রাত নামার সাথে সাথে গেসু চোরার আতংক চেপে ধরত গোটা শহরকে। পাড়ায় পাড়ায় চৌকিদার বসিয়েও কাজ হত না। কোন এক অলৌকিক ক্ষমতা বলে চুরি শেষে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হত সে। স্কুলে পড়ি তখন। অবসর সময়ে দস্যু বনহুর আর বাহরাম সিরিজ নিয়ে মেতে থাকি। চোর দস্যু সম্পর্কে সনাতন ধ্যান ধারণার বাইরে গিয়ে প্রায়শই বনহুর আর বাহরামের সাথে গুলিয়ে ফেলি তাদের। মাঝে মধ্য এই গেসু চোরাকেই মনে হত ভাগ্যহত মানুষের একমাত্র উদ্ধারকর্তা, দস্যু বনহুর। ভয়াবহ গরম পরেছিল সে বছর। পাড়ায় হাতে গোনা কয়েকটা বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল কেবল। আমরা ছিলাম ভাগ্যবানদের একজন। সে রাতেও আসর জমেছিল আমাদের উঠানে। কেউ পুঁথি, কেউ খনার বচন, কেউবা আবার সুর করে জারি গান গেয়ে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল আসরকে। বিছানায় যেতে যেতে মধ্যরাত পেরিয়ে গেল আমাদের। ফজরের আযান শুরু হয়নি তখনো। ঠিক এ সময় হৈ চৈ পরে গেল বাড়িতে। কে একজন গেসু চোরাকে দেখেছে। বাড়ির মহিলারা বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। প্রতিবেশীদেরও ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং হাতের কাছে যা পেল তা নিয়ে এগিয়ে এল। অবস্থা বেগতিক দেখে পালানোর পথ খুঁজতে শুরু করল গেসু চোরা। এক আন্ডারওয়্যার ছাড়া পরনে কোন কাপড় না থাকায় অদ্ভুত দেখাল তাকে। আমার কাছে মনে হল ঠিক জঙ্গল বীর টারজানের মত। বড় ভাই সহ বাড়ির কামলা তোতা কাকা ঝাপটে ধরার চেষ্টা করল তাকে। গণ্ডারের মত শরীর আর অসুরের মত শক্তির কারণে গেসু চোরার নাম শুনলে অনেকে ভয় পেত। ৪/৫ জন আপ্রাণ চেষ্টা করেও আটকে রাখতে পারল না তাকে। শক্তির ভারসাম্য হীনতার সাথে যোগ হয়েছিল পা হতে মাথা পর্যন্ত মাখা জবা কুসুম নারকেল তেল। এতটাই পিচ্ছিল ছিল তার শরীর গরু বাঁধার দড়ি দিয়েও আটকানো গেলনা তাকে। সবাইকে হতাশ করে এক ঝটকায় বেরিয়ে গেল বাহু বন্ধন হতে। তারপর ভৌ দৌড়। তিন স্ত্রী নিয়ে থাকত সে আমাদেরই পাড়ায়। আমরা জানতাম কোনদিকে যাচ্ছে সে। আমরাও তার পিছু নিলাম। বাড়ির কাছাকাছি আসতে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে চমকে উঠল সবাই। তিন স্ত্রী হাতে তিন বটি নিয়ে উন্মত্ত হায়েনার মত লাফাচ্ছে আর চীৎকার করছে যাকে সামনে পাবে তাকেই পরপারে পাঠাবে বলে। ভয়ে হীম হয়ে গেল আমাদের রক্ত। মুরুব্বিরা আদেশ দিল ফিরে যাওয়ার। কথা না বাড়িয়ে ফিরে গেলাম আমরা। বেলা গড়াতেই চোরের বাসায় পুলিশ হানা দিল।
পুলিশ চরিত্রের কলেরা এতটা বিস্তার লাভ করেনি তখনও। একজন চোরের কাছে পুলিশ ছিল মূর্তিমান আতংকের মত। কথায় কথায় অপরাধীকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস হতেও জাতি ছিল অনেক দুরে। দুপুরে পুলিশ সহ মুরুব্বিদের নিয়ে আসর বসল আমাদের উঠানে। তিন স্ত্রী সমভিব্যাহারে যথাসময়ে গেসু চোরাও হাজির হল। যা ঘটেছিল তার জন্যে শেষ পর্যন্ত হাঁটু গেড়ে মাফ চাইতে বাধ্য হল। তবে তার আগে স্ত্রীরা বিতর্ক করল এবং দাবি করল যেহেতু গেসু চোরা কিছুই চুরি করতে সক্ষম হয়নি তাই চুরির অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা যায়না। এক পর্যায়ে তাকে হেনস্থা করার জন্যে ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসল তারা। মুরুব্বিদের অনেকে জুতা নিয়ে মারতে এল। আহত বাঘের মত গর্জাল তারা এবং সর্বকালের সেরা অশ্লীল ভাষার ব্যবহারে কেঁপে উঠল চারদিকের আকাশ বাতাস।