে পরে সবুজ মাঠের বিস্মৃতি, কল কল শব্দে বয়ে যাওয়া নদী আর পাখির গানে ভরপুর ফল-ফুলের বাগান। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় সবার মাঝে। হঠাৎ করেই মাটিতে লুটিয়ে পরে ডানখো এবং ঢলে পরে মৃত্যু কোলে।
টাকার বস্তা সংক্রান্ত সুরঞ্জিত বাবুর নৈশাভিযান নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন। কেউ চাইছেন পদত্যাগ, কেউবা আবার গ্রেফতার ও বিচার। বন্ধু মোর্শেদ জানতে চাইল ক্ষমতা থাকলে ব্যক্তি ওয়াচডগ কি চাইত অথবা করত। চাওয়ার জানালায় বিদ্যুৎ চমকের মতই ঝলসে উঠল ডানখোর গল্পটা। দুটা মিনিট চুপ করে কল্পনা করলাম নিজের অক্ষম চাওয়ার প্যানোরমা। গুলিস্তানের ব্যস্ত মোড়। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে সুরঞ্জিত বাবুর শাস্তির স্বাক্ষী হতে। যে গাড়িতে করে টাকার বস্তা রাতের হাওয়া খাচ্ছিল সে গাড়িতেই আনা হল তাকে। দুহাত শক্ত করে রশি দিয়ে বাধা। ড্রাইভার আজম খান হেঁচকা টানে ফেলে দিল গাড়ি হতে। আমার পায়ের নীচে ভুলুণ্ঠিত হল রেলমন্ত্রীর শরীর। প্রতিশোধের লালসায় চক চক করে উঠল আমার চোখ। ডানখোর মত আমিও জ্বলে উঠলাম এবং বুকে পা রেখে এক টানে বের করে আনলাম বাবুর দুই বীচি। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে দেখল বিচিতে লাল রক্ত নেই, রাস্তার পিচের মত কেবল ঘন কালো বিটুমিন। এতই কালো যার প্রভাবে অন্ধকার হয়ে গেল ঢাকা শহর। দৌড়াতে শুরু করলাম সদরঘাটের দিকে। এক হাতে বীচি আর অন্য হাতে ৭৫ লাখ টাকার বস্তা নিয়ে বো বো করে দৗড়াচ্ছি আর সাথে দৌড়াচ্ছে হরেক রকম নেতা নেত্রীর কাফেলা। বুড়িগঙ্গার সামনে আসতে মুসা (আ)’র মত অলৌকিক ভাবে দুভাগ হয়ে গেল নদীর পানি। বীচি আর টাকার বস্তা মধ্য নদীতে ফেলে তীরে উঠে আসতে এক হয়ে গেল নদীর পানি এবং ক্ষুধার্ত রাক্ষসের মত গিলে নিল বীচি হীন সুরঞ্জিত বাবু আর হরেক রকম নেতা নেত্রীর কাফেলা। উপস্থিত দর্শকদের সবাই তালি দিল। আনন্দে নাচল এবং গাইল। মানুষ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করল অন্ধকার ভেদ করে আলো ফুটে উঠছে দিগন্ত রেখায়।
’উদ্ভট এসব চাওয়া পাওয়া বস্তায় ভরে চলাফেরা করিস, আর আজম খানদেরও ম্যানেজ করতে অভ্যাস করিস ‘ - কুৎসিত একটা গালি দিয়ে ফোনটা রেখে দিল বন্ধু মোর্শেদ। ভাবনাটা হঠাৎ করেই মাথায় ঢুকল,৭৫ লাখ টাকার ওজন কত? এত ওজনের বস্তা নিয়ে আদৌ কি সম্ভব গুলিস্তান হতে সদরঘাট পর্যন্ত দৌড়ানো?