বিশাল এক জনসভা। লাখো মানুষের পদচারণায় মুখরিত রাজপথ। ছবিতে দেখলে মনে হবে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পরছে লোকালয়ে। এমনটাই ছিল ১৮ দল আহুত জনসভার চিত্র। দেশীয় রাজনীতির সমাবেশ সমাবেশ চড়ুইভাতি খেলার সাথে যাদের পরিচয় নেই তারা নিশ্চয় বিভ্রান্ত হবেন, চমকিত হবেন এবং অজান্তে উপসংহার টানবেন চলমান রাজনীতির দিক নির্দেশনা ও তার চালিকাশক্তি নিয়ে। কল্পনা করুন এমন একটা চিত্র, দক্ষিন আফ্রিকার লিজেন্ডারি নেতা নেলসন মেন্ডেলা ট্রানজিট ভিসায় কয়েক ঘন্টার জন্যে ঢাকায় নামলেন এবং ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলেন ভিআইপি রোডের জনসভায়। বর্ণবাদী প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ২৬ বছর এক নাগারে জেলখাটা এই নেতা নিশ্চয় বিস্মিত হবেন, হিংসা করবেন এবং কিছুটা হলেও নিজের জনপ্রিয়তা নিয়ে আক্ষেপ করবেন। আমরা মেন্ডেলা নই, তাই জনসমুদ্রের এসব যাদু টোনায় বিভ্রান্ত হইনা। ডাল-ভাতের লড়াইয়ে নিষ্পেষিত একজন বাংলাদেশি হিসাবে আমাদের প্রায় সবার জানা আছে এসব জনসভার আসল স্বরলিপি। ক্ষমতার ভরা যৌবনে সাফল্যের সূর্য যখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে গোপনে অতি গোপনে রাজনীতির কলাকুশলীরা প্রস্তুতি নিতে থাকেন এ দিনটার। টাকায় টাকা আনে, - বিনিয়োগ বাণিজ্যের এ সহজ সত্যটা এখন আর গোপন কোন তত্ত্ব নয়, রাজনীতিবিদদেরও জানা আছে রাজপথ হতে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসতে চাই টাকা, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। মাও সে তুং বলেছিলেন বন্দুকই নাকি ক্ষমতার উৎস। প্রলেতারিয়েতদের এই নেতা বেচে থাকলে আজ হয়ত নিজেই নিজের ভুল স্বীকার করে মেনে নিতেন, বন্দুক নয় আসলে ক্ষমতার উৎস টাকা। টাকাই ক্ষমতার গাছ বপন করে এবং একসময় তা প্রস্ফুটিত হয়ে ভরিয়ে দেয় ফুলে ফলে। ক্ষমতার গেল টার্মে ৪ দলীয় জোট অসংখ্য দুধোলো গাছ লাগিয়েছিল বলেই এখন ফসল পাচ্ছে। গতকালের জনসভাও ছিল তেমনি এক ফসলের মহা প্রদশর্নী।
দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেছে মানুষের। আওয়ামী দুঃশাসনের যাঁতাকলে শুটকি হতে চলছে মানুষের বেচে থাকা। দলীয় বিষাক্ত থাবায় ছিন্নভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে পরিণত করা হয়েছে ব্যক্তি পূজার সার্কাস হিসাবে। বাজার-বন্দর জ্বলছে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ দাবানলে। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, গ্যাস নেই, আইন নেই, আইনের প্রয়োগ নেই, সরকারের ছত্রছায়ায় মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, নদী-নালা, হাওর-বিলে ভাসছে বেওয়ারিশ লাশ। বিশ্বব্যাংকের মত আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠান চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছে মন্ত্রীদের চুরি, গভীর রাতে টাকার বস্তা নিয়ে ধরা পরছেন সরকারের মন্ত্রীরা। লুটপাটের এসব মহোৎসবের বর্ণনা দিতে গেলে মহাভারত লিখেও শেষ করা যাবেনা মহাজোটিয় অপশাসন আর কুশাসনের পরিধি। এমন একটা প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলীয় মহাসমাবেশ জনগণের জন্যে বয়ে আনার কথা আশা, ভরসা আর কিছুটা হলেও আস্থা। এতগুলো মানুষের সামনে দাড়ালে এমনিতেই বুকের ছাতি দশ ইঞ্চি বেড়ে যায়, গলার স্বর চলে চৌথা আসমানে। জনসভার মহাসমুদ্রে দাড়িয়ে খালেদা জিয়া ভাষন দিলেন। তুলে ধরলেন সরকারী অপকর্ম ও ব্যর্থতার ফিরিস্তি। প্রতিশ্রুতি দিলেন রমজান ও ঈদে জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে হরতাল, ধর্মঘট ও অবরোধের মত কঠোর কর্মসূচী না দেয়ার। আহ্বান জানালেন ক্ষমতার পালাবদলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করতে। তিনি যা বললেন তার সাথে দ্বিমত করার যুক্তি খুজে পাওয়া মুস্কিল হবে। আওয়ামী লীগের বিদায় এখন সময়ের দাবি ও বাস্তবের চাহিদা। কিন্তু কি ভাবে এবং কাদের নেত্রীত্বে আসবে সে বিদায়? ১৮ দলীয় জোটের মাধ্যমে?
এখানেই শিউরে উঠতে হয় আমাদের। জাতি হিসাবে আমরা যদি আলঝাইমারস রোগে আক্রান্ত না হয়ে থাকি তাহলে ভুলে যাওয়ার কথা নয় ৪ দলীয় জোটের ইতিহাস। দুই সন্তান, সাথে আপন ভাই, বোন, মা ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে খালেদা জিয়া যে লুটের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তা জনসভার চুন সুরকি দিয়ে ঢাকা যাবে বলে মনে হয়না। উনি জোর গলায় বললেন আওয়ামী নেতাদের চুরির কথা, কিন্তু যাদের পাশে বসিয়ে এসব বললেন তাদের লুঙ্গি ধরে টানলে কি বেরুবে তা আমাদের সবার জানা। এক আমানুল্লাহ আমান আর সাদেক হোসেন খোকার চুরির ইতিহাস ঘাটতে গেলে আরব্য উপন্যাসের মত রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যাবে। লুটপাট আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য বানিয়ে বাংলাদেশকে ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক সম্পত্তি বানানোর আর্কিটেক্ট হিসাবে কাউকে চিহ্নিত করতে গেলে যার নাম সামনে আসবে তিনি হলেন বেগম জিয়া। এ দেশের মানুষ এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে গেছে ভেবে থাকলে নেত্রী মারাত্মক ভুল করবেন। এক কাপ চা আর একটা আকিজ বিড়ির গণতন্ত্র ভোট বাণিজ্যে অনেক কিছু জয় করা গেলেও মানুষের বিবেক জয় করা যায়না। কলুষতার ষ্টীমরোলারে জাতির বিবেককে হয়ত সাময়িক ভাবে ছয় ফুট নীচে সমাহিত করা গেছে, কিন্তু তা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এমনটা ভাবার কারণ নেই।
জনাবা খালেদা জিয়া, আপনি আরও একটা জনসভা ডাকুন। এমন এক জনসভা যেখানে কোটি মানুষের সমাবেশ হবে। এবং সে জনসভায় উচ্চকণ্ঠে জাতির কাছে আপনি ক্ষমা চাইবেন। ক্ষমা চাইবেন স্বীয় সন্তান দ্বয়ের চুরির জন্যে, আপন মার ভূমি দস্যুতার জন্যে, ভাই-বোনদের গন লুটপাটের জন্যে। রাজনীতির ছত্রছায়ায় আমান, খোকা, মওদুদ আর নাজমুল হুদাদের মত বিশ্ব চোরদের জন্ম দেয়ার জন্যে। সবশেষে ৭১’এর খুনিদের গাড়িতে মন্ত্রিত্বের পতাকা উড়িয়ে দেয়ার জন্যে। জাতি হিসাবে আমাদের মন খুবই দুর্বল। কান্নাকাটির মাধ্যমে কেউ ক্ষমা চাইলে আমরা ভুলে যাই অতীত এবং ক্ষমা করে দেই নব জন্মের প্রত্যাশায়। এ মুহূর্তে রাজনীতিতে আশার আলো ছড়াতে চাইলে ক্ষমা প্রার্থনাটা খুবই জরুরি। যতদিন তা না করছেন টাকার পাহাড় ছড়িয়ে কোটি মানুষের সমাবেশ, ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন ব্যর্থতার হাজার ফিরিস্তি আর হরতাল অবরোধের হুমকি ধামকি দিলেও আমরা আপনাকে তারেক-ককোর মত চোরের মা, বাংলা ভাইয়ের মত সন্ত্রাসের নেত্রী আর পারিবারিক রাজনীতির অযোগ্য ধারক বাহক হিসাবেই দেখতে থাকব।