সান্তা ফে হতে আলবুকেরকে ১০৮ কিলোমিটারের পথ। হাইওয়ে ধরে ৫০ মিনিটে অতিক্রম করা যায় এ দুরত্ব। বিকেল গড়াতেই এক ধরণের চাপা তাগাদা চেপে বসল অফিস পাড়ায়। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরতে হবে। নির্ধারিত সময়ের বেশকিছুটা আগে কাজ গুটিয়ে আমিও মিশে গেলাম যানবাহনের অখন্ড মিছিলে। গন্তব্য আলবুকেরকে। চাকরি উপলক্ষে প্রতিদিন দুবার করে এ পথ পাড়ি দিতে হয়। ফেরার পথে ক্লান্ত, শ্রান্ত আর বিধ্বস্ত হয়ে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত দিতে গা নেতিয়ে আসে। কিন্তু আজ তেমন কিছু শরীরকে শাসন করতে পারল না। অনেকটা তেজী ঘোড়ার মত চেপে বসলাম গাড়ির অ্যাকসেলেটরের উপর। ৭টার আগে যে করে হোক বাসায় পৌঁছতে হবে। প্রেসিডেন্টশিয়াল বিতর্ক নিয়ে এমন আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিরল এবং এক কথায় নজিরবিহীন। আগের দুটি বিতর্ক দেশটার প্রায় ৬ কোটি ভোটার নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং নিরপেক্ষ অনেকে সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তা নিয়ে ফেলেছে। ব্যক্তিগতভাবে নেয়ার মত কোন সিদ্ধান্ত অবশিষ্ট ছিলনা আমার হাতে। আগাম ভোটের সুযোগ নিয়ে পছন্দের প্রার্থীর বাক্সে ব্যালট পেপার ঠুকে দিয়েছি ইতিমধ্যে। বলাই বাহুল্য এ তালিকায় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নাম ছিল সবার উপরে। কিন্তু তাই বলে প্রার্থীদের বক্তব্য শোনার আগ্রহে ভাটা লেগেছে তেমন নয়। বিতর্ক বিতর্কই। আর তা যদি হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টশিয়াল বিতর্ক। তীক্ষ্ণ যুক্তির বিপরীতে পালটা যুক্তি, তথ্য বহুল জোড়ালো বক্তব্য ও তা খণ্ডনে শানিত আক্রমন, সবকিছু মিলিয়ে ৯০ মিনিটের অনুষ্ঠানটায় এমন কিছু থাকে যার সাথে নিবিড় ভাবে মিশতে পারলে কেবল গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাই বাড়েনা, বরং প্রার্থীদের যোগ্যতাকেও দাড় করানো যায় পছন্দের দাড়িপাল্লায়। প্রথম বিতর্কে প্রেসিডিন্ট ওবামার পারফরমেন্স ছিল খুবই হতাশজনক। এমনকি প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান ক্যাম্পও আশা করেনি বাকপটু প্রেসিডেন্টের এমন নেতানো উপস্থিতি। বিতর্ক ব্যর্থতার ফল নির্বাচনী মাঠে প্রতিফলিত হতে ২৪ ঘন্টাও সময় লাগেনি। নেভাদা, ফ্লোরিডা ও পেনসিলভানিয়ার মত নিরপেক্ষ অঙ্গরাজ্য গুলোতে ওবামার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামতে শুরু করে। সপ্তাহখানেকের ভেতর পালটে যায় গোটা নির্বাচনী চিত্র এবং সম্ভাব্য ভোটারদের গ্যালপ পোল প্রার্থী রমনীকে নিয়ে আসে প্রেসিডেন্টের সম পর্যায়ে। অথচ বিতর্কের আগে প্রেসিডেন্টের লীড ছিল চোখে পরার মত। দ্বিতীয় বিতর্কে শক্তভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ঘুরে দাঁড়ান এবং জনপ্রিয়তার যে ধ্বস ওবামা ক্যাম্পকে হতাশ করেছিল তা ঠেকাতে সমর্থ হন। স্বভাবতই ভোটারদের দৃষ্টি ছিল তৃতীয় ও শেষ বিতর্কের দিকে।