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিপ্লবের ডাক দিয়েছে হাসিনা সরকার। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে ১৬ কোটি মানুষকে ৩২ কোটি হাত নিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে তারা। বিশ্বব্যাংক ফিশ্বব্যাংক যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়, এবার এগিয়ে যাওয়ার সময়। অনেকটা অক্টোবর বিপ্লব উত্তর রাশিয়া গড়ার মত জাতিকে নিজ হাতে পদ্মা সেতুর ইট পাথর গাথার দাওয়াত দিচ্ছেন সরকার প্রধান। জাতিও জবাব দিতে কার্পণ্য করছেনা। ইতিমধ্যে ঘোষনা এসেছে বেতনের একটা অংশ ত্যাগ করবে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা। সরকারী দলের সহ নেত্রীও রাজি হয়েছেন একবেলা কম বাজার করার। ঘোষনা আসার এ কেবল শুরু। বাকশাল শুরুর ইতিহাস যাদের মনে আছে তাদের কাছে নতুন মনে হবেনা ঘোষনার প্লাবন। তবে নতুন প্রজন্মের যাদের সৌভাগ্য হয়নি বাকশাল নাটক উপভোগ করার, রক্তে কিছুটা হলেও দোলা লাগবে। হাজার হলেও এ বিপ্লব বিশ্বব্যাংকের মত ’রক্তচোষা’ ব্যাংকের বিরুদ্ধে। সরকার প্রধান অভিযোগ করছেন বিশ্বব্যাংক নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জাতি হিসাবে আমাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলার অধিকার রাখে না। তিনি বলছেন অপমানের জন্যে ব্যাংককে ক্ষমা চাইতে হবে। আরও একধাপ আগিয়ে গিয়ে দাবি করছেন আমরাও বিশ্বব্যাংকের অংশ এবং স্বচ্ছতা প্রমাণের জন্যে তাদেরকেও কাগজপত্র দেখাতে হবে। মোবাইল ফোন ও ই-মেইল এড্রেস প্রকাশ করে জাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন দুর্নীতি নামক সোনার হরিনের দেখা মিললে সরাসরি যোগাযোগ করতে। এদিকে দেশের খাদ্যমন্ত্রী জনাব আবদুর রাজ্জাক দাবি করছেন শেখ মুজিব হত্যায় সিআইয়ের সংশ্লিষ্টতার কথা। অবশ্য শক্তিশালী এই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বস লিওন পেনাত্তাকে ওয়াশিংটন হতে ধরে এনে মানবতা বিরোধী ট্রাইবুনালে বিচার করার দাবি করেছেন কিনা জানা যায়নি। সময় হলে এ দাবিও সামনে আসবে নিশ্চয়।
উন্নত বিশ্বের রাজধানীতে বসে এসব খবর পড়লে মনে হবে কিউবান কায়দায় নতুন কোন বিপ্লব ঘটে গেছে বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা ও আবুল মাল মুহিতের চেহারায় ফিরে এসেছেন যুবা ফিদেল কাষ্ট্রো ও বিপ্লবী চে গুয়েভারা। কিন্তু আমার মত যাদের বাংলাদেশে জন্ম এবং ভাগ্যের সন্ধানে উন্নত বিশ্বের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিচ্ছে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন। প্রথমত, জাতি হিসাবে আমরা কি আলজাইমার রোগে রোগাক্রান্ত হয়ে গেছি? তা