৯০ দশকের শুরুর দিকের কথা। অফিসের কাজে রাজশাহী যাচ্ছি। তাও আবার ট্রেনে চেপে। দূরপাল্লার বাস গুলোতে তখন দুর্ঘটনার সুনামী, তাই বিকল্প হিসাবে ট্রেন ধরতে বাধ্য হলাম। এর আগেও দুয়েক বার এ পথ মাড়িয়েছি। উপভোগ করার মত তেমন কিছু নেই। যা আছে তা হল সীমাহীন অনিশ্চয়তা, রাজ্যের বিরক্তি আর ঝাঁপিত জীবনকে দাড়িপাল্লায় দাঁড় করানোর অফুরন্ত সময়। যাত্রার শুরুতেই হোচট। শাজাহানপুর বস্তির পাশে থেমে গেল ট্রেনটা। এমন ভাবে থামল মনে হল যাত্রার এটাই বোধহয় শেষ গন্তব্য। দু'ঘন্টারও উপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। ফেরিওয়ালাদের আনাগোনায়ও ততক্ষণে ভাটা লেগেছে। চরম বিরক্ত হয়ে অপেক্ষা করছি অনিশ্চিত যাত্রার। বাইরের স্লো মোশনের জীবনে সহসা চাঞ্চল্য দেখা দেয়ায় নড়েচড়ে বসল সবাই। বস্তিতে কারা যেন ঝগড়া করছে। প্রথমে নীচু স্বরের গলার আওয়াজ, ধ্বস্তাধ্বস্তি এবং সব শেষে কাগজে কলমে নিষিদ্ধ ভাষার নির্বিচার ব্যবহার। সে ভাষার দুয়েকটা শব্দ এখানে উল্লেখ করতে গেলে ব্লগ কর্তৃপক্ষেরে রোষানলে পরে লেখালেখির অধিকার হারানোর সম্ভাবনা থাকবে, তাই চেপে রাখলাম ভেতরের ইচ্ছাটাকে। স্বামী পেটাচ্ছে স্ত্রীকে, স্ত্রী জবাই হওয়া পশুর মত চীৎকার করছে এবং চেষ্টা করছে পাশে দাঁড়ানো সতীনের টুটি চেপে ধরতে।
পুরানো ঘটনাটা মনে পরল প্রধানমন্ত্রীর ইদানীংকালের কিছু কথাবার্তার কারণে। আশুলিয়া ও বদ্দার হাট শোক এখনো জাতির শিরা উপশিরায়। বিশ্বের সবকটা দেশ ও মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করেছে বাংলাদেশের এই ট্রাজেডি। আমেরিকার মত উন্নত দেশ যারা বাংলাদেশের পোষাক শিল্পের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল তারা শোকের পাশাপাশি প্রশ্ন তুলছে রপ্তানী শিল্পে দেশটার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। বিশ্বের সবচাইতে বড় চেইন ষ্টোর ওয়ালমার্ট ইতিমধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করছে তাদের সহযোগী কোম্পানীর সাথে, যাদের মাধ্যমে আমদানী করত দুর্ঘটনা কবলিত কারখানার পোষাক। সন্দেহ নেই আরও কোম্পানি যোগ দেবে ওয়ালমার্টের মিছিলে। বাংলাদেশের পোষাক শিল্প বলতে গেলে একক ভাবে ডমিনেট করছে বিশ্ববাজার। চীন ও ভারতের নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে দেশ দুটি হতে। এ শিল্পে উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আমেরিকার জন্যে সমস্যা। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের নাম চলে আসে সবার আগে। সম্ভাব্য উন্নতির এমন এক সোনালী সন্ধিক্ষণে আশুলিয়া দুর্ঘটনা ব্যহত করবে আমাদের অগ্রযাত্রা এ ব্যাপারে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এর আলামত পাওয়া যাচ্ছে ওয়ালমার্টের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হতে।
বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে চাইলে সাময়িক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠাটা পোষাক শিল্পের জন্যে খুবই জরুরি। তার জন্যে যাই প্রচার মাধ্যমের সাথে সরকারের সমন্বিত প্রয়াস। কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু কথা বললেন যা গোটা পোষাক শিল্পের জন্যে ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। ইতিমধ্যে বেশ কটা তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং বিশ্ব উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে দুর্ঘটনার আসল কারণ জানার জন্যে। যদিও এর সম্ভাবনা একবারেই শূন্য। কিন্তু সব কমিশনকে পাশ কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রী গঠন করলেন নিজস্ব কমিশন এবং রায় দিলেন দুর্ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে। মুখ ফুটে না বললেও প্রধানমন্ত্রী আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন এ ঘটনা জামাত-বিএনপির ষড়যন্ত্রের ফসল। বলার অপেক্ষা রাখেনা প্রধানমন্ত্রীর এ রায় দ্রুত গতিতে পৌঁছে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন কোনায়। বাংলাদেশি রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রতি সন্মান থাকলে বিদেশি ক্রেতারা বিশ্বাস করতে বাধ্য স্বার্থের জন্যে এ দেশের রাজনীতিবিদরা শিল্প কারখানায় আগুন দেয় এবং পরিকল্পিত ভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারে। প্রধানমন্ত্রী রায় দেয়ার পর একই দেশের দ্বিতীয় রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ক্রেতাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে বাধ্য। পোষাক শিল্পের বিপর্যয় কাটাতে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরণের মন্তব্য মোটেও যে সহায়ক হবেনা তা বলাই বাহুল্য।
অনেকটা শাজাহানপুর বস্তির কায়দায় প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের টুটি চেপে ধরতে চান। এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ যাত্রায় তিনি দেশের পোষাক শিল্পকে বলি দিতেও দ্বিধা করবেন না। আরও একটা ভয়াবহ অভিযোগ করলেন আগের নির্বাচনে ক্ষমতা হারানো নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করলে আমাদের মানতে হবে গ্যাস বিক্রি করেও এ দেশে ক্ষমতা নিশ্চিত করা যায়। তা হলে কি আমাদের মানতে হবে সংসদ নির্বাচনের নামে যে গ্রান্ড শোর আয়োজন করা হয় তার সবটাই ভাওতাবাজি? মার্কিন সুপারিশে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজী না হওয়ার কারণেই নাকি আগের বার ক্ষমতায় যেতে পারেননি। ক্ষমতায় বসে তৃতীয় বিশ্বের অতি দরিদ্র দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন নিকৃষ্ট ও প্রোভোকেটিভ কথা খুবই বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক মেরামতে এ ধরণের বস্তির ভাষা কতটা কাজ করবে সময়ই তা প্রমাণ করবে। একই কারণে ওয়ালমার্টের মত বড় বড় কোম্পানী গুলো যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় ইউনূস গিবত গেয়ে এ যাত্রায় পার পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। আওয়ামী লীগের মত বিশাল একটা দলে এমন একজনও কি নেই যিনি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে পারেন তিনি যা বলছেন তা শ্রেফ বস্তির ভাষা?