বিতর্কের আসরে ওবামার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার জন্যে তিনি মুখিয়ে আছেন। এবং বাস্তবেও হল তাই। ফরেন পলিসিতে প্রার্থী রমনী কতটা অজ্ঞ ও ডিগবাজি খোর তা প্রমাণ করতে প্রেসিডেন্টকে খুব একটা সময় ব্যয় করতে হয়নি। আক্রমনের এক পর্যায়ে রমনী ধরাশায়ী হয়ে প্রেসিডেন্টের প্রায় সব পলিসির সাথে সহমত পোষন করতে বাধ্য হন। পণ্ডিত বিশ্লেষকদের অবাক করে দেয় রিপাবলিকান প্রার্থীর এই সহজ সমর্পণ। গ্যালপ পোলের ফলাফলে প্রতিফলন ঘটে সাফল্য ও ব্যর্থতার। CBS পোলের মতে শতকার ৬৫ ভাগ ভোট পেয়ে বিতর্কে বিজয়ী হয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তবে আমার মতে প্রথম বিতর্কের পরাজয়ের রেশ ওবামাকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তাড়িয়ে নেবে। এর মূল কারণ বিতর্কের বিষয়বস্তু। শতকরা ৭ ভাগের উপর বেকার আর অনিশ্চিত অর্থনীতির গ্যাঁড়াকলে আটকে আমেরিকানদের জীবনযাত্রা নিষ্পেষিত। রিপাবলিকান প্রার্থী রমনী খুবই সফলভাবে এর দায় দায়িত্ব প্রেসিডেন্টের বিগত চার বছরের শাসনের উপর বর্তাতে সক্ষম হয়েছেন। আমেরিকানরাও গিলতে বাধ্য হচ্ছে রমণীর এই দাবি, বিশেষ করে মধ্যবয়স্ক সাদা আমেরিকানরা। অবস্থানের সার্বিক বিচারে প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী বারাক ওবামা ও রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনী বলতে গেলে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং শেষপর্যন্ত কে জিতবেন এ নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করতে পণ্ডিতেরাও হিমশিম খাচ্ছেন। আমেরিকার নীতিহীন অনেক নীতি নিয়ে তর্ক করা যায়, বিশ্ব পরিমণ্ডলে অযাচিত মোড়লিপনা ও অনধিকার চর্চা নিয়ে দেশটাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, কিন্তু যা অস্বীকার করা যায় না তা হল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতি রাজনীতিবিদ ও জনগণের সীমাহীন দায়বদ্ধতা। বিতর্ক ও বিতর্ক উত্তর ডেমোক্রেটদের প্রচার মাধ্যম MSNBC, রিপাবলিকানদের FOX ও নিরপেক্ষ CNN'এর আলোচনা, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ শেষ করে বিছানায় যেতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল।
সকালে ঘুম ভাঙ্গে বাংলা পত্রিকার হেডলাইন পড়ে। আজও এর ব্যতিক্রম হলনা। মধ্যরাত পর্যন্ত দেখা বিতর্কের রেশ না কাটতে সকালে পড়লাম নতুন এক বিতর্কের বিবরণ। ’ঈদ পূজায় নিরাপদে ঘরে ফেরা’ নিয়ে বেসরকারী চ্যানেল আরটিভিতে বিতর্কে নেমেছিলেন বাংলাদেশের দুই রাজনীতিবিদ। ’হাত থাকতে মুখ কেন?’ - দেশীয় রাজনীতির এই সনাতনি ধারাকে মিনি পর্দায় সফলভাবে উপস্থাপন করলেন নৌ মন্ত্রী জনাব শাজাহান খান ও বিএনপি নেতা ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম। বিতর্কের এক পর্যায়ে মন্ত্রী শাজাহান খান চেয়ার ছেড়ে তেড়ে এলেন এবং হুমকি দিলেন ব্যারিষ্টার রফিকের চোখ উপড়ে ফেলার। সদম্ভে ঘোষনা করলেন এসব কাজ তার জন্যে ডালভাত। গণতন্ত্রের এই বহুমুখী চরিত্রের সাথে পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক মানুষ পরিচিত নয় বলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবন অসম্পূর্ণ। মার্কিনিরা তাদের অন্যতম। জাতি হিসাবে চাইলে এ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমার কেন জানি মনে হয় দেশের ক্ষয়িঞ্চু রাজনীতির জন্যে জরুরি ভিত্তিতে একাধিক মাদ্রাসা খোলা প্রয়োজন। যা হবে একান্তই ভোকেশনাল। অনেক মাদ্রাসায় শুনেছি ছাত্রদের হাতে পায়ে শিকল আটকে বশ মানানোর সংস্কৃতি চালু আছে। চোখ উপড়ানোর ডাল ভাতে বেড়ে উঠা একজন শাজাহান খানের রাজনীতির ধারাপাত শুরু হতে পারে এসব মাদ্রাসা হতে। এবং গণতান্ত্রিক চর্চায় অভ্যস্ত করাতে গিয়ে তাদের হাতে পায়ে শিকল লাগাতে হলে অলংকার হিসাবে মেনে নেব এ সাজসজ্জা । আফটার অল কিছু মানুষের চোখ বাঁচানো যাবে তাতে!