না হলে যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ডানার নীচে দেশের পুঁজিবাজার হতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেল, মন্ত্রী সুরঞ্জিত টাকার বস্তা সহ ধরা পরল, তাদেরই তত্ত্ববধানে বিলিয়ন ডলারের সেতু হবে আর দুর্নীতি হবেনা তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি? বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই চুরি। কথাটা অবিশ্বাস করলে পাঠকদের নিজ নিজ এলাকার মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ, পৌরসভার চেয়ারম্যান, কমিশনার, ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি সহ তাবৎ নেতা, উপ নেতা, পাতি নেতাদের চেহারার দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। তিন বছর আগে তাদের পকেটের চেহারা কি একই রকম ছিল? এই কি সে সাজেদা চৌধুরী নন যিনি গায়ে বনমন্ত্রীর লেবাস লাগিয়ে বদলি বাণিজ্য ও স্বীয় পুত্রকে দিয়ে বন বাদর উজার করে পকেট পূর্তি করেছিলেন? শুধু একবেলা কেন এক বছর বাজার না করলেও এই মহীয়সীর পেট আর পকেটের কোথাও সামান্যতম টান পরবে বলে মনে হয়না। সুরঞ্জিত বাবু ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাত দেখিয়ে চেতনার গোপন গলিতে সুরসুরি দিচ্ছেন। আমরা কি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম এই কালো বিড়ালের কুৎসিত চেহারা? কি উদ্দেশ্যে এসব চোরের দল মোবাইল কলে সারচার্জ বসানোর দাবি জানাচ্ছে বুঝতে কি আমাদের নতুন করে জন্ম নিতে হবে? এটা বাংলাদেশ। দুর্নীতির বিশ্বকাপে পর পর চার বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আমরা। দুর্নীতি এ দেশের জাতীয় সম্পদ, রাজনীতির গৌরবময় অলংকার। এখানে দুর্নীতি হয় হাটে মাঠে ঘাটে, গোসলখানায়, কবরখানায়, হাসপাতালে, সংসদে, উচ্চ আদালতে, মন্দির মসজিদে, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি আর মলমূত্র নিস্কাশনের অলিগলিতে। জাতীয় সংসদের ৩৩০ সদস্য আর মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের কালো সম্পদ একত্রিত করলে পদ্মা সেতুর মত দশ সেতু নির্মাণ সম্ভব, এতটাই শক্তিশালী এ দেশের দুর্নীতির ভিত্তি। চাইলে এক সামিট গ্রুপের পক্ষেই সম্ভব বিশ্বব্যাংককে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে পদ্মার বুকে বিশাল বিশাল সেতু নির্মাণ করা। তার জন্যে দেশের ১৬ কোটি মানুষের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হবে বলে মনে হয়না। সাড়ে তিন বছর এ দেশের মানুষ অনেক দিয়েছে। বিনিময়ে হত্যা, গুম, চাঁদাবাজী, আর ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এখনই উপযুক্ত সময় মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের প্রমাণ করা তারা দেশকে ভালবাসেন, এখনই সময় পুঁজিবাজার লুটপাটের কোটি কোটি টাকা পদ্মার পানিতে ধুয়ে মুছে পবিত্র করা, এখনই সময় মন্ত্রী সাংসদদের অপরিশোধিত বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফোন আর পানির বিল পরিশোধ করে সেতুর ফান্ড স্ফীত করা। কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও যারা রাষ্ট্রের পকেট উজার করছে তাদের পকেট হতে জাতির পাওনা কি আদায় করার সময় হয়নি? বিশ্বব্যাংকের টাকা নিয়ে সেতু করতেই হবে এমন খত আমরা এখনও দেইনি। বিশ্বব্যাংক গ্রামীন ব্যাংক নয় যে ব্যক্তিগত ইগো দিয়ে একে কবর দেয়া যাবে। এই ব্যাংকের গোড়া অনেক বেশি শক্ত, অনেক বেশি ধারালো।