অনেকটা নীরবেই চলে গেলেন ভাষা সৈনিক অলি আহাদ। মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করেছিলেন কেউ তাকে দেখতে আসেনা বলে। বয়স ও অসুখ নামের মরণব্যাধিতে অনেকদিন ধরেই ভুগছিলেন এবং তৈরী হচ্ছিলেন শেষ দিনটার জন্যে। কারও চলে যাওয়া নিয়ে ঘন্টা বাজানোর সাংস্কৃতির সাথে আমি একমত নই। আমার চোখে মৃত্যু মানে চিরশান্তি। এ পথে যাত্রার শুরুটাও হওয়া উচিৎ শান্তিময়। বেচে থাকার লড়াই পর্বে যারা সাথী হননি মৃত্যুর পর ফটো সেশনের জন্যে লাশের পাশে তাদের আনাগোনা প্রশ্নের জন্ম দিত। ধন্যবাদ দেশের মেইনস্ট্রিম পলিটিশিয়ানদের। মৃতকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ঝটিকা সফর এবং তা নিয়ে মিডিয়ার অতি উৎসাহ অনেক সময় বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। যেমন যায় ক্রিকেটের বিজয়ে খোদ ক্রিকেটারদের ছাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের অভিনন্দন বাণী। অবশ্য জনাব অলি আহাদের রাজনৈতিক পথ যদি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে মূল ধারার সাথে মিশে যেত হয়ত টেলিভিশন সহ মিডিয়ায় রাজত্ব করত পরিচিত কতগুলো মুখ। সরকারের সবোর্চ্চ পর্যায় হতে জনাব আহাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে কিনা জানিনা, তবে মৃতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত কোন কটু মন্তব্য করেননি, এটাকে স্বীকৃতি হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি নেই। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকেও।
খটকা যে এক জায়গায় লাগেনি তা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব আরেফিন সহ সম মানসিকতার বেশ কজন প্রশ্ন তুলেছেন শহীদ মিনারে মৃত ব্যক্তির জানাজা নিয়ে। তাতে নাকি মিনারের অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে। এসব ’গুনি জনদের’ বিবেচনায় অসাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা কি তা পাঠকদের বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। এরা কারা এবং এসব মন্তব্যের গোড়া কোথায় তা আমাদের সবার জানা। শহীদ মিনারের পাদদেশে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে লাশ দাফনের পৌরহিত্য করার সুযোগ দিলে মহামান্যগন একই গন্ধ পেতেন কিনা জানতে ইচ্ছে করে। ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের সন্মান ও শ্রদ্ধার জন্যেই শহীদ মিনার। জনাব অলি আহাদ ছিলেন সে আন্দোলনের পথিকৃৎ। এমন একজন সৈনিকের শেষ বিদায় শহীদ মিনারের পাদদেশ হতে শুরু না হলে তা খোদ মিনারের উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করত। আরেফিন সাহেবরা হয়ত ভুলে যান মানুষ মরণশীল এবং তার বিদায় পর্বে ধর্মের স্থান সবকিছুর উর্ধ্বে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইহুদি, কোন ধর্মই এর ব্যতিক্রম নয়। আরেফিন সাহেবেদের মত থিঙ্কট্যাঙ্কের মগজ হতে জানাযার বিকল্প বিধান বের হওয়া ও তা আইনে পরিনত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দেশের কোটি কোটি মানুষ জানাযা পড়তে থাকবে। তাতে দেশের এক ইঞ্চি মাটি সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট হবে এমনটা ভাবা হবে ঘোরতর অন্যায়। বরং এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্যই বুনতে পারে নতুন রামু বীজ। আরেফিন সাহেবদের এদিকটাও খেয়াল রাখা উচিৎ। বাংলাদেশের ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকা জানাযার জন্যে উন্মুক্ত, আইন করে কোথাও তা নিষিদ্ধ করা হয়নি। শহীদ মিনারও এর বাইরে নয়। এই সেই শহীদ মিনার যার পাদদেশে হত্যা, ধর্ষণ, বলাৎকার আর চর দখলের মত দখল নিয়ে রক্তারক্তি অলিখিত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এসব কাজে আরেফিন সাহেব এবং উনার সৈনিকদের ভূমিকা কি তা নতুন করে বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই।
ফরিদপুরের নুরু রাজাকার ও তার সন্তান মোশারফকে নিয়ে একটা সংবাদ বেরিয়েছে আজকের একটা দৈনিকে। এ নিয়ে মন্তব্য অথবা নতুন কিছু সংযোজন করতে যাচ্ছি না। তবে সামনে সরকার পরিবর্তন হলে তাদের কাছে একটা দাবি থাকবে, ফরিদপুর অথবা বাংলাদেশের যেখানেই নুরু রাজাকারের নামে রাস্তাঘাটের নামকরণ করা হয়েছে তা পালটে অলি আহাদের নামে রাখা হোক।