বয়সের কাছে আজকাল অনেক কিছু হার মানছে। স্মরণশক্তি তার অন্যতম। দিন তারিখ মনে নেই, তবে সময়টা মনে আছে। ’৭৭ সালের জুলাই মাস। ইউরোপের এ অংশে বসন্ত আর গ্রীষ্মের পার্থক্যটা সহজে চোখে পরে না। মে মাস পর্যন্ত থেমে থেমে তুষারপাত হয়। অমল ধবল পাল উড়িয়ে শীতের পাগলা ঘোড়া বলতে গেলে নয়টা মাস দাপিয়ে বেড়ায়। শীতের তীব্রতার কাছে পরাভূত, পর্যুদস্ত আর ক্ষতবিক্ষত আমরা কজন চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকি জানালার দিকে। অপেক্ষায় থাকি মাহেন্দ্রক্ষণের যেদিন বাতাসে ভেসে আসবে বসন্তের মৌ মৌ গন্ধ। অনেকটা তুন্দ্রা অঞ্চলের মানুষের মত গাছগুলোও বেরিয়ে আসে তুষারের ঘোমটা হতে। শুরুটা হয় খুব নীরবে। সহজে চোখে পরে না। কিন্তু কোন এক রৌদ্রজ্জ্বল সকালে জানালার বাইরে ভাল করে তাকালে শিহরণ খেলে যায় শরীরে। কুঁড়ি আর পাতায় পাতায় পল্লবিত হয়ে গেছে চারদিকের বৃক্ষরাজি। বসন্ত আসছে। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে গরমের পদধ্বনি। এর অর্থ স্প্রিং টার্মের শেষ। হাতে অফুরন্ত সময়। তিন মাসের ছুটি।
এ যাত্রায় সিদ্ধান্ত নিলাম ছুটিটা এখানে কাটানো যাবেনা। শীতের ধকল কাটাতে আরও পশ্চিমে যেতে হবে। সহযাত্রী হওয়ার জন্যে আরও দুই স্বদেশিকে রাজী করালাম। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে বিরামহীন ট্রেন জার্নি শেষে আমরা যেদিন লন্ডনে পা রাখবো জীবন হতে খসে যাবে তিনটা রাত আর দুটা দিন। পোলান্ডের ওয়ারশ, পূর্ব জার্মানীর বার্লিন, পশ্চিম জার্মানীর হ্যানোভার হয়ে নেদারল্যান্ডের হোক-ভ্যান-হল্যান্ড হতে ধরতে হবে লন্ডনগামী ফেরী। পাড়ি দিতে হবে ইংলিশ চ্যানেল। তবেই পৌঁছাতে পারবো অভিষ্ট গন্তব্যে। ভিসা পর্ব শেষ করতে বেশ কিছুটা সময় বেরিয়ে গেল। পরিকল্পনার নাট-বলটু শেষ বারের মত পরখ করে যুদ্ব যাত্রার মত চেপে বসলাম বার্লিন গামী ট্রেনে। তিন বছর আগে দেশ হতে যেদিন প্লেনে পা রেখেছিলাম পকেট ছিল খালি। তহবিল হতে ১ ডলার দেয়ার মত সামর্থ ছিলনা বাংলাদেশ ব্যাংকের। দেশের আকাশে বাতাসে তখনও বারুদের গন্ধ। ইরাকি সহপাঠির কাছে দশ ডলার ধার চাইতে বাধ্য হলাম। পুঁজি বলতে কেবল এই দশ ডলার। এবং তা-ই পকেটে ভরে রওয়ানা দিলাম পূর্ব হতে পশ্চিম ইউরোপে।
রিটার্ন টিকেট ও দশ ডলারে যে এ ধরণের লম্বা জার্নি সম্ভব ছিলনা আমাদের তা জানা ছিল। তাই বাধ্য হলাম সাথে পর্যাপ্ত খাবার ও পানীয় বহন করতে। শুরুটা খারাপ ছিলনা। খাই দাই ঘুমাই আর জানালার পাশে বসে দেশ দেখি। সোভিয়েত-পোলান্ড সীমান্তে ট্রেনের চাকা ব্রডগেজ হতে মিটারগেজে বদলানো হল। অদ্ভুত এ দৃশ্য। ক্রেনে করে চাকাবিহীন গোটা ট্রেনকে বাতাসে উঠানো হল। চাকা বদলে আবার নীচে নামানো হল। ঘন্টা দুয়েক সময় ব্যয় হল এখানে। পরবর্তী ঠিকানা পূর্ব জার্মানীর রাজধানী পূর্ব বার্লিন। ট্রেন বদলাতে যেতে হবে পশ্চিম বার্লিনে। পায়ে হেটে যারা বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করেননি তাদের কাছে এ অভিজ্ঞতা মনে হবে আরব্য উপন্যাস হতে নেয়া। এ লেখায় বার্লিন দেয়াল অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গেলে লেখার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তাই তুলে রাখছি অন্য সময়ের জন্যে। হোক-ভ্যান-হলান্ড গামী ট্রেনটা ধরতে হল পশ্চিম বার্লিনের জুয়োলজিশিয়া গার্টেন হতে। যাত্রা পথ পশ্চিম জার্মানীর হ্যানোভার হয়ে হল্যান্ডের রটারড্যাম। এবং সেখান হতে হোক-ভ্যান-হল্যান্ড। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে সময় লাগল ছয় ঘন্টা। দুঃসময়ের শুরু ইংল্যান্ডের হারউইচ গামী লাক্সারিয়াস ফেরিতে। খাবার ও পানীয় বলতে হাতে যা ছিল তার সবটাই শেষ। রান্না করা যা ছিল তার অবশিষ্টাংশ ফেলে দিতে হল নষ্ট হওয়ার কারণে। আমার দশ ডলারকে বিদায় জানাতে হয়েছিল পশ্চিম বার্লিনে। বাকি দুইজনের পকেটে নগদ বলে যৎ সামান্য যা ছিল তা দিয়ে লন্ডন পৌছানো সম্ভব হলেও হোটেল ভাড়ার কথা ভাবা যাচ্ছিল না। পকেট খালি ও হাত পা বাঁধা। তাই বলে দমে যায়নি আমরা, আফটার অল আমাদের বয়স ছিল মাত্র উনিশ বিশ বছর। অজনা কে জানার আর অদেখা কে দেখার অদম্য বাসনা আমাদের পৌছে দিল লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে।
পকেটের শেষ পেনি খরচ করে দুপুরের খাবার খেয়ে উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেললাম লন্ডন আসার। অপরিচিত মেগা শহর, পকেট খালি ও পেটে অফুরন্ত ক্ষুধা। বিকেল হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। রাত কোথায় কাটাবো আর খাবোই বা কি সে চিন্তা গ্রাস করে নিল আমাদের অস্তিত্ব। দমে গেলাম আমরা। ছোট হয়ে গেল তিন জনের মুখ। ক্ষুধা আর দুঃশ্চিন্তায় ক্লান্তি এসে ভর করলো শরীরে। হাতের ব্যাগটাকে বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম লেষ্টার স্কয়ারের ছোট মাঠটায়।
বন্ধু রহমানের ধাক্কায় ধর ফর করে উঠে বসলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বুঝতে পারলাম না। ততক্ষণে ফিকে হয়ে গেছে দিনের আলো। ঘুম ভাঙ্গতেই ক্ষুধা নামক দৈত্যটা জেগে উঠল। জীবনে এই প্রথম অনুভব করলাম আমি ক্ষুধার্ত এবং খাবার কেনার সামর্থ্য নেই আমার। দুলে উঠল আমাদের পৃথিবী। ঘোর কাটল রহমানের চিৎকারে। সে যা বলছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। একটা নাকি ব্যবস্থা হয়ে গেছে আমাদের। এক্ষুণি রওয়ানা দিতে হবে। ইসলাম তখনো গভীর ঘুমে। ওকে জাগাতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল। রহমানকে জেরা করতে বেরিয়ে হল আসল কাহিনী। আমরা যখন ঘুমাচ্ছিলাম সে তখন পাশের টেলিফোন বুথের ইয়োলো পেইজ সন্ধান করছিল সিলেটি ভাইদের রেষ্টুরেন্ট। তিন নাম্বার কলেই নাকি পাওয়া গেছে পজেটিভ রেসপনস। আমাদের যেতে হবে সাউথ লন্ডনের ব্রিক্সটনে। ওখানেই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন মালিক কাদির মিয়া। তড়িঘড়ি করে তৈরী হয়ে নিলাম আমরা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়, ক্যাব ভাড়া নেই আমাদের হাতে। রহমান ফোন করে নিশ্চিত করল আমাদের আর্থিক অবস্থা। কাদির মিয়া জানালেন অসুবিধা নেই, ভাড়া তিনিই মেটাবেন। রেসিয়াল দাঙ্গার কারণে ব্রিক্সটন এলাকা এমনিতেই ছিল বিপদজনক, তার উপর এ দেশে আমরা ছিলাম একেবারেই নতুন। এতকিছু ভাবার সময় ছিলনা। বিধাতার উপর ভাগ্য সঁপে দিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম ব্রিক্সটনের উদ্দেশ্যে।