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের উপর গোস্বা করে জাতির দ্বারস্থ হয়েছেন চেতনার বানী নিয়ে। এ চেতনা ’৭১এর চেতনা, ’৫২র চেতনা। শুনতে ভাল লাগে, গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়, রক্তে দোলা লাগে। সেতু ইস্যুতে জাতি হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তার আগে প্রধানমন্ত্রীকে জাতির কাছে পরিষ্কার করতে হবে কার বিরুদ্বে কি অভিযোগ ছিল বিশ্বব্যাংকের। তারা বলছে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকায় পদ্মা সেতু হতে সরে যাচ্ছে। কি ছিল সে প্রমাণ জাতির কাছে তা তুলে ধরতে হবে। জাতিই বিচার করবে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ও প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য ছিল কিনা। প্রধানমন্ত্রীকেই প্রমাণ করতে হবে ভাষার ফোয়ারা, চেতনার আবেগ আর অভিযোগের রক্তচক্ষু দেখিয়ে সরকার মারাত্মক কিছু ধামাচাপা দিতে চাইছেন না। আমরা ভীত কারণ প্রধানমন্ত্রীর ডানে বায়ে যাদের বাস তারা পা হতে মাথা পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। দেশের কোটি কোটি খেটে মানুষের পকেটে হাত দেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীকে কনভিন্স করতে হবে কেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ অবিশ্বাস করে সুরঞ্জিত বাবু অথবা সাজেদা চৌধুরীর মত রাষ্ট্রীয় চোরদের মুখের কথা বিশ্বাস করবো।
মন্ত্রী আবুল হোসেন প্রসঙ্গ আসলেই আমার কেন জানি গেসু চোরার কথা মনে পরে যায়। গেসু চোরার তিন স্ত্রীর মত আবুল মন্ত্রীর পালক প্রতিপালকরাও দাবি করছে যেহেতু সেতুর জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থ বিশ্বব্যাংক ছাড় করেনি তাই দুর্নীতির প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে আবুল মন্ত্রী ও তার চেলা চামুন্ডারা গেসু চোরার মত পরনে আন্ডারওয়্যার আর গায়ে তৈলাক্ত মাখন মেখে ব্যাংকে ধর্না দিয়েছিল। এ যাত্রায় কামিয়াভ না হওয়ায় ভেস্তে যায় তার পদ্মা সেতু মিশন। এমন একটা মিশন নিয়ে এক কালের নৌ মন্ত্রী আকবার হোসেনও ধর্ণা দিয়েছিলেন স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ নরওয়েতে। ধর্ণা দেওয়া দেয়িটা আমাদের জন্যে নতুন নয়। দেশের পয়সায় সেতু করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে এ যাত্রায় প্রমাণ করতে হবে আবুল হোসেন পরনে আন্ডারওয়্যার আর গায়ে মাখন লাগিয়ে বিশ্বব্যাংকের দপ্তরে ধর্ণা দিয়েছিলেন চেতনার সুরসুরি দিতে। এবং সে সুরসুরি ছিল জাতিয়াতাবোধের সুরসুরি, মুক্তিযুদ্ধের সুরসুরি, ভাষা আন্দোলনের সুরসুরি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুরসুরি।