ফোনটা পেলাম ঠিক যখন হাইওয়েতে ঢুকতে যাচ্ছি। অনেকদিনের পুরানো বন্ধু রাজু। তার সাথে কথা হয়নি অনেকদিন। কলার আইডিতে নামটা পড়ে দ্রুত বাড়ি ফেরার তাগাদা অনুভব করলাম। সাধারণত কিছু না ঘটলে সে ফোন করেনা। এ অঙ্গরাজ্যে একসাথে ড্রাইভিং ও হ্যান্ডসেটে কথা বলা নিষেধ, ধরা পরলে বড় ধরণের জরিমানা গোনার সম্ভাবনা থাকে। তাই ইচ্ছা থাকলেও কলটা রিসিভ করিনি। পাকিং লটে গাড়িটা কোন রকমে ঢুকিয়ে পড়িমরি করে ফোন ব্যাক করলাম। অপর প্রান্ত হতে বন্ধু যা জানাল তা শুনে হাসব না তার ’ব্যথায়’ ব্যথিত হয়ে সমবেদনা জানাবো বুঝতে পারলাম না। সমস্যাটা এরকমঃ রাজুর ছোট বাচ্চার বয়স এক বছর। গতরাতে সবাই মিলে বাংলা টিভি দেখছিল। খবর দেখার সময় বাচ্চাটা এমন কিছু দেখল যার ফলে ভয়ংকর ভাবে চীৎকার করে উঠল। হাজার চেষ্টা করেও তার কান্না নাকি থামানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত সাহায্যের জন্যে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যেতে হল। ডাক্তারের মতে বাচ্চা সুস্থ ও সবল এবং কেন এ ধরণের ম্যারাথন কান্না তার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি। তবে বন্ধু কিছুটা হলেও নাকি ধারণা করতে পেরেছিল। কিভাবে ডাক্তারকে গুছিয়ে বলবে সিদ্ধান্তে না আসতে পারার কারণে কিছু না বলেই ঘরে ফিরে আসে। সেই হতে মন খারাপ। সন্দেহটা আমার সাথে শেয়ার করার জন্যেই নাকি ফোন করেছিল। সন্দেহটা কি তা বলার জন্যে চেপে ধরতেই জানাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কথা। আপ-ক্লোজ ক্যাপশনে মন্ত্রীর চেহারা দেখা মাত্রই নাকি বাচ্চাটা চীৎকার করে উঠে। উত্তরে জানালাম আমার বাংলা চ্যানেল নেই, তাই মন্ত্রীর চেহারা কেমন এবং তা দেখে আদৌ ভীত হওয়ার কারণ আছে কিনা নিশ্চয়তা দিতে পারলাম না। বন্ধু বার বার অনুরোধ করল যেভাবেই হোক মন্ত্রীর চেহারাটা যেন এক বারের জন্যে হলেও দেখি। বাহ্যিক চেহারা মানুষের পরিচয় হতে পারেনা, কিন্তু মন্ত্রী সাহারা খাতুনের চেহারায় এমন কিছু আছে যা তার ভেতর বাহির দুটোরই যেন পরিচয় বহন করে। বিশেষ করে যেদিন হতে জেনেছি মন্ত্রীর নিজের হোটেলের বিরুদ্ধেই আছে দেহব্যবসার অভিযোগ। গেল ডিসেম্বর রাজধানীর ফার্মগেট ইম্পেরিয়াল গেস্টহাউস হতে ৩৯ জন পতিতাকে গ্রেফতার করা হয় অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে। উল্লেখ্য, মন্ত্রী পাড়ায় যাওয়ার আগে এই হোটেলেই একটা রুম নিয়ে মন্ত্রী নিজে থাকতেন। ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ যখন রাস্তায় যায় সভা-সমিতি আর মিটিং-মিছিলে আদম যোগান দিয়ে যারা মাঠ গরম রাখে মন্ত্রী সাহারা খাতুন তাদের অন্যতম। অনেকে ঠাট্টা করে বলে থাকেন মন্ত্রী আসলে নিজ হোটেলের পতিতাদেরই মিছিলে সাপ্লাই দিতেন এবং মন্ত্রিত্বের পথে বিছিয়ে ছিলেন ইম্পেরিয়াল ব্রান্ডের বিটুমিন ইমালশন।
