’ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ ছবিটা দেখিনি, দেখার ইচ্ছাও হয়নি। সপ্তাহান্তটা কাটাচ্ছি স্পেইস শাটল 'এন্ডোবারের' শেষ জার্নির উপর নজর রেখে। অবাক করা দৃশ্য, বোয়িং ৭৪৭’এর পিঠে চড়ে স্পেস শাটল শেষ বারের মত আকাশে উড়ছে। গন্তব্য ফ্লোরিডা হতে ক্যালিফোর্নিয়া। ১৯৯২ সালে পূর্বসূরি ’চ্যালেঞ্জারের’ রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে এন্ডোবারের জন্ম দেয় নাসার বৈজ্ঞানিকেরা। তারপর বেশ কবার দানবীয় গতিতে উড়ে গেছে মহাশূন্যে। মানব জীবনের হাজার রকমের রহস্য নিরসনে বৈজ্ঞানিকদের সাথে হাতে হাত রেখে কাজ করে গেছে এন্ডোবার মিশন। সন্দেহ নেই এসব গবেষণার ফল ভোগ করছে আজকের মানব সভ্যতা। ৯২ হতে ২০১১, ক্যালেন্ডারের হিসাবে ১৮ বছর। স্পেস ব্যারোমিটারে এ আয়ু রিটায়ারমেন্টের জন্যে যথেষ্ট। তাই এন্ডোবারকে পাঠানো হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সাইনস মিউজিয়ামে। ৩০ কোটি মানুষের দেশ আমেরিকা। হরেক রকম মানুষের বাস এখানে। পৃথিবীর বিভিন্ন কোনা হতে পৃথিবীর এ অংশে মানুষ পাড়ি জমায় বিভিন্ন কারণে। স্বৈরশাসকদের রোষানল হতে শুরু করে দরিদ্র, ক্ষুধা আর যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোন দেশের মানুষই বাদ যায়না। মার্কিনিরা দুয়ার খুলে সবাইকে বুকে জড়িয়ে নেয় এমনটা নয়, কিন্তু এরা কখনোই দরজা বন্ধ করেনা। খোলা দরজা দিয়ে অনেকের মত আমরা বাংলাদেশিরাও ভীড় করছি এ দেশে, এবং ভাগ্য গড়ার সুযোগ নিচ্ছি। চারিত্রিক বিচারে আমাদের সবাইকে কি একই পাল্লায় দাঁড় করানো যাবে? নিশ্চয় না। বৈজ্ঞানিক হতে শুরু করে প্রফেশনাল চোরের খাতায় পর্যন্ত নাম আছে আমাদের। একই কথা বলা যায় বাকি পৃথিবীর বেলায়। ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ছবি ’ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ তেমনি এক ছবি যা তৈরীর পিছনে হাত ছিল মধ্যপ্রাচ্য হতে আসা কজন ইহুদি অথবা খ্রিষ্টানের। এবার দেখা যাক কেন এবং কাদের স্বার্থে তৈরী হয় এসব ছবি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন এর জন্মস্থান।
মানুষ হিসাবে মুসলমান পরিচয়কে যদি আমরা বাকি পরিচয়ের উর্ধ্বে রাখতে চাই তাহলে বিবেচনার দাবি রাখে ৯/১১ কতটা উপকার করেছিল আমাদের। জেহাদি মনোভাব নিয়ে যারা যুক্তরাষ্ট্রকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে অভ্যস্ত তাদের জন্যে ৯/১১ ছিল নিশ্চয় এক ধরণের সন্তুষ্টি। সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে এ নিয়ে আনন্দ করতেও দেখা গেছে অনেককে, যেমনটা করেছিলেন তোরা বোরার গুহায় বসে খোদ ওসামা বিন লাদেন। মুসলমানদের সাথে ইহুদিদের বৈরিতা মুলত প্যালেস্টাইন ইস্যু নিয়ে। নিকট অতীতে এই ইস্যুতে পশ্চিমা ইউরোপ ছিল প্যালেস্টাইনিদের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থক। এর প্রতিফলন দেখা যেত এ প্রশ্নে জাতিসংঘের উভয় কক্ষের ভোটাভুটিতে। আটলান্টিকের ওপারের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে প্যালেস্টাইনিদের ন্যায্য দাবীর প্রতি সমর্থন দিতে ইউরোপ কখনোই কার্পণ্য করেনি। এর মূলে ছিল মহাদেশের জনসমর্থন। কিন্তু এর সবটাই বদলে দেয় ৯/১১, লন্ডন ও মাদ্রিদের ঘটনা সমূহ। বাকি বিশ্বের মত আধূনিক ইউরোপিয়ানদের কাছেও মুসলমানদের পরিচয় সন্ত্রাসী হিসাবে। বিতর্কিত এসব ঘটনায় লাভবান হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ভিলেন ইসরাইল। দেশে দেশে তাদের বন্ধু বাড়ছে, বাড়ছে তাদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতি শর্তহীন সহানুভূতি। হয়ত লাভ-ক্ষতির হিসাবে মিলাতে গিয়ে মুসলমানদের অনেকেই বিশ্বাস করছে আল-কায়েদা নয়, বরং ৯/১১ ঘটিয়েছিল ইহুদী রাষ্ট্রের দোসর মার্কিন সরকার। এ ধরণের হাইপো থিসিসের কতটা ভিত্তি আছে তার স্বপক্ষে মুসলমানরা কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, আর তা হল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে সরে গেছে প্যালেস্টাইন ইস্যু। স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের বাস্তবতা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে ঠাঁই নিচ্ছে স্বপ্নলোকে। আর এর আসল কারণ ৯/১১। মারল মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গী মুসলমানরা, মরল সাধারণ মার্কিনিরা আর মাঝখানে লাভবান হল দূরের দেশ ইসরাইলের আগ্রাসী ইহুদিরা। একই এনালগ কি ’ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নিয়েও টানা যায়না? ইহুদিদের জানা আছে ধর্ম নিয়ে খোঁচা দিলে মুসলমানরা কতটা হিংস্র হতে পারে। তারা এও জানে এসব হিংস্রতার নীচে চাপা পরে যাবে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ন্যায্য দাবী। ক্যালিফোর্নিয়ার যে কজন ইহুদী ছবিটা তৈরী করেছে তাদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলমানদের গায়ে সন্ত্রাসীর ছাপ লাগানো। এ বিবেচনায় শতকরা একশ ভাগ সফল তারা। এ মুহূর্তে একবিংশ শতাব্দি অবাক হয়ে দেখছে ধর্মের নামে মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিক অর্থে একটি ধর্মণিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে ধর্ম চর্চার যেমন স্বাধীনতা আছে তেমনি আছে এর সমালোচনার স্বাধীনতা। বাক ও ধর্ম চর্চার এ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আছে দেশটার শাসনতন্ত্রে। এ দেশে ইসলাম চর্চায় যেমন বাঁধা নেই তেমনি বাঁধা নেই এর অবমাননায়। দেশটার শাসন ব্যবস্থায় এমন কোন কাঠামো নেই যার উপর ভিত্তি করে ধর্ম অবমাননাকারীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে। তা করতে গেলে দেশের শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আনতে হবে। টেরী জোনসের মত উগ্র ইসলাম বিদ্বেষীকে মার্কিন সরকার কখনোই নিয়ন্ত্রণ করতে যাবেনা যতক্ষণ না সে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে যাচ্ছে। একই কথা বলা যাবে ’ইনোসেন্স অব ইসলাম’ তৈরীর পেছনে যারা জড়িত তাদের বেলায়। তাদের ভাল করেই জানা আছে মার্কিন আইন ও আইনের প্রতি দেশটার দায়বদ্ধতার কথা। এবং সে জন্যেই স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ন্যায় সঙ্গত দাবিকে যারা কবর দিতে চায় হিসাব কষেই বেছে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল একদল উন্মাদ ধর্ম বিদ্বেষীদের বাস নয়, এখানে নভোচারীদেরও বাস, যারা চ্যালেঞ্জার আর এন্ডোবার নিয়ে সত্যের সন্ধানে মহাশূন্যে পাড়ি জমায়। যার ফসল আমরা সবাই ঘরে তুলি।
আধুনিক বিশ্ব ধর্ম পরিচয়ে বিভক্ত নয়। যদি তাই হত তাহলে আমরা পাকিস্তান হতে বেরিয়ে আসতাম না। আরব হয়েও মধ্যপ্রাচ্যে এত গুলো দেশে বিভক্ত থাকত না মুসলমানরা। আমরা বিভক্ত হই আমাদের ভৌগলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে। ধর্ম এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেনা। দূরের দেশ আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার কজন ইহুদী মিলে যে প্রকল্প চালু করেছে তার কারণও রাজনৈতিক। দেশে দেশে হিংসা সংঘাত ছড়িয়ে দিয়ে নিজদের অপকর্ম ঢাকার নীলনকশা বাস্তবায়ন করার কৌশল হিসাবে ছেড়ে দিয়েছে ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারী বাজারি ছবি। এবং আমরা শান্তির ধর্মের দাবীদার মুসলমানরা মধ্যযুগীয় কায়দায় ধরা দিচ্ছি এ ফাঁদে। ধর্ম থাকলে এর সমালোচনাও থাকবে, থাকবে সমালোচনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্মগত অধিকার। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বব্যবস্থায় মুসলমান হিসাবে আমরা যা করছি তা প্রতিবাদের ভাষা হতে পারেনা, এ স্রেফ আত্মহত্যা।
ধর্মীয় উন্মাদনা সভ্যতাকে কোথায় নিয়ে যায় তার নমুনা কি আমরা ৭১ সালে পাইনি? প্রিয় নবীর অবমাননা নিয়ে যারা রাজপথ প্রকম্পিত করছেন তাদের অনেকের হাতে কি নবীর উম্মত হত্যার রক্ত নেই? নবী অবমাননার ঘোলা পানিতে খুনিদের মাছ শিকার করতে দিলে প্রকারান্তে তাদের হাতকেই শক্তিশালী করা হবে। এবং এ হাত যে আবার খুনির হাত হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেনা তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?