কাদির ভাই উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়ে গেলাম আমরা। হয়ত চেহারা দেখেই বুঝতে পারলেন আমাদের পেটের অবস্থা। কোথাও যেন ফোন করলেন এবং সিলেটি ভাষায় যা বললেন তার মর্ম উদ্ধার করতে আমাদের কষ্ট হল। ভাড়া তিনিই চুকিয়ে দিলেন এবং তিন জনের লাগেজ টেনেটুনে নিজেই ট্রাংকে উঠালেন। আমাদের কাছে মনে হল এ কাদের ভাই নন, আসমান হতে পাঠানো বিধাতার বিশেষ দূত। গ্রীষ্মের লম্বা দিন ততক্ষণে দিগন্ত রেখায় বিদায় নিয়েছে। চারদিকে হাল্কা অন্ধকার। সুইং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকতে আরও দু’তিন জন সিলেটি ভাই এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ভাল মন্দের খবর নিলেন। আমরা সবাই ছাত্র জেনে খুবই সন্মান করলেন। এলাকায় জাতিগত দাঙ্গার কারণে ব্যবসার অবস্থা মোটেও ভাল ছিলনা। রেষ্টুরেন্ট ছিল প্রায় খালি। কাদির ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন স্টাফদের সাথে। বুকের সবটুকু উষ্ণতা উজাড় করে এক লহমায় আপন করে নিল আমাদের তিনজনকে। কথা না বাড়িয়ে আগে খাওয়া পর্বটা সেরে নেওয়ার আহ্বান জানালেন শেফ ভাই। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে অনেকটা যান্ত্রিক পুতুলের মত পিছু নিলাম তার। কিচেন টেবিলের উপর আয়োজন দেখে আমাদের টাস্কি খাওয়ার অবস্থা। হাত কোন রকমে ধুয়ে ক্ষুধার্ত কুকুরের মত ঝাঁপিয়ে পরলাম প্লেটের উপর। ঢেঁড়শ ভাজি দিয়ে শুরু। শুটকি ভর্তা, সাথে চিংড়ি ভুনা, বীফ কারি, তারকা ডাল আর টমেটো সালাদ। শেফ ভাই আক্ষেপ করে জানালেন দুপুরের ষ্টাফ কারী অবশিষ্ট নেই, তাই মাছ অফার করতে পারছেন না। রাতের কারী পাকাতেও একটু দেরি হবে, তাই কাস্টমারদের কারী দিয়েই আপ্যায়ন করতে হচ্ছে আমাদের। এতকিছু শোনার ধৈর্য্য ছিলনা আমাদের। গোগ্রাসে শুধু খেয়ে গেলাম। সে-কি খাওয়া! মনে হল বহু বছরের অভুক্ত একদল হাভাতে বাংলাদেশি আমরা, কেবল খাবারের সন্ধানে চষে বেড়াচ্ছি গোটা পৃথিবী। খাবার শেষ হতে হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেল আমাদের। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করল দু চোখের উপর। কাদির ভাই চেহারা দেখে অনুমান করলেন আমাদের অবস্থা। গাড়িতে করে স্ট্রেটহাম হিলের একটা এপার্টমেন্টে রেখে গেলেন আমাদের। মলিন ও গন্ধযুক্ত কটা বিছানা দেখিয়ে ঘুমিয়ে পরার আহ্বান জানালেন। আমাদের কাছে মন হল এ যেন স্বর্গ। কয়েক ঘন্টা আগের অপরিচিত লন্ডন শহর এ মুহূর্তে মনে হল অনেক আপন, অনেক চেনা।
এ ছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মত আমার জন্যে বিলাত আবিস্কার। তারপর বহুবার লন্ডন গেছি। হরেক রকম জায়গায় বাস করেছি, বাহারি খাবার খেয়েছি। কিন্তু শেফ মুতু ভাইয়ের সেদিনের সে খাবার ও মালিক কাদির ভাইয়ের সে আতিথেয়তা কেবল হৃদয়ে নয় বরং টিকে থাকবে অস্তিত্বের সবটুকু জুড়ে। ধন্যবাদ কাদির ভাই, ধন্যবাদ মুতু ভাই, ধন্যবাদ কোহিনূর রেস্টুরেন্টের বাকি সবাইকে।