৩৮০ কোটি টাকার ১০%, ৩৮ কোটি টাকা। ’যৎ সামান্য’ এই অংকের জন্যেই ফেঁসে গেছে পদ্মাসেতু। এসএনসি-লাভালিন নামের যৌথ কোম্পানী কাজ পাওয়ার জন্যে এমন একটা অংকই ’উপহার’ দিতে চেয়েছিলেন সেতু মালিকদের। অবশ্য বিশ্বব্যাংক বলছে অন্য কথা, ৩৮ কোটি টাকার বিনিময়ে মন্ত্রী আবুল হোসেনের ’গ্যাং অব সিক্স’ নিজেরাই নাকি বিক্রি করতে চেয়েছিল সেতুর উপদেষ্টা কাজ। চুক্তির দেনদরবার ও লেনাদেনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল দেশপ্রেমিক সার্টিফিকেট প্রাপ্ত মন্ত্রীর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান সাকো (Shah Abul Hussain Company) ইন্টারন্যাশনালকে। আমাদের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও সাংসদদের আয় রোজগারের পরিধি সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণা আছে তাদের কাছে এই লেনা দেনাটা একটু অন্যরকম মনে হতে বাধ্য। এতগুলো রাঘব বোয়াল জড়িত, অথচ টাকার অংক মাত্র ৩৮ কোটি! ভাগ বাটোয়ারার অনুপাত মেলাতে গেলে সমীকরণে গোলমাল দেখা দিতে বাধ্য। ’সামান্য’ এই অংকের কাছে দেশের ১নং পরিবারের ২নং ব্যক্তি জনাবা শেখ রেহানার নিজস্ব মন্ত্রী আবুল হোসেন সাহেব ধরা দেবেন বাংলাদেশের কনটেক্সটে ব্যাপারটা একেবারেই অভাবনীয়। লুটপাটের জন্যে বিশ্বব্যাংকের মত আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে ঝামেলা না পাকিয়ে সোনালী, রূপালী আর জনতার মত দেশীয় প্রতিষ্ঠানের দিকে চোখ ফেরালেই ভাগ্যের চাকা আকাশে উঠানো যায় তার প্রমাণ হলমার্ক গ্রুপ। ওরা চার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে হেসে খেলে। এক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মোদাচ্ছেরের কাধে সওয়ার হয়ে সোনালী ব্যাংক হতে বের করে নিয়েছে ট্রাক ভর্তি টাকা। কোথাও কেউ সন্দেহ করেনি, প্রশ্ন তুলেনি। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জানা আছে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে মন্ত্রী এমপি হওয়ার উদ্দেশ্যটা কি। যদিও মিডিয়ার চাপে কয়েকজনকে কদিনের জন্যে জেলখানার মেহমান বানানো হয়েছে, তবে সন্দেহ নেই ওরা বেরিয়ে আসবে। এবং তা হবে মহাসমারোহে। টাকাই যদি মুখ্য হয়ে থাকে চাইলে আবুল গং’রা সোনালী, রূপালী অথবা জনতার যে কোন একটাকে গণধর্ষণ করতে পারতেন। এহেন কাজে বমাল ধরা পরলে জেল হাজত দুরে থাক মন্ত্রিত্ব খোয়া যাওয়ার আশংকাও অবান্তর। সুরঞ্জিত বাবুর ইদানীংকালের কুৎসিত ও নির্লজ্জ হাসি, সাথে বৈধতা অবৈধতার উপর ’বিদায়ী হজের’ শাণিত বাণী আবুল হাবুলদের মত ভবিষৎ শিকারিদের জন্যে শিক্ষা হয়ে থাকবে।
ঢাকায় যখন সেতুর মালিক ও বিনিয়োগকারীরা বৈঠক করছিলেন দূরের দেশে কানাডার টরেন্টোতে মঞ্চস্থ হচ্ছিল অন্য এক নাটক। দৈনিক আমারদেশ পত্রিকার খবরে প্রকাশ কেবল ষড়যন্ত্র নয়, সেতু বিক্রির লেনাদেনায় বিশাল অংকও হাতবদল হয়েছে। দেশীয় ’গ্যাং অব সিক্সে’র বিপরীতে এসএনসি-লাভালিনের ’গ্যাং অব ফোর’ এ পথেই এগোচ্ছিল দুর্নীতির অ্যানাকোন্ডা। কিন্তু পত্রিকার রিপোর্টে বিদেশিদের সাথে জড়িত পঞ্চম একটা নাম সামনে চলে আসায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক কৌতূহল ও চাঞ্চল্য। সবার একটাই প্রশ্ন, কে এই পঞ্চম ব্যক্তি যার একাউন্টে জমা হয়েছিল সেতু বিক্রির বিশাল অংক? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশি এই ব্যক্তির নাম উচ্চারণে অনেকেরই অনীহা। অনেকটা লজ্জাবতী বধুর কায়দায় আমাদের মিডিয়াও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পরাক্রমশালী এই ব্যক্তির চেহারা হতে। ব্যাপারটা খোলাসা করতে টরেন্টোস্থ এক বন্ধুর দ্বারস্থ হলাম। বন্ধু ঠাট্টাচ্ছলে জানাল বৌ হয়ে ভাশুরের নাম মুখে আনতে নেই। নিজ দেশে ভ্রাতৃবধূ! শুনতে খারাপ শোনায় না!!
