সকাল হতে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রথমে গুড়ি গুড়ি, তারপর মুষলধারে। বেলা গড়ানোর সাথে মনে হল গোটা আকাশ যেন মাটিতে নেমে আসছে। এমন অঝোর বর্ষণ অনেকদিন দেখেনি এ অঞ্চলের মানুষ। কনকনে শীত আর কাঠফাটা গরমের পাল্টাপাল্টিতে বর্ষা নামের একটা ঋতু আছে তা চাপা পরে যায় ব্যারোমিটারের ওঠানামায়। অথচ আদিবাসীদের ক্যালেন্ডারে এমন একটা ঋতুর কথা ঠিকই লিপিবদ্ধ আছে। এ নিয়ে বেশ কটা পুয়েবলোতে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। শুনেছি সান আলদেফোনসো পুয়েবলোতে কবিতা পাঠের আয়োজন পর্যন্ত চলে। এসব শোনা কথা। নিজ চোখে দেখা হয়নি সময় আর আলসেমির কারণে। হেরাল্ড বিগে নামে আমার একজন আদিবাসী বন্ধু আছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও সর্বাঙ্গে তার পোখোয়াকোয়ে গোত্রের ছাপ। ইংরেজির পাশাপাশি গোত্রীয় ভাষায় সমান দখল। মাথার বেনী কম করে হলেও দেড় হাত এবং পোশাকের সবটা জুড়ে রেড ইন্ডিয়ানদের জয়জয়কার। পাশাপাশি সিটে বসলেও দুজনের চোখ ছিল দুদিকে। আমি দেখছিলাম বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসা সান্দিয়া পাহাড়ের চূড়া, আর সে তাকিয়ে ছিল পানির অভাবে তামা হয়ে যাওয়া খোলা মাঠের দিকে। কোচিতি পুয়েবলোর ট্রেইলটা পার হলেই চোখে পরে দৃশ্যটা, ঢালু পাহাড়ি রাস্তাটা বিপদজনক ভাবে নেমে গেছে নীচের দিকে। পাশে বড় একটা হ্রদ। পুয়েবলোর শেষ মাথায় খুব রিস্কি একটা বাঁক পার হতে হয়। এবং ভাল করে তাকালে এ মোড় হতেই দেখা যায় নয়নাভিরাম ছবিটা। মাইলের পর মাইল বিস্মৃত ঝকঝকে হাইওয়ে, আঁকাবাঁকা আর উঁচুনীচু। কোল ঘেষে দাড়িয়ে থাকা ঘন কালো সান্দিয়া পাহাড় আর সাপের মত দিগন্তরেখায় মিশে যাওয়া ট্রেইলটার শেষ মাথায় চোখে পরবে শ্রীহীন কোচিতি পুয়েবলো। এমন একটা পুয়েবলোতেই নাকি হ্যারল্ডের জন্ম। নিউ মেক্সিকোতে জন্মা নিলেও জীবনের বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হয়েছে প্রতিবেশি অঙ্গরাজ্য ওকলোহামায়। এবং এখানেই নাকি পরিচয় ৫৫ বছর ধরে বিবাহিত স্ত্রীর। বহুবার শুনেছি এ গল্প। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি একজন আদিবাসী আমেরিকানের দুঃখ-কষ্ট আর হাসি-কান্নার সাথে। আজ একটু বেশি চুপচাপ মনে হল হ্যারাল্ডকে। বাসে ঢুকে হায় হ্যালো বলতেও ভুলে গেল কেন জানি। হবে হয়ত বসন্তের অঝোর বর্ষন। বৃষ্টির এই এক দুর্বলতা, বোবা করে দেয় সবকিছু। প্রতিদিনের মত আজও মাইক্রোবাসটায় চড়ে বাড়ি ফিরছি। যাত্রী বলতে আমরা ৭ জন। সবাই চুপচাপ, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এমন একটা ঐশ্বরিক মুহূর্তে অনেকটা খ্যাক খ্যাক গলায় চীৎকার করে উঠল আমার ৪-জি ফোনটা।
ভূমিকম্প হয়েছে দেশে। রিখটার স্কেলে ৫.