আগারগাঁও তালতলা বাজারে মুদি দোকানের মালিক ছিলেন তিনি। মালিক বললে হয়ত কিছুটা বাড়িয়ে বলা হবে, ব্যবসাটা ছিল আসলে বাবার, সন্তান হিসাবে সাথে থাকতেন কেবল। দোকানের আয় রোজগার ভাল না হওয়ায় এক সময় মাসিক ৩০০০ টাকা বেতনে চাকরি নিতে বাধ্য হন। তাও আবার গার্মেন্টসে, যেখানে চাকরির বাজার সংরক্ষিত মুলত মহিলাদের জন্যে। নিদারুণ কষ্টের ভেতর এভাবেই সংসারের হাল ধরেন এবং আর দশটা স্বদেশির মত চালাতে থাকেন জীবন যুদ্ধ। একজন খেটে খাওয়া বাংলাদেশির এ অতি পরিচিত কাহিনী। এ নিয়ে গল্প, উপন্যাস অথবা রাজনৈতিক লেখালেখির কোন প্রেক্ষাপট নেই। অতিরিক্ত কটা বিয়ে, ফুঁসলিয়ে ফাসলিয়ে দু একজন মহিলা সহকর্মী ধর্ষন অথবা খুন, গার্মেন্টস শিল্পে একজন পুরুষ কর্মীর উল্লেখ করার মত ঘটনা বলতে আমরা এসবই বুঝে থাকি। কিন্তু তানভির মাহমুদের বেলায় ব্যাপারটা অন্যরকম। দশ বছর আগের গার্মেন্টস কর্মী তানভীর আজ ১০০০ কোটি টাকার মালিক (নিজে দাবি করছেন ৫০ হাজার কোটি)। ভবিষ্যত ৪৭ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক দুদকে হাজিরা দিতেও ব্যবহার করেন নাম্বার প্লেটবিহীন পাজেরো ভিসিক্স গাড়ি। বিভিন্ন ক্যাটাগরির ২৭ টা গাড়ি নিয়ে মিরপুরের শ্যাওড়াপাড়ায় চোখ ধাঁধানো আলিশান বাড়িতে বাস করেন এবং রাস্তায় বের হন সামনে পিছে গাড়ির বহর ও সশস্ত্র গার্ড নিয়ে। রূপকথার কল্পলোকের মত উত্থান ঘটছিল এই অতিমানবের। তরতর করে অতিক্রম করছিলেন উচ্চতার সবকটা শিখর। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার কোন এক আসনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখার পর্বও সেরে নিচ্ছিলেন বিনা বাঁধায়। কিন্তু পাপড়ি বিছানো ফুলেল পথে কাটা লুকিয়ে থাকতে পারে তা বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করেননি মাহমুদ সাহেব। সবই ছিল এবং সবাই ছিল সাথে। একদিকে সরকারী ব্যাংক, পাশপাশি সরকার প্রধানের ডানহাত একজন উপদেষ্টা। ৪৭টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মচারীদের নামে বেনামে ৩৫০০ কোটি টাকা লোন দেখিয়ে তার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ভূয়া এলসির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে নিয়েছেন ইতিমধ্যে।
মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করার কাজে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জনাব মোদাচ্ছের আলী বিশেষ অভিজ্ঞ। তত্ত্বাবধায়ক আমলে নেত্রীর মনোরঞ্জনের জন্যে কাজটা তিনি হরহামেশাই করেছিলেন। জরুরি ভিত্তিতে চোখ, কানের চিকিৎসা না করালে প্রিয় নেত্রী কালা ও আন্ধা হয়ে যাবেন, এমন সব মিথ্যা প্রেসক্রিপশন দিয়ে নেত্রীকে জেল হতে বের করে আনার কাজ অনেকটাই সহজ দিয়েছিলেন তিনি। বিনিময়ে পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন মন্ত্রীর সমমর্যাদার উপদেষ্টা পদ। ক্ষমতার রং মহলে একটা উপকথা চালু আছে, মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের নিয়োগ যদি মন্ত্রনালয়ের কাজের জন্যে হয়ে থাকে, উপদেষ্টাদের নিয়োগ নাকি মুলত প্রধানমন্ত্রীর পরিবারিক কাজের জন্যে। এইচ টি ইমাম, মসিউর ও মোদাচ্ছের সহ এই টিমের বাকি সবাই কাজটা খুব ভাল ভাবে করে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় মোদাচ্ছের আলীকে উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কিনা কারও জানা নেই। তবে এই উপদেষ্টাকে প্রায়ই দেখা যেত ব্যাংকের এই শাখায়। শোনা যায় হলমার্ক গ্রুপের ৩৫০০ কোটি লোন পাওয়ার মূল ভূমিকায় ছিলেন তিনি। গ্রুপের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও হাজির থাকতেন। অবশ্য উপদেষ্টা নিজে বলছেন অন্য কথা। নিজস্ব নির্বাচনী এলাকার একজন মহিলা কর্মকর্তার সাথে দেখা করার জন্যেই নাকি ব্যাংকে যেতেন। আগ বাড়িয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও যে উপদেষ্টার দেখা পাওয়া দুস্কর, একই উপদেষ্টা একজন মহিলার সাথে দেখা করার জন্যে নিজে একটা ব্যংকে যেতেন এর সত্যতা আশাকরি উপদেষ্টার স্ত্রী অথবা পরিবারের বাকি সদস্যরা যাচাই করে দেখবেন। প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া না গেলে উপদেষ্টার চরিত্র নিয়ে কথা উঠতে পারে। আমরা যারা হাভাতে বাংলাদেশি তাদের সাথে মোদাচ্ছেরদের নতুন করে পরিচয় দেয়ার কিছু নেই। আমার মত লাখ লাখ স্বদেশির চোখে এরা শ্রেফ লুটেরা। কথার মারপ্যাঁচে দলীয় উচ্ছিষ্টভোগীদের মোহগ্রস্ত করা সম্ভব হলেও এসব রাষ্ট্রীয় লুটেরাদের পরিচয় কোনভাবেই ঢেকে রাখা যাচ্ছেনা যেন। এদের একজনকে নিয়ে বাদ সেধেছে বিশ্বব্যাংক। অন্য একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি বিদ্যুৎ খাতের ’আয়-রোজগারের’ গায়ে ডানা বসিয়ে তা সাত-সমুদ্র তের নদী পাড়ি জমানোর ব্যবস্থা করেন। মোদাচ্ছের সাহেব হলমার্ক গ্রুপ কত হিস্যা পেয়েছেন তার সংখ্যা জানতে আমাদের বোধহয় আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী পাশে থাকলে মন্ত্রী এমপিদের অনেকের মগজ নাকি মাথায় থাকেনা। গুম কৃত বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলিকে নিয়ে প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের মন্তব্য এ ব্যাপারে বিশেষ উদাহরণ হয়ে থাকবে। নির্বাচন যত সামনে আসবে মন্ত্রী, এমপিদের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর মনোরঞ্জন ততটাই জরুরি হয়ে পরবে। নেত্রী খুশি থাকলেই কেবল দলীয় মনোনয়ন, মন্ত্রিত্ব আর পাশাপাশি সরকারী খাজাঞ্জিখানা উজার করার সিসিম ফাঁক মন্ত্র। দলীয় উচ্ছিষ্টখোরদের ভাল করেই জানা থাকে নেত্রী সন্তুষ্টির নাড়িনক্ষত্র। গ্রামীন ব্যাংক ও ডক্টর মোহম্মদ ইউনুস তেমনি দুটি বিষয় যার উপর ঢালাও সমালোচনা নিশ্চিত করতে পারে দলীয় মনোনয়ন। ডক্টর মো ইউনুস ও গ্রামীন ব্যাংক ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে গেলে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছে উন্নত বিশ্ব। সম্পর্কের সোনালী দিনে ছেলে ও মেয়েকে দেখতে ঘন ঘন আমেরিকায় যেতেন তিনি। ফ্লোরিডায় নিজস্ব মিনি কার্যালয় পর্যন্ত খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন এক সময়। সে সময় এখন সোনালী অতীত। যুক্তরাষ্ট্রের মত পৃথিবীর অনেক দেশের সরকারের কাছে ব্যক্তি শেখ হাসিনা এখন বর্জিত, পরিত্যাক্ত, অনাকাঙ্খিত। গ্রামীন ব্যাংক ও ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে হেস্তনেস্ত