তদন্ত শেষে বিশ্বব্যাংকের পুলিশরা ফিরে গেছেন নিজ দেশে। কে চোর আর কে সাধু তার সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। তবে যাবার আগে ঝড়ো গতির বেশ কটা শাটল মিটিং করে গেছেন দুর্নীতি তদন্ত কমিটি ও অর্থমন্ত্রীর সাথে। পদ্মা সেতুর ভাগ্য কিভাবে ঝুলে গেল এর উপর চমকপ্রদ সব তথ্য বেরিয়ে আসছে এ ফাঁকে। বলা হচ্ছে দুর্নীতির বিস্তারিত জানিয়ে বাংলাদেশ হতে কেউ একজন প্রথম বিশ্বব্যাংককে অবহিত করেছিল। পরামর্শক কাজের যোগ্যতা বাছাইয়ে এগিয়ে ছিল হালাকো গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এসএনসি ছিল দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু মূল্যায়ন কমিটি অনড় থাকতে পারেনি তাদের সিদ্ধান্তে। এখানেও কাজ করেছে পর্দার অন্তরালে থাকা শক্তিশালী একজন। ঐ ব্যক্তির একটা ফোন কলই নাকি বদলে দেয় পরামর্শক নিয়োগের হাওয়া। অসহায় হয়ে পরেন মন্ত্রি, মন্ত্রনালয় এবং মূল্যায়ন কমিটির বাকি সবাই। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত কমিটি দাবি করছে কে এই ব্যক্তি তা তাদের ভাল করে জানা আছে। দুদকের সঙ্গে বৈঠকে হাসতে হাসতে এমনটাই আভাস দিলেন তদন্ত কমিটির সদস্য ওকাম্পো।
বিশ্বব্যাংকের তদন্ত কমিটি ও দুদকের আলাপ আলোচনা হতে একটা সত্য অনুমান করা যায়, ক্ষমতার সাথে লড়াই চলছে পদ্মা সেতুর ভাগ্যের। দুদক আবুল হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে আসামী না করার ব্যাপারে অনড়। তাদের যুক্তি আবুল হোসেনকে আসামী করা হলে রাজনৈতিক হাঙ্গামা হবে, বিরোধীরা ইস্যু পেয়ে যাবে, তাদের হাতে আন্দোলনের হাতিয়ার তুলে দেয়া হবে। দুদক কর্মকর্তাদের ওই যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারেনি বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দল। তাদের সাফ জবাব, ’এসব আপনাদের ঝামেলা, আপনাদের ব্যাপার, এখানে বিশ্বব্যাংকের করার কিছু নেই’। দুদুককে যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদের ভাল করে জানা আছে ক্ষমতার পালাবাদল কোন গলিতে নিয়ে যাবে তাদের ভাগ্য। দেশীয় বিচার ও শাস্তি ব্যবস্থার এই নোংরা চামড়ার মোটা পশুকে বিদেশিদের কাছে লুকাতে পারেনি গোলাম হোসেনের দল। বিদেশিরা হেসেছে এবং টিটকারি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সমসাময়িক বিশ্বে এসব যুক্তি খোড়া, অচল, অসাড়। সেতু প্রকল্প হতে বিশ্বব্যাংক যে সরে যাচ্ছে এটা প্রায় নিশ্চিত।
যুগ যুগ ধরে স্টিমারে করে যারা পদ্মা পাড়ি দিচ্ছিলেন তাদের জন্যে সেতু বোধহয় স্বপ্নই থেকে যাবে। একদল প্রফেশনাল চোরের দল ৪০টা বছর ধরে দেশকে লুটছ। কেউ পিতার নামে, কেউ ঘোষকের নামে কেউবা আবার ধর্মের নামে। রাষ্ট্রকে ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়ে এখানে সৃষ্টি করা হচ্ছে রাজা, রানী, শাহজাদা আর শাহজাদির দল। বছরের পর বছর ধরে আমরা বাধ্য প্রজার মত রাজতন্ত্রের বেদিতে পূজা দিচ্ছি, জোকার বনে রানী মাতা আর শাহজাদাদের মনোরঞ্জন করছি। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্ব আজ মেরুকরণে ব্যস্ত। আগামী সহাস্রাব্দে সমাজ, সভ্যতা আর মানবতা কোন দিকে এগুবে তার নক্সা আঁকছে তারা। পাশাপাশি আমরা আঁকছি চুরির নক্সা, লুটের পরিকল্পনা, রুটি হালুয়ার ভাগ নিয়ে বন্য বর্বরতার নির্মম চিত্র। সময় কি কোনোদিনই আমাদের পাশে দাঁড়াবে না?
http://www.mzamin.com/details.php?nid=MzM0NjY=&ty=MA==&s=MTg=&c=MQ==
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-07/news/311255