৬। এপিসেন্টার ভারতের আসামের কোথাও। ছোট ভাইয়ের কাছে খবরটা শুনে তলপেটে কি যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠল। তেতো হয়ে আসতে শুরু করল বাইরের সবকিছু। কল্পনায় অনেকবার দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি এ ছবি; বাংলাদেশের ভূমিকম্প। এপিসেন্টার সাভারের কাছাকাছি কোথাও। লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ঢাকা শহর। মুরগীর খোঁয়াড়ের মত বেড়ে উঠা উঁচু উঁচু দালান গুলো মিছিল করে শুয়ে আছে মাটিতে। ’২০১২’ ছবিটা প্রথমবার যখন দেখি মনে হয়েছে বিদেশে নয়, ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশ যেন উলটে যাচ্ছে। হিসাবটা দুঃস্বপ্নের মত মগজে হানা দেয়, কতজনের মৃত্যু হবে এর ফলে? ভাই-বোন আত্মীয় স্বজনদের কজন এড়াতে পারবে অবধারিত মৃত্যু? হ্যারল্ডের প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলাম, ’খুব কি খারাপ কিছু?’ কিছুটা হলেও সে জানে পৃথিবীর কোন অংশে আর কোন পরিবেশে আমার বাস। দেশিয় মিডিয়াতে ভূমিকম্প তেমন গুরুত্ব পায়নি বলেই ধরে নিতে হল খারাপ তেমন কিছু ঘটেনি। ’না তেমন কিছু নয়, হাল্কা ভূমিকম্প’। ’১৯৭১ সালে ৬.৬ ম্যাগনিট্যুডের ভূমিকম্পটা যখন আঘাত হানে আমি তখন সানফ্রানসিসকোতে। আঘাতটা হেনেছিল মূলত সান ফেরনানডোতে। কিন্তু গোটা ক্যালিফোর্নিয়া কেঁপে উঠেছিল সেদিন।’ কথার বারুদে আগুন দেয়ার মত জ্বলে উঠল হ্যারল্ডের মুখ। ভূমিকম্পের ইতিহাস নিয়ে লম্বা একটা লেকচার শুরু হতে যাচ্ছে ভাবতেই গুটিয়ে নিলাম নিজকে। বৃষ্টির ঝাপটায় গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছিল ড্রাইভার ম্যাথিউর। মুখের খিস্তি চাইলেও আটকে রাখতে পারছিল না সে। ভাগ্য ভাল আজ মেলিন্ডা অথবা বেরনাডেট কাজে আসেনি। ওরা থাকলে নির্ঘাত কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে বসত।
হঠাৎ করেই যাত্রীদের একজন বলে উঠল বের্ণালিউর ৫ মাইল দক্ষিনে দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমাদের বোধহয় বিকল্প রাস্তা ধরা উচিৎ। আজ শুক্রবার। কাজ শেষে ঘরে ফেরার তাগাদাটা আজ অন্যদিনের চাইতে একটু বেশি। ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটারের লিমিট। কিন্তু তা কেউ মানতে চাইছে না। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘন্টায় ১৪০-১৫০ কিমি ঝড়ো গতির গাড়ি গুলোকে মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ টাইফুন ছুটে যাচ্ছে যেন। নতুন একটা বাঁক পার হতেই ভেসে উঠল দৃশ্যটা; কচ্ছপ গতির হাজার হাজার গাড়ি, সাথে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সের বন্যা। আকাশে অনবরত টহল দিচ্ছে এয়ার এম্বুলেন্স। মনে হল বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমে গিন্নিকে ফোন করে আশ্বস্ত করে নিলাম, তারপর মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম লম্বা সময় অপেক্ষার। এ ফাঁকে বাংলা পত্রিকাগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং দৈনিক প্রথম আলোর একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল, ‘সড়কে মৃত্যুর মিছিল‘।
সিলেটের বালাগঞ্জে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে আট জনের মৃত্যু, গাইবান্ধায় ট্রাক চাপায় নিহত পাঁচ জন, ঢাকায় ভিন্ন দুটি ঘটনায় নিহত দুজন সাংবাদিক। সন্দেহ নেই এ তালিকা আরও লম্বা হবে যদি গ্রাম গঞ্জের অপ্রকাশিত মৃত্যু গুলো তালিকাভুক্ত করা হয়। এ সবের বোধহয় দরকার হবেনা। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট আজকাল মৃত্যুফাঁদ, এমনকি দেশের ভাগ্যবান মন্ত্রীদেরও আনা হয়েছে এর আওতায়। কদিন আগে খোদ নৌমন্ত্রী নিজে অর্জন করেছেন এ অভিজ্ঞতা। বেশ কবছর আগে আমার আপন ভাই ঢাকা আসার পথে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পরেছিল। তার মুখেই শুনেছি দুর্ঘটনা পরবর্তী নতুন দুর্ঘটনার কথা। স্থানীয় জনগণ কর্তৃক মৃত্যুমুখ যাত্রীদের লুটপাটের যে কাহিনী শুনেছি তা নিয়ে চাইলে হলিউডের ফিচার ফিল্ম বানানো যাবে, যা হূদয় কাড়বে কোটি কোটি দর্শকদের। ঢাকায় দেখলাম এ জাতীয় কিছু ঘটেনি। তবে যা ঘটেছে তাই বা কম কিসে! লাঠিসোটা নিয়ে প্রতিবাদী জনতা ভাংচুর করছে নির্বিচারে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন মহামারীর রূপ নিয়েছে তাতে গোপন কোন উপাখ্যান লুকিয়ে নেই, বরং এ খোলা অধ্যায়ের আদি অন্ত সবার জানা। স্বল্প সময়ে ভাগ্য পরিবর্তনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে গিয়ে সরকার, প্রশাসন আর মালিকদের যৌথ প্রযোজনার ফসল রাস্তার রক্তক্ষরণ। জ্যামিতিক হারে বাড়ন্ত জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে এ রক্ত যে সুনামিতে রূপ নেবে তা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দুর্ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট যান ও চালকদের পিটিয়ে আমরা যে ম্যাসেজ দিচ্ছি তা আমাদের অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এ অক্ষমতা সুনামি আটকানোর জন্যে যে যথেষ্ট নয় তা বোধহয় সবার জানা হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে পরিস্কার হয়ে গেল সামনের রাস্তা। রেডিওর খবরে জানা গেল দুর্ঘটনায় কেউ মারা যায়নি। যারা আহত হয়েছিল তাদের এয়ার এম্বুলেন্স পৌঁছে দিয়েছে নিকটস্থ হাসপাতালে। ট্রাফিক ঝামেলা কমার সাথে বৃষ্টির ঝামেলাও কমে এলো। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের হাল্কা রেখাটাও মুখ উচিয়ে জানিয়ে দিল বৃষ্টির এখানেই সমাপ্তি।
শহরের মুখেই সান্দিয়া ক্যাসিনো। ইন্ডিয়ান রিজারভেশনের এখানেই শেষ। একই দেশে দুই আইনের দুটি লোকালয়ের সন্ধিক্ষণে দাড়ালে এর পার্থক্যটা সহজে চোখে পরেনা। ধরা পরে আইন শৃংখলা নিয়ে খেলা করতে গেলে। পুয়েবলোর আছে নিজস্ব পুলিশ, নিজস্ব আইন। গ্যাম্বলিংয়ের ভাগ বটোয়ারা নিয়ে সমস্যা হওয়ায় এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে গুম করে দেয় গত বছর। এ নিয়ে পুয়েবলোতে ঝুলনো হয় রেড এলার্ট। হাউন্ড ডগ, চপার আর কম্যুনিটির শত শত স্বেচ্চাসেবক নিয়ে কার্পেট অনুসন্ধান চালানোর পর খুঁজে পাওয়া যায় নিখোঁজ বন্ধুর লাশ। আইন ও বিচার ব্যবস্থার লম্বা হাত অপরাধীকে ধরে আনে সুদূর হাওয়াই হতে এবং নিশ্চিত করে প্রাপ্য শাস্তি। বাংলা পত্রিকার একটায় দেখলাম সড়কের মত দেশের নদী গুলোতেও ভেসে বেড়াচ্ছে লাশের মিছিল। গুম হয়ে মৃত্যু বরন করা বেওয়ারিশ লাশের মিছিল।
ম্যাথিও, হেরালড ও আমি, আমরা একই মাইক্রোবাসে চড়ে প্রতিদিন কাজে যাই। চামড়ার রং ভিন্ন হলেও ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের রং সবার এক। মাথার উপরও একই আকাশ। অথচ জন্ম, মৃত্যু আর বেঁচে থাকার লড়াইটা কত অসম ভাবতে গেলে অস্থির লাগে, লাথি মেরে সবকিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করে।