ভরা বর্ষার সময় এখন। চারদিকে বন্যার পদধ্বনি। দুবেলা দুমুঠো আহার আর মাথার উপর যেনতেন ছাদের মধ্যে যাদের জীবন যুদ্ধ সীমিত তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন এক যুদ্ধের। এ যুদ্ধ মহাশক্তিধর প্রকৃতির বিরুদ্ধে সহায় সম্বলহীন মানুষের যুদ্ধ। উজান হতে তেড়ে আসা বানের স্রোত সাময়িক ভাবে বিপর্যস্ত করবে তাদের জীবন, লন্ড ভন্ড হবে সাজানো সংসার। প্রকৃতির এ আগ্রাসনকে নিয়তি মেনে মানুষ আকড়ে ধরবে ভিটে মাটি। নৌকা, গাছ অথবা ডুবন্ত ঘরের চালকে আশ্রয় বানিয়ে চালিয়ে যাবে টিকে থাকার লড়াই। কারণ তারা জানে বিপর্যয়ের অন্য পিঠেই বপিত হয় নতুন বীজ, অংকুরিত হয় নতুন চারা, প্রস্ফুটিত হয় নতুন নতুন আশা। এও জানা থাকে বানের তোড়ে কেবল পানিই ভেসে আসেনা, সাথে আসে উর্বর পলিমাটি। আর সে মাটিকে ঘিরে বাঁধা যায় নতুন ঘর, দেখা যায় নতুন স্বপ্ন আর জীবনকে নেয়া যায় নতুন উচ্চতায়। প্রকৃতির সাথে মানুষের এ লড়াই নতুন কোন লড়াই নয়, এ অনন্তকালের লড়াই। দুএকটা ব্যতিক্রম হলেও মানুষকেই জিততে হয় এ লড়াইয়ে। সভ্যতা বিবর্তনের এ ইতিহাস কোটি বছরের পুরানো এবং তা ঘুরছে চক্রাকারে। হয়ত আরও কোটি বছর ধরে ঘুরতে থাকবে এবং একদিন বানের তোড় না হয়ে সুনামির বেশে ফিরে আসবে আমাদের মাঝে। থমকে যাবে কি সেদিনের বেচে থাকা?
মানুষের বেচে থাকা কোনোদিনই থেমে যায়না।
দূরের দেশ মার্কিন মুলুকের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সেতুর অকাল মৃত্যু নিশ্চয় থামিয়ে দেবেনা পদ্মা পাড়ের মানুষের জীবন। প্রতিদিনের মতন আবারও তারা জীবনের সন্ধানে নদীতে নামবে, কুল ঘিরে বাঁধার চেষ্টা করবে নতুন নতুন ঘর, হয়ত জেগে উঠা চর নিয়ে চালিয়ে যাবে পুরানো লড়াই। ওয়াশিংটনে সেদিন কি ঘটেছিল এ নিয়ে এলাকার মানুষ কোনোদিনই প্রশ্ন তুলবে না, বরং আশা ভঙ্গের নতুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভুলে যাবে এ প্রসঙ্গ। পদ্মা পাড়ের আকাশে বাতাসে এখন দীর্ঘশ্বাসের বসন্তমেলা। ঘর হতে বৌ ঝিদের উঠিয়ে নিলেও তাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়, আপনজনদের লাশ বানিয়ে নদীর কাদামাটিতে পুতে রাখলেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে হয়, আর অজান্তে বের করে আনতে হয় অক্ষমতার দীর্ঘশ্বাস। চোখের পানির নোনাজলে পদ্মায় ইলিশ আনা যাবেনা ভেবেই হয়ত এলাকার মানুষ কান্না এখন উঠিয়ে রাখছে। কিন্তু আমরা যারা নদীর পানিতে ত্যানা পেঁচাতে অভ্যস্ত তাদের মগজে পদ্মা সেতু ইলিশ মাছের মতই ডিম ছাড়তে থাকবে, এবং এ ডিম সুস্বাদু মাছ হয়ে তর্ক বিতর্কের উপাদান জোগাতে থাকবে।
এর পর আমার লেখায় যা থাকবে তার কোন বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা নেই, নেই প্রমাণের জন্যে দলিল দস্তাবেজ। চাইলে অবিশ্বাস করতে পারেন এবং আনুমানিক গল্প ফাসানোর অভিযোগে আমাকে অভিযুক্ত করতে পারেন। পছন্দ পাঠকদের এবং লেখক হিসাবে আমি সন্মান সে পছন্দকে।
আবুল হোসেন বনাম পদ্মা সেতু।
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয় যেখানে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন। এবং পাশাপাশি এটাই একমাত্র দেশ নয় যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের চাবি হিসাবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। কেবল দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশ গুলোতেও রাজনৈতিক দস্যুতা একটি স্বীকৃত রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ নিয়মিত ’ইন্তেকাল’ করে থাকেন। অনেকে আবার চালিয়ে যান টিকে থাকার কৌশলগত লড়াই। ক্রাইম & পানিশমেন্ট পর্বে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে সরে যেতে হয় ক্ষমতা হতে এবং দেশের আইন ও ব্যবস্থার সিড়ি ডিঙ্গিয়ে প্রমাণ করতে হয় নিজের নির্দোষিতা। গণতন্ত্রের বাল্যশিক্ষায় সোনালি হরফে লেখা থাকে এ বাধ্যকতা এবং পোষা কুকুরের মত শুনতে বাধ্য থাকেন ক্ষমতার খুচরা হতে শীর্ষ ব্যক্তিদের সবাই। বাংলাদেশের সাথে বাকি দুনিয়ার তফাতটা বোধহয় এখানেই। মৌখিক অভিযোগের পর প্রমাণ সহ আবুল হোসেনকে ধরিয়ে দিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু কোন কিছুই টলাতে পারল না দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের। আবুল হোসেন মাথা উচু করে দাড়িয়ে রইল ক্ষমতার দোর গোড়ায়। সরকার প্রধান হতে শুরু করে মন্ত্রীসভার সবাই গোয়েবলসিয় কায়দায় প্রচার চালিয়ে গেল আবুল হোসেনের নির্দোষিতার। সাথে যোগ দিল দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন সহ অনেক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংক অনুরোধ জানাল তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রীসভা হতে আবুল হোসেনকে দূরে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু কোন কিছুই টলাতে পারল না মন্ত্রীসভার মালিক প্রধানমন্ত্রীকে। আবুল হোসেনকে কেবল নির্দোষ হিসাবেই দাবি করলেন না বরং বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন দুর্নীতির। এসবের পেছনে শুধু কি প্রধানমন্ত্রীর ইগো কাজ করেছিল নাকি জড়িত ছিল এমন কিছু বাধ্যবাধকতা যা হতে বেরিয়ে আসতে অক্ষম ছিলেন তিনি? বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির জন্যে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১১ সালে।
সিনে জগতের প্রতিভাবান ব্যক্তি তারেক মাসুদ মারা গেলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। চারদিকের রাস্তাঘাট তখন ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। মানুষ মরছে পশুর মত। দেশের বাস মালিকরা পর্যন্ত ঘোষনা দিতে বাধ্য হল রাস্তার সংস্কার না করলে যাত্রী পরিবহন বন্ধ করে দেবে। এবং সময়টা ছিল ঈদের সময়। চারদিকে দাবি উঠছে আবুল হোসেনের পদত্যাগের। এ নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ আন্দোলনে নামলেন এবং ব্যর্থতার জন্যে সরাসরি আবুল হোসেনকে দায়ী করলেন। আবুল হোসেন হাসলেন তার ভুবনখ্যাত হাসি এবং অনেকটা উপেক্ষার সুরে জানিয়ে দিলেন তিনি এখন পদ্মা সেতু ও মনো রেলের মত বড় বড় মাছ ভাজিতে ব্যস্ত। দাবি নিয়ে অনেকে হাজির হলেন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে। এবং এখানেই প্রধানমন্ত্রী টেনে আনলেন এমন একটা নাম যার জরায়ুতে জড়িয়ে ছিল পদ্মা সেতু দুর্নীতি ও আবুল হোসেন রহস্যের অনেক অজানা অধ্যায়। ঠাট্টাচ্ছলে প্রধানমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিদায় নিশ্চিত করতে সাংবাদিকদের আপন বোন শেখ রেহানার কাছে যাওয়ার আহ্বান জানালেন। অনেকে ভেবেছিলেন এ প্রধানমন্ত্রীর নিত্যদিনের বাচালতা মাত্র, গুরুত্ব দেয়ার তেমন কিছু নেই।
কে এই আবুল হোসেন এবং কি সম্পর্ক তার শেখ রেহানার সাথে? ব্যাপারটা খোলাসা করতে আমাদের ফিরে যেতে হবে অনেক গুলো বছর আগে।
অনেক অনেক বছর আগের ঘটনা।
পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ড হতে বেচে যাওয়া দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অনেকটা কপর্দকহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর দেশে দেশে। অন্ন বস্ত্র চিকিৎসার কোনটারই নিশ্চয়তা নেই। এমন এক অনিশ্চিত সময়ে শেখ রেহানার স্বামীর মস্তিস্কে ধরা পরে টিউমার, যার অপসারণ ছিল খুবই জরুরি। বিশাল অর্থের প্রয়োজন, কিন্তু কোথা পাবেন এত অর্থ? আওয়ামী রাজনীতির হোমড়া চোমরাদের অনেকের কাছে সাহায্য চাইলেন শেখ রেহানা। কিন্তু কনিষ্ঠ শেখ কন্যার রাজনীতির ভবিষ্যৎ অবস্থান নিশ্চিত না হয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে রাজী হলেন না। ব্যতিক্রম হয়ে যোগাযোগ করলেন মাদারীপুরের সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন তরুন নেতা। ব্যবসায়ী হিসাবে অনেকটাই সফল তিনি। বিশাল অংকের সাহায্য করলেন এবং এ সাহায্যের বদৌলতে শেখ রেহানার স্বামী ভর্তি হন ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর শেরি বেগাওয়ানের এক হাসপাতালে। অস্ত্রোপচার সফল হয় এবং লম্বা সময় হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে আসেন নিজ ঠিকানায়। দেশীয় রাজনীতিতে শক্তিধর আবুল চরিত্রের উত্থান বোধহয় এখানেই। এখানেই জন্ম নেয় একজন ভবিষ্যৎ মন্ত্রীর যার গোপন খুঁটির কারণে ভেস্তে যাবে কোটি মানুষের শত বর্ষের স্বপ্ন পদ্মা সেতু।
আউলা ঝাউলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল।
মাইনাস টু ফর্মুলার সাথে যোগ দিয়েছেন দুই শিবিরের অনেক শক্তিশালী নেতা। একদিকে মান্নান ভূইয়া, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত সৈনিক আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমু। নেত্রী শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার চাপ আসছে উপর মহল হতে। কিন্তু কে হবে বিকল্প নেতা এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে দ্বিধা করছিলেন সৈনিক ত্রয়। যে কোন তরফ হতেই হোক সামনে আসে শেখ রেহানার নাম এবং গ্রহণযোগ্যতা ও দলীয় ঐক্যের খাতিরে নেতারা মেনে নেন এই প্রস্তাব। শুরু হয় আওয়ামী রাজনীতির কলঙ্কিত অধ্যায়।
- চলবে