বিশ্বব্যাংক এবং পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশের রাজধানী এখন সরব। মিডিয়াও ফলাও করে প্রচার করছে সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের খবর। প্রচার পেলেও বাংলাদেশ ছাড়া দ্বিতীয় কোন দেশের সাধারণ মানুষ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করবে এমনটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। কারণ বাংলাদেশ নিয়ে এসব খবর বাকি বিশ্বের জন্যে নতুন কোন খবর নয়। স্বাধীন দেশ হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভূত হওয়ার শুরু হতেই প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের খবর স্থান পেয়ে আসছে ভুল কারণে। বন্যা, খরা, সন্ত্রাস, খুন, গুম, দুর্নীতিতে হ্যাটট্রিক শিরোপা সহ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ে এমন সব আতঙ্কজনক খবর প্রচার পাচ্ছে যা দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পরিচয়ে নিগেটিভ কিছু কম্পোনেন্ট স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। তাই দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিশ্ব মিডিয়া বাংলাদেশের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিয়ে হাইলাইট করছে বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যকে। নয় মাস আগে এ জাতীয় দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশ করে জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জের বিখ্যাত উইকিলিকস। সরকারের উঁচু মহল এ খবরটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং অর্থমন্ত্রীর সিগনেচার মন্তব্য ’রাবিশ’ কায়দায় উড়িয়ে দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রথম হতেই সিরিয়াস ছিল এবং ঘটনার সূত্রধরে কানাডার জনৈক কোম্পানীর অফিসে পর্যন্ত হানা দিয়েছিল। সরকারের তাতেও ঘুম ভাঙ্গেনি। হয়ত ভেবেছিল বিরোধী দল ঠেঙ্গানোর কায়দায় বিশ্বব্যাংককেও ঠেঙ্গিয়ে লোন আদায় করে নেবে। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরণের লোন বন্ধ এবং পরবর্তীতে নতুন করে সচল করার কাহিনী বিশ্বব্যাংকের জন্যে এই প্রথম নয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার ইতিহাস ঘাঁটলে এর পক্ষে প্রমণ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ সরকারের হয়ত তা ভাল করেই জানা ছিল। এ যাত্রায় বিশ্বব্যাংক তার সিদ্ধান্তে এতটা অটল থাকবে সরকারের জন্যে তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এবং এখানেই ভূত হিসাবে দৃশ্যপটে হাজির করা হচ্ছে দেশের নোবেল লরিয়েট ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে।
বিশ্বব্যাংক কাগজে কলমে যদিও একটি স্বাধীন সংস্থা কিন্তু এ কোন লুকানো সত্য নয় যে সংস্থার প্রায় সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাংকের প্রধান পদটি অলিখিতভাবে নির্দিষ্ট করা থাকে মার্কিন নাগরিকদের জন্যে। সে দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রভাব বিশ্বব্যাংকের লেনাদেনা কে প্রভাবিত করেনা এমনটা ভাবা হবে বোকামি। গেল দুবছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্কের নজিরবিহীন অবনতি ঘটেছে। সরকারের কোন মহলেই এ নিয়ে লুকোচুরি ছিলনা। অবশ্যই এর অন্যতম কারণ ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস। মার্কিন সরকার বাকি বিশ্বের অন্তত ১০০ দেশের সরকারের মত ইউনুসের গ্রামীন ব্যাংক ভিত্তিক মাইক্রো ক্রেডিটকে উৎসাহ দিয়ে আসছে এবং বিভিন্ন ফোরামে তা প্রমোট করছে। ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পেছনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের রিকমেনডেশন ছিল তা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার পরে না। নোবেল পুরস্কার প্রদান প্রসেসটাই এরকম, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে বিখ্যাত সব ব্যক্তিরা মনোনয়ন পাঠায় এবং নোবেল কমিটি তা যাচাই বাছাই পূর্বক একজনকে মনোনিত করে। এ বিবেচনায় বিল ক্লিনটনের পছন্দ ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস হয়ে থাকলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে এমনটা ভাবা হবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। ক্লিনটন পরিবারের সাথে ডক্টর ইউনুসের বন্ধুত্ব বিল ক্লিনটন যখন আরকানস অঙ্গরাজ্যের গর্ভনর ছিলেন সে আমল হতে। ক্লিনটন আমেরিকার ইতিহাসে সফলতম প্রেসিডেন্টদের একজন। তার আমলেই আমেরিকার অর্থনীতি ফুলে ফেপে আকাশে উঠেছিল। বেকারত্ব নেমে এসেছিল সর্বকালের নিম্ন পর্যায়ে। এমন একজন সফল প্রেসিডেন্টের পছন্দকে বাংলাদেশের অসুস্থ রাজনীতির দাড়িপাল্লায় বিচার পূর্বক শাস্তি দেয়া হবে অলীক, অবাস্তব ও ঘোরতর অন্যায়। ওবামা প্রশাসন একাধিকবার অনুরোধ করেছিল ইউনুসকে যেন সরকারের আক্রোশ হতে রেহাই দেয়া হয়। এ অনুরোধ নিয়ে দেশটার বেশ কজন আন্ডার সেক্রেটারী বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং সরকারের উঁচুমহলে দেখা করে মার্কিন সরকারের মনোভাব সরকার প্রধান সহ অনেকের কাছে পৌছে দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার ব্যস্ত ছিল অন্য মিশনে। এখানে গোটা সরকার বললে অনেকটাই বাড়িয়ে বলা হবে, বরং সরকার প্রধান বলাটা হবে যুক্তিসঙ্গত। ইউনুসকে গ্রামীন ব্যাংক হতে সরানো সরকার প্রধানের জন্যে জরুরি ছিল দুটো কারণে; প্রথমত, ১/১১’র আমলে রাজনীতিতে প্রবেশ চেষ্টার ’অপরাধ’ ও শাস্তি, দ্বিতীয়ত, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের পরিচয়ে প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবের নাম পেছনে ফেলে সে আসনে ইউনুস নাম প্রতিষ্ঠার ’অপরাধ’ ও শাস্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। দেশটা ঘোষক আর পিতা রোগে আক্রান্ত নয় যে পছন্দ অপছন্দের জন্যে বাংলাদেশের দ্বারস্থ হতে হবে। তারা পছন্দ করছে বাংলাদেশের ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে আর আমরা তাকে শাস্তি দিচ্ছি; দুটো সার্বভৌম দেশের নিজ নিজ সিদ্ধান্ত আর পছন্দ অপছন্দকে স্বাগত জানানোটাই হোত পারস্পরিক সন্মান শ্রদ্ধার চিহ্ন। ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস আসলেই কি বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে গিয়ে আর্জি জানিয়েছিলেন পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের জন্যে? এখানেই চলে আসে অপ্রিয় কিছু সত্য কথন।
০.৭৫% হারে পদ্মা সেতুর জন্যে লোন দিতে বিশ্বব্যাংক কি বাধ্য ছিল, নাকি আমরা নিজেদের স্বার্থেই ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছিলাম সহজ শর্তের এ লোনের জন্যে? আর আমরাই যদি করে থাকি তাহলে আমাদের কি জানা ছিলনা এই ব্যাংকের প্রায় সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক? একই দেশের সাথে বিভিন্ন কারণে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে এই লোন পাওয়া যে সহজ হবেনা তা কি সরকারের বাঘা বাঘা উপদেষ্টা আর অথর্ব মন্ত্রীদের মগজে প্রশ্ন জাগেনি? এখানেই প্রশ্ন উঠে ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসকে কি গায়ের জোরে, বয়সের মত হাস্যকর যুক্তি দিয়ে গ্রামীন ব্যাংক হতে সরানোটা জরুরি ছিল, নাকি ক্ষমতাধর এই বাংলাদেশিকে সাথে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে দেশের জন্যে সুবিধাদি আদায় করাটা ছিল বেশি জরুরি? ইউনুস কি গ্রামীন ব্যাংক নিয়ে সুরঞ্জিত বাবুর মত রাতের আধারে বমাল ধরা পরেছিলেন, নাকি অবৈধ টাকা কামিয়ে ভূমধ্যসাগরের কোন দ্বীপে প্রাসাদ বানিয়েছিলেন যার জন্যে তার প্রস্থানটা ছিল বাধ্যতামূলক? উনি সুদের ব্যবসা করেন, এই ব্যবসার ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু গোটা বিশ্বকে অখুশি করে দেশীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যে বর্তমান দুনিয়ায় সহজ নয় রাজনীতি করতে গেলে এ সহজ সত্য গুলো উপলব্ধি করার সময় এসেছে। এখানেই প্রশ্ন আসে প্রধানমন্ত্রী উদ্দেশ্য ও সততা নিয়ে। উনার কাছে কি পদ্মা সেতুটা জরুরি ছিল, নাকি জরুরি ছিল বাবার নাম প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপক্ষ নির্মূল করার মত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মিশন বাস্তবায়ন? গ্লোবাল অর্থনীতির দুনিয়ায় একসাথে দুটো কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু হতে সরে গেছে। এ নিয়ে ব্যাংকের চরিত্র হননের চেষ্টা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নতুন নতুন বাঁধা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে মাত্র। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে বিচারক সাজার আসনে বসে নেই বাংলাদেশ। ১৬ কোটি মানুষের পেটে ভাত আর মাথার উপর যেনতেন ছাদ নিশ্চিত করার কাজে এ মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে পোষাক রপ্তানী আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে আদম রফতানির কোন বিকল্প তৈরী হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যাচ্ছে সৌদি আরব সে দেশে বসবাসরত বিশ লাখ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে ঢাকায় নিহত দেশটার কুটনীতিক হত্যার বিচারে সরকারের ব্যর্থতা ও অনীহার কথা। সৌদি ঘোষনা আসা মাত্র সরকারের প্রচার যন্ত্র হুমড়ি খেয়ে পরবে জামাতিদের উপর। উপলক্ষ হিসাবে টেনে আনবে যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রসঙ্গ। মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারী হিলারি ক্লিনটন হাল্কা করে হলেও হুমকি দিয়ে গেছেন আমিনুল হক নামের শ্রমিক নেতা হত্যার বিচার না হলে দেশটায় পোশাক রফতানি অনিশ্চয়তার কথা। জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করার মত অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। যতদিন এ অবস্থান তৈরী না হচ্ছে ততদিন কুমিরের সাথে বুঝা পরার মাধ্যমে কি করে বেচে থাকা যায় সে কৌশল আবিস্কার করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সুরঞ্জিত বাবুর মত চোর আর পিতা-ঘোষকের অসুস্থ লড়াই চালিয়ে আগামী ১০০ বছরে যদি সে অবস্থানে যাওয়া যায় তাই হবে চরম পাওয়া।