যে হারে যোগানদাতার আবির্ভাব ঘটছে তাতে পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার বোধহয় নতুন এক ঝামেলা পাকাতে যাচ্ছে। খবরে প্রকাশ, কেবল আমিরাতের প্রবাসী বাংলাদেশিরাই ৩০০ কোটি ডলার অর্থ সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রায় একই সময় ১০০ কোটি ডলার সমমূল্যের ঋণ নির্দ্দিষ্ট খাত হতে সরিয়ে সেতু খাতে বিনিয়োগ করলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আপত্তি থাকবেনা বলে জানিয়ে দিয়েছে। সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এক দিনের বেতনও একই খাতে জমা হতে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে ঢল নামা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যোগাযোগ মন্ত্রী আবদুল কাদের একধাপ এগিয়ে অন্য কেউ ট্রেন ধরতে দেরি করলে মালয়েশিয়ান বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। চুক্তির ব্যাপারে কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে এবং তাদের প্রস্তাবিত ’মুড অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং' মন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নিচুস্বরে হলেও একই কাতারে চীন, ইউনাইটেড আরব আমিরাত সহ বেশ কটা দেশ শামিল হতে চায় বলে আওয়াজ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ১১ই জুলাই অর্থমন্ত্রণালয় হতে নতুন করে চিঠি দেয়া হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংককে। প্রতিশ্রুত অর্থের চাইতে বেশি অর্থ যোগান দেয়ার অনুরোধটা মুলত অর্থমন্ত্রীর। তিনি বার বার বলছেন নিজেদের ভুল বুঝে একসময় বিশ্বব্যাংকও ফিরে আসবে বিনিয়োগকারীদের কাতারে। ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে; সেতু একটা অথচ বিনিয়োগকারী কাঁড়ি কাঁড়ি। এখানেই প্রশ্ন উঠবে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের (খালেদা জিয়া দ্রষ্টব্য)।
বিনিয়োগকারীর কাফেলা দেখলে মনে হবে বাংলাদেশের জন্যে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগানো এখন হাতের মোয়া। জ্বালাময়ী একটা ভাষন, একটা মোবাইল নাম্বার ও হটমেইল একাউন্টের একটা ই-মেইলই যথেষ্ট এই অংক পদানত করতে। আসলেই কি তাই? সেতুর প্রাক্কলিত মূল্য যা ধরা হচ্ছে তা মুদ্রাস্ফীতির কারণে ৫ বছর পর কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার সম্যক ধারণা নিতে প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ হবে দুয়েকজন দেশীয় ঠিকাদারের সাথে কথা বলা, যারা দেশের আনাচে কানাচে কাজ করে জীবন ধারণ করছে। এ প্রসঙ্গে অনেকদিন আগের একটা ঘটনা না বললেই নয়। অফিসের কাজে নঁওগা হতে বগুড়া হয়ে ঢাকা ফিরছি। পথে দেখা হল জাতীয়তাবাদীদের বিশাল গণজমায়েতের। মাইলের পর মাইল রাস্তা আটকে অপেক্ষা করছে প্রিয় নেতা তারেক জিয়ার আগমনের। একটু পর পর হরেক রকম তোরণ আর হাজার রকম বাহারী ফেষ্টুন। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে শুরু করে জেলা কমিশনারের শুভেচ্ছা বার্তা পর্যন্ত শোভা পাচ্ছে আকাশে বাতাসে। খুব আগ্রহ নিয়ে ফেষ্টুনের ভাষা পড়ছি আর মনে মনে সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছি কোত্থেকে আসে এসব আবেগ। পাশে বসা সহযাত্রীর কাছে প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই এ নিয়ে বেশকিছু চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরলেন তিনি। একেক জনের শুভেচ্ছা বাণীর পেছনে উদ্দেশ্য ও বিধেয় কি তার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। কারও দরকার দলীয় মনোনয়ন, কারও পদ, কারও আবার প্রমোশন, ঠিকাদারদের দরকার বড় ব্যবসা, ব্যবসায়ীর প্রয়োজন মুনাফার অবাধ লাইসেন্স আর সরকারী কর্মকর্তাদের প্রয়োজন পদোন্নতি, এসব চাওয়া পাওয়ার প্রকাশ্য ডিসপ্লের অপর নামই নাকি এই তোরণ ফেস্টুন খেলা। দিন শেষে কার পকেট কতটা ভারী হয়েছিল তার খবর পাইনি, কিন্তু এটুকু বুঝেছি বাঁচতে গেলে আমাদের দেশে এসবের বিশেষ কোন বিকল্প নেই। একই কায়দায় পদ্মা সেতু নিয়েও শুরু হয়েছে প্রচার আর বাণীর জোয়ার। যারা আজ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাঠ গরম করছে তাদের সবাই দলীয় আউলিয়া। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে তারা যে অথিতি পাখির মত সাইবেরিয়া ফিরে যাবেন না তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাত আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যারা ৩ বিলিয়ন ডলার ম্যান সাজার চেষ্টা করছেন তারা বোধহয় ভুলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বিশ্বসমাজের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ভারতীয় সেনা আর রুশ অস্ত্রের সাথে আমাদের তীব্র আকাঙ্খার সমন্ব্বয় হয়েছিল বলেই দেশ হতে পাকিস্তানীদের বিদায় করা গিয়েছিল। বাস্তবতা এড়িয়ে চাটুকারীতায় যারা পদ্মাসেতু গড়তে চাইছেন তাদের উচিৎ হবে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষমতা নিয়ে আরও একটু পড়াশুনা করা। উন্নত বিশ্বের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে গ্লোবাল অর্থনীতির দুনিয়ায় টিকে থাকার চেষ্টা এক কথায় আত্মঘাতী। তার সাথে দুর্নীতি নামক ন্যাশনাল কলেরা যোগা করা গেলে পদ্মা সেতুর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও আঁচ করা সম্ভব।
দুর্নীতিতে পরপর চারবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আমরা। এখানে সরকার প্রধান হতে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের কেরানী পর্যন্ত কারা দুর্নীতিগ্রস্ত নয় তাদের খুঁজে পেতে দরকার হয় শক্তিশালী দূরবীনের। এমন একটা দেশের একজন মন্ত্রীর নামে কমিশন দাবির অভিযোগ উঠতেই গর্জে উঠলেন সরকার প্রধান। তদন্ত দুরে থাক উলটো অভিযোগকারীদের ধমক দেয়া শুরু করলেন। অভিযোগ নাকি অপমান, তাই অপমানের বদলা নিতে নিজ হাতে পদ্মা সেতুর পাথর সুরকি বসানোর আওয়াজ তুলেছেন। এ আওয়াজের সাথে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকে গলা মেলাচ্ছে দলীয় উজির নাজির আর কোতয়ালের দল। অসময়ের এসব অলীক কথাবার্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আর যাই হোক একটা কাজ সফল ভাবে বাস্তবায়ন করেছেন, ব্যর্থতার ধামা চাপা। সাগর-রুনী হত্যা, ইলিয়াস আলী গুম, সৌদি কূটনীতিবিদ হত্যা, সুরঞ্জিত বাবুর ৭০ লাখ, নদী নালা খাল বিলে বেওয়ারিশ লাশের মিছিল, ছাত্রলীগের দলন মথন, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। দেখার বিষয় পদ্মাসেতু নামের শূন্য কলস বাজিয়ে সরকার কতদিন জাতিকে এ নেশায় ব্যাস্ত রাখতে পারে। পদ্মাসেতু শেষপর্যন্ত বিশ্বব্যাংকই বানাবে, আর কেউ না হোক সরকারের অর্থমন্ত্রী তা ভাল করে জানেন। আর এ জন্যেই তিনি গোপনে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছেন ইজ্জত বাজি রেখে।