হতে হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন ফোরামে। মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ ও এমপি আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ভাল জানা আছে প্রধানমন্ত্রীর এই দুর্বল অংশ। দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যে এই দুজনের অবস্থান অনেকটাই নাকি নড়বড়ে। জনসংযোগে ধ্বস সহ লুটপাটের অভিযোগ আছে দুজনের বিরুদ্ধে। এমন এক প্রেক্ষাপটে কেবল নেত্রীর মনোরঞ্জন নিশ্চিত করতে পারে আগামী ৫ বছরের সোনালী ভবিষ্যত। তাই সংসদে পাওয়া সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে ভুল করলেন না দুজনেই। প্রধানমন্ত্রীকে পাশে পেয়ে গ্রামীন ব্যাংক ইস্যুতে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পরলেন অর্থমন্ত্রীর উপর। গ্রামীন ব্যাংকের ৩% মালিকানা নিয়ে বাকি ৯৭%’এর মালিকদের উপর কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার অধ্যাদেশ জারী করেছে সরকার। এই অধ্যাদেশের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা ইতিমধ্যে কেন বাস্তবায়িত হয়নি তার জন্যে অর্থমন্ত্রীকে তীব্র ভাষায় নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছেন আশরাফ মন্ত্রী ও লতিফ এমপি। অর্থমন্ত্রী মাল মুহিত ক্ষোভের সাথে প্রকাশ করলেন কিছু কঠিন বাস্তবতা। তিনি জানালেন, ইউনুস ইস্যুতে গোটা দুনিয়া বাংলাদেশকে একঘরে করে ফেলেছে, বলতে গেলে আমরা এখন দ্বীপে বাস করছি। অর্থমন্ত্রীর মুখে বেফাস সত্যকথা বন্ধ করার প্রয়াসে প্রধানমন্ত্রী গর্বের সাথে জানালেন, আমরা স্বাধীন দেশ, আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে।
আসলেই কি আমরা স্বাধীন? প্রধানমন্ত্রী সহ দেশীয় রাজনীতির বাকি খেলোয়াড়দের বিচারে স্বাধীনতার সংজ্ঞা কি ৪১ বছরেও আমরা জানতে পারিনি। ব্যক্তি ও পরিবার পূজার পসার সাজিয়ে ভক্তি করার ফাঁদ পাতার অপর নাম যদি স্বাধীনতা হয় নিশ্চয় আমরা স্বাধীন। ৪১ বছর ধরে ১৬ কোটি মানুষের প্রায় সবাইকে আটকানো গেছে এ ফাঁদে। চাইলে এ নিয়ে গর্ব করতে পারেন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদগণ। সোনালী ব্যাংকের ৩৫০০ কোটি, ডেসটিনির হাজার হাজার কোটি, কালো বিড়ালের ৭০ লাখ, আবুল হোসেন আর মসিউরদের কোটি কোটি, নেত্রীদের বগল তলায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের নিশ্চয়তার জন্যেই বোধহয় আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। বাংলাদেশে ব্যাংক থাকবে আর তা হতে রাজনীতিবিদগণ লুটতে পারবে না, এর নাম নিশ্চয় ব্যাংক নয়? স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী এসব ব্যাংক ও ব্যাংকারদের জন্যে নিশ্চয় বাংলাদেশ নয়? ব্যাংক হবে তানভীর মাহমুদের জন্যে, সেতু হবে আবুল হোসেনের জন্যে, রেল হবে কালো বিড়ালের জন্যে, দল হবে পরিবারের জন্যে, দেশ হবে নেতার জন্যে, তবেই না স্বাধীনতা, তবেই না মুক্তিযুদ্ধ, তবেই না বাংলাদেশ! ৮৬ লাখ গ্রাহক আর বিলিয়ন টাকা পুঁজি নিয়ে ইউনুস মাষ্টার ৪১ বছরের বাস্তবতা মিথ্যা প্রমাণ করবেন, এমনটা মেনে নেয়া হবে রাজাকারের খাতায় নাম লেখানোর শামিল। আমরা নিশ্চয় সে পথে হাটতে যাবো না?