সাহারা খাতুন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশেরও মন্ত্রী। এই সেই পুলিশ যাদের নিয়ে দেশের মিডিয়া এ মুহূর্তে মাতামাতির তুঙ্গে। কারণ? পুলিশ লিমন কাদিরদের ছেড়ে ইদানিং সাংবাদিকদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে তাই। এ নিয়ে সুশিল সমাজের সাথে সরকার নিজেও নাকি বিব্রত। বিশ্ব পুলিশ ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সৃষ্টি বাংলাদেশের পুলিশ সাংবাদিক পেটাচ্ছে এবং এ নিয়ে সর্বস্তরে সমালোচনা হচ্ছে^। এ ধরণের সমালোচনায় পুলিশ সমাজের প্রেস্টিজে হেরফের হবে এমনটা ভেবে যারা শংকিত হচ্ছেন তাদের জন্যে বলতে বাধ্য হচ্ছি, দেশীয় পুলিশদের চামড়া এত হাল্কা নয় যা সমালোচনা দিয়ে ভেদ করা যাবে। এ চামড়া ভেদ করতে মার্কিনিদের নিক্ষেপ করা হাজার পাউন্ডের তোরাবোরা গোলাও যথেষ্ট হবে কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশি পুলিশদের শতকরা ৯৯.৯৯৯৯ জন অসৎ, চোর, দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী, সত্যটা কি মিডিয়া কর্মীদের জানা ছিলনা? তাদের চোখের সামনেই তো লিমনকে ল্যাংড়া করা হল, কাদিরকে পিটিয়ে তক্তা বানানো হল। টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়ায় এমন কোন বিভাগ নেই, জেলা নেই, মহকুমা নেই, থানা নেই, শহর নেই, গ্রাম নেই যেখানে পুলিশ ব্যস্ত নেই শিকারের ধান্ধায়। দিনকে রাত, রাতকে দিন, সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে চক্রান্তের জালে আটকে জনগণের পকেট হতে অর্থ খসানোর অপর নামই বাংলাদেশের পুলিশ। কাজে বাধা আসলেই তারা হিংস্র হয়ে উঠে, পিটায়, সাজানো মামলা দিয়ে জেলে ভরে, গুম করে ফেলে, ক্রসফায়ারের নামে খুব কাছ হতে গুলি করে। সাংবাদিক ভাইদের কি এসব জানা ছিলনা? কজন সাংবাদিক বিনা স্বার্থে এসব নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন?
পুলিশের বাড়াবাড়ির গোড়াটা আসলে কোথায়? হাতের ভোতা ৩০৩ রাইফেল, ওয়াকি টকি নাকি ইউনিফর্ম? অনেকে অভিযোগ করেন অপ্রতুল বেতন ও সুবিধাদি। গোল্ডফিশ মেমোরির কারণে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই দুর্নীতিতে আমাদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপের কথা। পরপর চারবার এ গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে বিশ্বকে আলোকিত করেছি আমরা। অসামান্য এ সাফল্যে পুলিশের পাশাপাশি অন্যদের অবদান নিয়ে কেন আমরা কথা বলতে চাইনা? প্রাসঙ্গিক ভাবে একজনের একটা লেখার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কে লিখেছেন নামটা মনে নেই। তবে বিষয়টা ছিল শ্রমমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের একটা মন্তব্য নিয়ে। লেখক বলেছেন মন্ত্রী সুফিয়ানের মতে প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখে ভাষন দিতে গেলে কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগে। গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মন্ত্রী সুফিয়ান এমন কিছু অশালীন, অগ্রহণযোগ্য কথা বলেছিলেন পরে এর জন্যে জন্যে দায়ী করেছিলেন সভায় নেত্রীর উপস্থিতি। নেত্রী উপস্থিত থাকলে নাকি মাথা ঠিক রাখা যায়না, সবকিছুতে তালগোল লেগে যায়, কি বলতে কি বলে ফেলেন ঠিক থাকে না। বাস্তবতা হল, বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি হতে চাইলে নেত্রীর সন্তুষ্টি বাধ্যতামূলক। সমস্যা হল, নেত্রীকে সহজে কাছে পাওয়া যায়না। উনি প্রধানমন্ত্রী, ব্যস্ত থাকেন বিশাল বিশাল প্রকল্প নিয়ে। কালে ভদ্রে নেত্রীকে কাছে পেলে মন্ত্রী, এমপিরা উঠেপড়ে লাগেন সন্তুষ্ট করার কাজে। আর নেত্রীর সন্তুষ্টি কিসে তা রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি আমার মত ম্যাংগো পিপলদেরও জানা আছে। প্রতিপক্ষ নিয়ে অশ্রাব্য, কুৎসিত আর নোংরা গালাগালি নেত্রীর মন জয়ের অন্যতম মাধ্যম। আর নেত্রীর সন্তুষ্টি মানে সংসদ সদস্য পদ, মন্ত্রিত্ব পাওয়া, মন্ত্রিত্ব ধরে রাখা। এ জন্যেই বোধহয় জনপ্রতিনিধিরা অশালীন আর অসংলগ্ন কথাবার্তার প্রতিযোগীতায় নেমে যান নেত্রীকে সামনে পেলে। পুলিশের মতই দেশের রাজনীতিবিদদের শতকরা ৯৯ ভাগ অসৎ। খোদ প্রধানমন্ত্রী ধরা পরেছিলেন ১১টা চেক নিয়ে। সর্বশেষ ধরা পরলেন কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত বাবু। নেত্রীকে খুশি করলে মন্ত্রী-এমপি হওয়া যায়, আর মন্ত্রী এমপি হলে টাকার বস্তা পাওয়া যায়। তাহলে আমরা কি ধরে নিতে পারিনা টাকার বস্তার জন্যেই মন্ত্রী এমপিরা খিস্তি খেউর করেন? একই কারণ কি দেশের পুলিশ ও উচ্চ আদালতের বিচারকদের বেলায় প্রযোজ্য নয়?
ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের গণহারে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে পুলিশ ও বিচার বিভাগে। নিয়োগপ্রাপ্ত এসব ক্যাডারদেরও লক্ষ্য থাকে নেত্রীর মনোরঞ্জন। সংগত কারণে ওরা বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের উপর ঝাপিয়ে পরে ক্ষুধার্ত হায়েনার মত। যে যত পশু হবে তার জন্যে নির্ধারিত থাকবে ততো বেশি পুরস্কার। বিরোধী দলীয় হুইপ পেটানো ছাত্রলীগের পুলিশকে রাতারাতি পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে, পাশাপাশি উৎসাহিত করা হয়েছে বাকিদের। পুলিশের ভাল করেই জানা আছে সরকার ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় হতে তাদের দমন, পীড়ন, হত্যা, গুম সহ সব ধরণের নির্মমতা লালন করা হয়। মূল লালন কারী আমাদের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান। ক্ষুধার্ত হায়েনাদের রাস্তায় ছেড়ে দিলে তারা কেবল নির্ধারিত খাবারের দিকে হাত বাড়াবে এমনটা ভাবা হবে চরম বোকামি। পোশাকের আড়ালে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর আওয়ামী লীগের পুলিশ ও বিচারকরাও হায়েনা। স্বাধীন ভাবে চলতে দিলে ওরাও হাত বাড়াবে সাংবাদিকদের দিকে, লালসা চরিতার্থ করবে মহিলাদের শ্লীলতাহানীর মাধ্যমে,পাশাপাশি ভর্তি করবে নিজদের পকেট। এই সেই পকেট যা হতে জন্ম নেয় বস্তা, আর সে বস্তা রাতের আধারে হাত-পা মেলে রওয়ানা দেয় মন্ত্রী পাড়ায়, উড়ে যায় আমেরিকায়, বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও কানাডায়।
গত কদিনে ঘটে যাওয়া পুলিশি ঘটনা নিয়ে যারা মাতামাতি করছেন তাদের বলবো, আমাদের মূল সমস্যা আসলে পুলিশ নয়, বরং তাদের প্রতিপালক নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী সহ দেশের রাজনীতি। দেশকে একটা জাহাজ হিসাবে কল্পনা করলে রাজনীতিবিদেরা হবেন এ জাহাজের চালক আর পুলিশ সহ প্রজাতন্ত্রের সেবকেরা হবেন তার যাত্রী। চালক যেদিকে যাবেন সেদিকেই যাবে তার যাত্রীরা। পুলিশের সীমাহীন অন্যায় আর দুর্নীতির সমাধান চাইলে প্রথমে সমাধান প্রয়োজন আমাদের অশিক্ষিত আর বর্বর রাজনীতির। পুলিশের মত একজন সাহারা খাতুনও সে বর্বরতার অংশ। তার চেহারা দেখে এক বছরের শিশু কেন ১০০ বছরের বৃদ্ধ চীৎকার করে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা।
শামছু - একজন পুলিশ